এক সপ্তাহ পরের রিপোর্ট, “আমি বিশ্রাম নিতে আরম্ভ করলেই অ্যালবুমিন ও সুগার উধাও হয়ে যায়।” জানুয়ারির শেষে শরীরের এমনই উন্নতি হলো যে স্বামীজি জাপান ও চিন যাওয়ার পরিকল্পনা করছেন। কিন্তু মার্চ ১৯০২তে নিবেদিতাকে লেখা চিঠিতে আবার অবনতি সংবাদ। বারাণসী থেকে রোগজর্জরিত বিবেকানন্দ অনুরোধ করছেন, “যদি আমার দেহাবসান হয় (বারাণসীতে সেটা হোক আমি তো চাইব) দয়া করে আমাকে লেখা ক্রিশ্চিনের চিঠিগুলো অবশ্যই তুমি খুলবে, তাকে তুমি অবশ্যই অভ্যর্থনা করবে এবং তাকে দেশে ফেরত পাঠিয়ে দেবে। যদি ওর কাছে টাকা না থাকে, অবশ্যই টিকিট কেটে দেবে–এর জন্য যদি ভিক্ষে করতে হয় তাও করবে। আমি ইউরোপ থেকে সামান্য যে টাকা এনেছিলাম তা মায়ের খাওয়া দাওয়া এবং দেনা শোধ করতে লেগে গিয়েছে। যতটুকু আছে তাতে হাত দিতে পারছি না, যে মামলাটা ঝুলে আছে তাতে লেগে যাবে।”
মহানির্বাণের সময় আর দূরে নয়। ২৭ মে ১৯০২ ক্রিশ্চিনকে বেলুড় থেকে স্বামীজি জানাচ্ছেন, তার লিভারের উন্নতি হয়েছে। সেইসঙ্গে কিছু খারাপ খবর, একটা ছাগলছানা মাছের চৌবাচ্চায় ডুবে মরেছে।
২১ জুন ক্রিশ্চিনকে স্বামীজি জানাচ্ছেন, উদ্বেগের বিন্দুমাত্র কারণ নেই। ডাক্তাররা সব কিছু খেতে বলেছেন, কিন্তু স্বামীজি খুব ভেবেচিন্তে খাওয়াদাওয়া করছেন। চিঠির শেষে একটি ‘পুনঃ–”আমার শরীরে চর্বি জমছে বিশেষ করে পেটে। ভয়াবহ দৃশ্য!”
“আমার কথাটি ফুরলো নটে গাছটি মুড়লো” এই ছড়াটির ইংরেজি তর্জমা করে সদ্য ভারতে-আসা ক্রিশ্চিনের সঙ্গে স্বামীজি রসিকতা করেছিলেন। ২১ জুন ১৯০২ তারিখে চিঠিটাই ক্রিশ্চিনের কাছে স্বামীজির শেষ চিঠি।
এই জুন মাসের ২৭ তারিখে রোগজর্জরিত স্বামীজির এক শান্তপ্রসন্ন স্নেহময় ছবি দেখতে পাচ্ছি প্রিয় শিষ্য শরচ্চন্দ্র চক্রবর্তীর রচনায়। অফিসের পোশাকেই শিষ্যকে বেলুড়ে দেখে স্বামীজি বললেন, “তুই কোটপ্যান্ট পরিস, কলার পরিস না কেন?” স্বামী সারদানন্দকে ডেকে বললেন, “আমার যেসব কলার আছে, তা থেকে দুটো কলার কাল একে দিস তো।” আরও আধঘণ্টা পরে স্বামীজি ধ্যানস্থ, বাহ্যচেতনাহীন। আরও পরে শিষ্য লক্ষ্য করলেন, “স্বামীজির বদ্ধ পাণিপদ্ম কম্পিত হইতেছে।”
শেষপর্বে স্বামীজির নানা রোগের তালিকায় আর একটি সংযোজন উদরী, অর্থাৎ পেটে জল হওয়া। রোগাক্রান্ত, বিনিদ্র, ধৈর্যচ্যুত, তিতিবিরক্ত যে বিবেকানন্দকে আমরা দেখতে পাই তিনি প্রায়ই প্রিয়জনদের এমনই বকাবকি করেন যে তাদের চোখে জল এসে যায়। স্বামী ব্রহ্মানন্দ একবার বলেছিলেন, “তার বকুনি সহ্য করতে না পেরে আমারই কতবার মনে হয়েছে মঠ ছেড়ে চলে যাই। একদিন বকুনি খেয়ে দুঃখে অভিমানে দরজা বন্ধ করে কাঁদছি, কিছুক্ষণ পরে স্বামীজি দরজায় টোকা মারছে, দরজা খুল্লম।…স্বামীজি বলতে লাগলেন, আমি কী করব, আমার শরীরটা চব্বিশ ঘণ্টাই জ্বলছে, মাথার ঠিক থাকে না।
