আর এক গুরুভাই স্বামী অখণ্ডানন্দকে স্বামীজি লিখছেন, “শরীর তো যাবেই, কুঁড়েমিতে কেন যায়? মরচে পড়া মড়ার চেয়ে ক্ষয়ে ক্ষয়ে মরা ঢের ভালো। মরে গেলেও হাড়ে ভেলকি খেলবে।” একই বছরে (২৮ এপ্রিল) দার্জিলিং থেকে মেরি হেলকে স্বামীজির চিঠি: “আমার চুল গোছা গোছা পাকতে আরম্ভ করেছে এবং মুখের চামড়া অনেক কুঁচকে গেছে..আমার বয়েস যেন আরও কুড়ি বছর বেড়ে গিয়েছে। (এই সময় স্বামীজির বয়স ৩৪)।”
পরের মাসে (২৯ মে) প্রিয় শশী ডাক্তাকে আলমোড়া থেকে স্বামীজির চিঠি। “যোগেন কি লিখছে তা হৃক্ষেপ করবে না।” মুখে যাই বলুন, ভিতরে ভিতরে তার চিন্তার ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে ৩ জুন ১৮৯৭ তে আমেরিকান ভক্তকে লেখা চিঠিতে : “যদি শেষ পর্যন্ত আমার স্বাস্থ্য ভেঙেই পড়ে, তা হলে এখানে কাজ একদম বন্ধ করে দিয়ে আমি আমেরিকায় চলে যাব। তখন আমাকে আহার ও আশ্রয় দিতে হবে–কেমন পারবে তো?”
রবিবার ৯ ডিসেম্বর ১৯০০ সন্ধ্যায় যে-মানুষটি বিদেশ থেকে ফিরে সকলের সঙ্গে প্রাণভরে খিচুড়ি খেলেন তার মধ্যে গুরুভাইরা তেমন কোনও অসুস্থতার লক্ষণ দেখতে পাননি। কিন্তু খেতড়ি নরেশকে বিবেকানন্দ তখনই জানাচ্ছেন, “আমার হার্ট খুবই দুর্বল হয়ে পড়েছে… আমার মনে হচ্ছে, এ জীবনে যা করার ছিল তা শেষ হয়েছে।”
ডিসেম্বরে মায়াবতীতে বসে প্রিয় শিষ্য বিরজানন্দকে স্বামীজি বললেন, “শরীরটাকে বেজায় কষ্ট দিয়েছি, তার ফল হয়েছে কি? না জীবনের যেটি সবচেয়ে ভালো সময় সেখানটায় শরীর গেল ভেঙে।”
পরের মাসেও খবর ভালো নয়। “মঠে যে-মুহূর্তে পদার্পণ করি, তখনি আমার হাঁপানির কষ্টটা ফিরে আসে, এ স্থান ছাড়লেই আবার সুস্থ।” মার্চ মাসে ঢাকা ভ্রমণকালে এক বারাঙ্গনা করুণভাবে স্বামীজির কাছে হাঁপানির ওষুধ ভিক্ষা করছে। স্বামীজি সস্নেহে বলছেন, “এই দেখ, মা! আমি নিজেই হাঁপানির যন্ত্রণায় অস্থির। যদি আরোগ্য করার ক্ষমতা থাকত, তাহলে কি আর এই দশা হয়!”
