যাত্রীরা অবশেষে কায়রোয় উপস্থিত হলেন। কিন্তু সেখানে কী ঘটল? এখনও পর্যন্ত হাতে কলমে কোনও প্রমাণ নেই, কিন্তু স্বামীজির পারিবারিক সূত্রে একটা কথা ভেসে বেড়িয়েছে অনেকদিন, ছোটভাই ভূপেন্দ্রনাথের নিতান্ত আপনজন এবং পরবর্তীকালে তার প্রকাশক প্রয়াত রঞ্জিত সাহা শুনেছেন, স্বামীজিকে শুধু চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হয়নি, তাকে কায়রোতে সামান্য সময়ের জন্য হাসপাতালে যেতে হয়েছিল। এ বিষয়ে বিস্তারিত কথা বলার আগেই রঞ্জিত সাহা দুর্ভাগ্যক্রমে দেহরক্ষা করেন। ব্যাপারটা গুরুত্বপূর্ণ এই কারণে যে সমস্ত জীবনে কলকাতায় অথবা স্বদেশে কিংবা বিদেশে বারবার অসুস্থতার সংবাদ থাকলেও, কোথাও স্বামীজি হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন বলে খবর পাওয়া যায়নি। এতদিন পরে কায়রো সূত্রে কোনও খবর পাওয়া সম্ভব বলে মনে হয় না। খবর কিছু থাকলে তা রয়েছে মাদাম কালভের অথবা মিস ম্যাকলাউডের অপ্রকাশিত কাগজপত্রে।
হাসপাতালের ব্যাপারে যাই হোক, মাদাম কালভে গানের আসর থেকে ফিরে বান্ধবীর কাছে শুনলেন স্বামীজি খুব মনমরা অবস্থায় রয়েছেন এবং যাত্রাভঙ্গ করে দেশে ফিরতে চাইছেন। প্রশ্নের উত্তরে বিষণ্ণ স্বামী বিবেকানন্দ কাঁদতে কাঁদতে জানালেন, “আমি দেশে ফিরতে চাই মরবার জন্য, আমার গুরুভাইদের কাছে যেতে চাই আমি।” এর পরই বিস্ফোরণ। এমা কালভেকে স্বামীজি জানালেন, ৪ঠা জুলাই আমার মৃত্যু হবে।
মাদাম কালভের দেওয়া অর্থে টিকিট কিনে স্বামী বিবেকানন্দ রুবাত্তিনো জাহাজে চড়লেন মুম্বইয়ের উদ্দেশে। বান্ধবী সারা বুলকে তখন লেখা মিস ম্যাকলাউডের একটা চিঠির ফুটনোটের প্রতি আমাদের দৃষ্টি আকর্ষিত হচ্ছে : “স্বামীজির খবর ভালো নয়। তার আর একটা হার্ট অ্যাটাক হয়েছিল।” সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শব্দ আর একটা হার্ট অ্যাটাক’। এর মানে কি এইটাই দ্বিতীয় আক্রমণ? সেক্ষেত্রে বেলুড়ে ৪ জুলাই ১৯০২ সন্ধ্যায় তৃতীয় হার্ট অ্যাটাকেই কি তার মর্ত্যলীলার অবসান?
বোম্বাই হয়ে স্বামীজি আচমকা বেলুড় মঠে ফিরলেন রবিবার ৯ ডিসেম্বর ১৯০০। হাওড়া স্টেশনেও কেউ তাকে রিসিভ করতে যাননি, নিজেই একটা গাড়ি ভাড়া করে বেলুড়ে পৌঁছে, গেট টপকে যখন মঠের ভিতরে ঢুকলেন তখন সন্ন্যাসীদের সন্ধ্যা-আহার শুরু হতে চলেছে। আমাদের চোখে জীবন নাটকের শেষ অঙ্কের শুরু এই দিন থেকেই, যার অবশ্যম্ভাবী পরিণাম ৪ জুলাই ১৯০২।
প্রশ্ন ওঠে, কেন এবং কীভাবে স্বামী বিবেকানন্দ এত কম সময়ে চলে গেলেন? অতি পরিশ্রমে তিনি কি নিজেকে তিলে তিলে ক্ষয় করলেন? না সময়মতো সমকালের সেরা চিকিৎসা তার জন্য জোগাড় করা অনুরাগীদের পক্ষে সম্ভব হল না? না, সচ্ছল পরিবারে পরম স্নেহে লালিত শরীর ভোজনং যত্রতত্র ও শয়নম হট্টমন্দিরের ধাক্কা সহ্য করতে পারল না? না, মৃত্যুকে তিনি স্বেচ্ছায় ডেকে আনলেন নিজের আধ্যাত্মিক শক্তিতে?