এর পর স্বামীজি তার প্রিয় বন্ধু ও গুরুভাইকে যা বলেছিলেন তা আজও হৃদয়কে নাড়া দেয়। “আমি বেঁচে থাকলে তোমাদের হয়তো বৃথা কষ্ট দেব। দেখ রাজা একটা কাজ করতে পারো? ওদের রেসিং হর্স যখন অকেজো হয়ে পড়ে তখন কী করে জানো? তাকে বন্দুকের গুলিতে মেরে ফেলে। আমি তোমাকে একটা রিভলভার জোগাড় করে দেব, তুমি আমাকে গুলি করে মারতে পারবে? আমাকে মারলে কোনও ক্ষতি হবে না, আমার কাজ ফুরিয়ে গেছে।”
বিদেশ থেকে ফিরে আসার পর থেকে দেহত্যাগ পর্যন্ত স্বামীজি একান্ত সেবক ছিলেন স্বামী নির্ভয়ানন্দ, পূর্বাশ্রমে নাম কানাই সেন। স্বামীজির প্রধান সমস্যা ছিল বিনিদ্রা, একেবারেই ঘুমোতে পারতেন না। কানাই মহারাজের মুখে শোনা যাক স্নেহময় সন্ন্যাসীর একটি অপ্রচলিত গল্প। “শরীর যাবার কিছুদিন আগে বিদেশ থেকে একটি স্প্রিং-এর খাট উপহার এসেছিল। এর আগে ক্যাম্প খাটে শুতেন। নতুন খাট দেখে একদিন রহস্য করে বলেছিলাম, মশায় এখন তো আপনি বেশ আরামে ঘুমোচ্ছেন। শুনেই স্বামীজি বললেন, “তবে রে শালা! আজ তোকে এই খাটে শুতে হবে। এই বলে জোর করে আমাকে ওই খাটে শোয়ালেন। কিন্তু আমার কি এতে ঘুম হয়। স্প্রিং-এর খাট, এক একবার নিচে নেমে যাচ্ছে আর আমি লাফিয়ে উঠছি। সকালে স্বামীজি জিজ্ঞেস করলেন, “কি রে কেননা, কাল রাতে তোর কেমন ঘুম হল? বেশ মজা করে ঘুমিয়েছিস তো?” আমি বললাম, “আর বলবেন না।” স্বামীজি, “তবে রে শালা, তুই যে বলেছিলি আমার মজা করে ঘুম হয়! এখন বুঝলি তো?”
সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত শেষ দিনে ঘটনার বিবরণ ইতিমধ্যেই সযত্নে সাজানো হয়েছে। উৎসাহী পাঠক-পাঠিকা ‘অচেনা অজানা বিবেকানন্দ’ বইটির শেষ পর্ব পড়ে দেখতে পারেন। ওখানে বলা আছে, বেলুড় বাজার পর্যন্ত দু’মাইল বেড়িয়ে সন্ধ্যায় কয়েকজন সন্ন্যাসীকে চা খেতে দেখে, স্বামীজি নিজে এক কাপ চা চাইলেন।
সেবক কানাই মহারাজের বিবরণ একটু আলাদা। বিকেলে আমি ও হুটকো গোপালের দাদা চা খাচ্ছি, তখন পূজনীয় বাবুরাম মহারাজকে নিয়ে বেলুড় বাজারের দিকে বেড়াতে যাচ্ছিলেন স্বামীজি। আমাদের চা খেতে দেখে কাছে এসে বললেন, “কি কেনো, কি খাচ্ছ?” আমি বললাম, মশায়, একটু চা।’ তাই শুনে বললেন, “আমায় একটু দেবে না?” আমি তো জানি তিনি কিরূপ চা খান। তাই একটু গরম জলের সঙ্গে একটু দুধ মিশিয়ে তার মুখের কাছে ধরলাম। তিনি তাতে দু-এক চুমুক দিয়ে বললেন, “বেড়ে তো।” এই বলেই তিনি কাপটি নিয়ে বেড়াতে গেলেন কিন্তু তাতে যে একটুও চা নেই সেদিকে তাঁর হুঁশই ছিল না।” এই হল কানাই মহারাজের শেষ বিবেকানন্দ সেবা।