ঢাকা ও কামাখ্যায় স্বামীজির শরীর ক্রমশ কীভাবে খারাপ হয় তার বিবরণ আছে প্রমথনাথ বসুর বিবেকানন্দ জীবনীতে। গৌহাটির স্বাস্থ্যবিপর্যয়ে লক্ষ্য স্থির হল ৩৬ মাইল দূরে শিলং, সেখানকার জলবায়ু স্বাস্থ্যকর। চিফ কমিশনার স্যর হেনরি কটন অসুখের কথা শুনে স্থানীয় সিভিল সার্জেনকে স্বামীজির কাছে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। প্রমথনাথ বসুর সংযোজন, ঢাকা থেকে বহুমূত্রের সঙ্গে হাঁপানির প্রকোপ বৃদ্ধি পেয়েছিল, শিলং-এ এসে তা আরও ভীষণভাব ধারণ করল। শ্বাসগ্রহণের সময় অসহ্য কষ্ট। কতকগুলো বালিশ একত্র করে বুকের উপর ঠেসে ধরতেন এবং সামনের দিকে ঝুঁকে প্রায় একঘণ্টা পর্যন্ত অসহ্য যন্ত্রণা ভোগ করতেন। এইখানেই শিষ্যগণ শুনেছিলেন, তিনি অনুচ্চ স্বরে বলছিলেন, যাক, মৃত্যুই যদি হয় তাতেই বা কী এসে যায়? যা দিয়ে গেলুম দেড় হাজার বছরের খোরাক।
শিলং-এ স্বামীজির শরীরে অ্যালবুমিনও বেড়েছিল, শরীর দ্বিগুণ ফুলে যায় বলে শোনা যায়। এই শিলং-এ যে ছবি তোলা হয়েছিল অদ্বৈত আশ্রমের সংগ্রহে এইটাই এখনও পর্যন্ত স্বামীজির শেষ ফটোগ্রাফ। এই ছবিতে তিনি কিন্তু শীর্ণকায়–শরীর ফুলে ওঠার কোনও লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। কেউ কেউ তাই সন্দেহ করেন এই ছবি শিলং-এ নয়, দেওঘরে তোলা।
১২ মে ১৯০১ সালে স্বামজি আবার গৌহাটি হয়ে ট্রেনে কলকাতায় ফেরেন। মঠে অবস্থানকালে সমাজের কোনও ধার না ধরে, স্বামীজি খুশিমতো ঘুরে বেড়াতেন, কখনও চটি পায়ে, কখনও খালি পায়ে, কখনও। গেরুয়া পরে, কখনও বা শুধু কৌপীন এঁটে। অনেক সময় হাতে একটা হুঁকো বা লাঠি থাকত। কিন্তু পা ফুলে শোথের লক্ষণ দেখা দিল, হাঁটতে কষ্ট হতো।
জুন মাসে কবিরাজি চিকিৎসার কথা উঠল। স্বামীজির খুব উৎসাহ ছিল না, কিন্তু স্বামী নিরঞ্জনানন্দের উৎসাহে বউবাজারের মহানন্দ সেনগুপ্ত মহাশয়কে ডাকা হলো। তিনি এসেই লবণ-সংযুক্ত ব্যঞ্জনের ব্যবহার ও জলপান নিষেধ করলেন। যিনি বহুবার জল খেতেন, তিনি অবিশ্বাস্য মনোবলে জলপানের অভ্যাস ত্যাগ করলেন। এই সময় স্বামীজির আহার খুব কমে গিয়েছিল।
অক্টোবরে স্বামীজির অবস্থা আবার আশঙ্কাজনক হয়ে উঠল। বাড়ির বাইরে যেতে পারতেন না। খ্যাতনামা সায়েব চিকিৎসক ডাক্তার সন্ডার্সকে দেখানো হলো, তিনি সবরকম দৈহিক ও মানসিক পরিশ্রম নিষেধ করলেন।
সেই সময় পোষা জন্তু জানোয়ার পাখিদের নিয়ে বেলুড়ে স্বামীজি অন্য জীবন কাটাতে আরম্ভ করলেন। এই সময়ে চিঠিতে তিনি লিখছেন, “আমার চিড়িয়াখানায় মুরগি নেই, ওই জীব এখানে নিষিদ্ধ।”
নভেম্বরের শেষে স্বামীজি চিঠি লিখছেন, “ডান চোখটা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে প্রায় কিছুই দেখা যাচ্ছে না!” চোখের ডাক্তারের কাছে যাবেন, কিন্তু সর্দিতে শয্যাশায়ী হয়ে আছেন, সেই সঙ্গে হাঁপানির দাপট।
১২ ডিসেম্বর ১৯০১-এর খবর স্বয়ং স্বামীজি দিচ্ছেন সিস্টার ক্রিশ্চিনকে। “তুমি তো জানেনা, গত তিনবছর ধরে আমার প্রায়ই অ্যালবুমিন-ইউরিয়া হচ্ছে। কিডনির স্ট্রাকচারাল কোনও দোষ নেই, কিন্তু তারা প্রায়ই অ্যালবুমিন বার করছেন। ডায়াবিটিসের সুগার বেরনো থেকে এটা অনেক খারাপ। অ্যালবুমিন রক্তকে বিষময় করে, হার্ট অ্যাটাক করে, সেইসঙ্গে আরও নানা ক্ষতি হতে পারে। ঘন ঘন সর্দি লাগার আশঙ্কাও থেকে যায়।” ডান চোখেও স্বামীজি দেখতে পাচ্ছেন না, ডাক্তাররা বিছানায় শুইয়ে দিয়েছেন। মাংস খাওয়া বারণ, হাঁটা বারণ, দাঁড়ানো বারণ, এমনকী, লেখাপড়া বারণ।