স্বামীজির পৌরুষময় শরীর। রোমাঁ রোলাঁর বর্ণনায়–মল্লযোদ্ধার মতো সুদৃঢ় শক্তিশালী ও সুদীর্ঘ (পাঁচফুট সাড়ে আট ইঞ্চি), ওজন ১৭০ পাউন্ড। রোলাঁর কলমে–প্রশস্ত গ্রীবা, বিস্তৃত বক্ষ, সুদৃঢ় গঠন, কর্মিষ্ঠ পেশল বাহু, শ্যামল চিক্কণ ত্বক, পরিপূর্ণ মুখমণ্ডল, সুবিস্তৃত ললাট, কঠিন চোয়াল, আর অপূর্ব আয়ত পল্লবভারে আনত ঘনকৃষ্ণ দুটি চোখ। তাঁর ভাই মহেন্দ্রনাথ আরও কিছু বিবরণ রেখে গিয়েছেন–পায়ের তলার সামনেটা আর পিছনটা মাটিতে ঠেকতো না (খড়ম পা), পাতলা, সরু ও লম্বা এই পা, হাতের আঙুল সরু, লম্বা ও অগ্রভাগ ছুঁচাল, হাতের নখ মুক্তার মতো উজ্জ্বল, কিঞ্চিৎ রক্তাভ। গোল, পুরুষ্ট মুখ, পাতলা ঠোঁট যা ইচ্ছামতো দৃঢ় করতে পারতেন। সিঙ্গি নাক–অর্থাৎ উন্নত, ইচ্ছা করলে নাক কুঁচকে উপরের দিকে তুলতে পারতেন। সুডৌল, সরু লম্বা হাত। মাথার পিছন দিকটা চ্যাপ্টা। মাথার ব্রহ্মতালু উঁচু যা দার্শনিক ও জ্ঞানী পুরুষের লক্ষণ।
পশ্চিমের লেখকরা অত্যন্ত সাবধানী, রোমাঁ রোলাঁর রায় “অতি পরিশ্রমে” তার সংক্ষিপ্ত জীবন আরও সংক্ষিপ্ত হয়েছিল। রোমাঁ রোলার অনুসন্ধান অনুযায়ী, পারিবারিক বহুমূত্র রোগের প্রথম লক্ষণগুলি, যখন তার বয়স সতেরো আঠারো, তখনই দেখা যায়। স্বামীজির তরুণ বয়সে ডায়াবিটিসের লক্ষণ সম্পর্কে কোনও তথ্য আমি অন্যত্র খুঁজে পাইনি। প্রথমবার মার্কিন দেশে থাকাকালীন নামী ডাক্তারদের স্নেহসান্নিধ্যও হয়েছে, কিন্তু কোথাও ডায়াবিটিসের উল্লেখ নেই।
স্বামীজির আরও দুটি রোগের উল্লেখ করেছেন রোলাঁবারবার ম্যালেরিয়া রোগে মারাত্মকভাবে পীড়িত হন ও আরেকবার তীর্থভ্রমণকালে ডিপথেরিয়া। ধৈর্য ধরে ইদানীং যে বিস্তারিত তালিকা প্রস্তুত করা গিয়েছে তাতে দেখা যাচ্ছে বিভিন্ন সময়ে স্বামীজি অন্তত বত্রিশটি রোগের শিকার হয়েছিলেন। এর তালিকা অচেনা অজানা বিবেকানন্দ বইতে নিবেদন করা গেছে।
স্বামীজি শেষবারের মতো দেশে ফিরে আসার পরে তার শরীরের অবস্থা কেমন সে সম্পর্কে আমরা খোঁজখবর করব।
তার আগে উল্লেখ প্রয়োজন স্বামীজির অসামান্য মনোবলের, যার তেজে রোগজীর্ণ শরীর নিয়েও তিনি অসম্ভব সব কাজ করে যেতে পারলেন।
দ্বিতীয়বার বিদেশ যাওয়ার আগে ১৮৯৭ সালে ২০ মে স্বামী ব্রহ্মানন্দকে আলমোড়া থেকে স্বামীজি লেখেন, “তুমি ভয় পাও কেন? ঝট করে কি দানা মরে? এই তত বাতি জ্বললো, এখনও সারারাত্রি গাওনা আছে।”