ডাক্তার রসিকলাল দত্ত সম্পর্কে আরও যা জানতে পেরেছি–একমাত্র পুত্র জহরলালকে তিনি রানিগঞ্জের কাছে ভসকাজুলী নামে কয়লাখনি কিনে দেন। ১৮৯৪ সালে ৪ জানুয়ারি দুটি কন্যা ও অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রীকে রেখে পুত্র জহরলাল পরলোকগমন করেন। ১৮৯৪ সালের ১৭ এপ্রিল রসিকলালের পৌত্র রঙ্গলাল দত্তের জন্ম। প্রথম পৌত্রী আশালতা চ্যাটার্জি পরবর্তীকালে বিখ্যাত ডাক্তার কর্নেল কে কে চ্যাটার্জির পত্নী। দ্বিতীয় পৌত্রী অনারেবল মিসেস শান্তিলতা সিংহ লর্ড সিংহের পুত্র অনারেবল শিশিরকুমার সিংহের সহধর্মিণী। ১৯০৮ সালে রসিকলাল-পত্নী গোলাপমোহিনীর দেহত্যাগ। তার মৃত্যুর দু’মাস পরে রসিকলাল ৪ নম্বর ময়রা স্ট্রিটে বাড়ি কেনেন।
জীবনের শেষদিকে পুত্রশোকাতুর ডাক্তার রসিকলাল দত্ত দৃষ্টিহীন হয়ে যান। এই অবস্থায় জীবন-ধারণ করা তাঁর পক্ষে অত্যন্ত কষ্টকর হয়েছিল, তিনি নাকি প্রায়ই বলতেন—”ভগবান আমাকে শীঘ্র নাও, আমার কাজ শেষ হয়েছে।”
১২. “আমার কাজ আমি করে দিয়েছি বস্”
রামকৃষ্ণ মঠ-মিশনে মৃত্যুর কোনো স্বীকৃতি নেই, কারও তিরোধান দিবসেই কোনো অনুষ্ঠান হয় না। তবু স্বামী বিবেকানন্দর মহানির্বাণের দিনটি (৪ জুলাই) কাছাকাছি এলেই প্রতিবছর তার সম্বন্ধে অনেকের অস্থিরতা ও আগ্রহ ভীষণ বেড়ে যায়। বেঁচে ছিলেন তো মাত্র ঊনচল্লিশ বছর কয়েক মাস, তারই মধ্যে প্রধান সময়টা সহায়সম্বলহীন অবস্থায় দেশ ও বিদেশের পথে পথে কেটেছে। সংখ্যাহীন প্রতিকূল অবস্থামালার বিরুদ্ধে বিরামহীন লড়তে-লড়তে স্বামীজি কী করে মানুষের জন্যে এত চিন্তা করে গেলেন তা ক্রমশই আমার কাছে এক বিরাট বিস্ময়ের বিষয়বস্তু হয়ে দাঁড়িয়েছে।
ইদানীং স্বামীজির শরীরের নানা অসুখবিসুখ সম্বন্ধেও মানুষের আগ্রহ বাড়ছে। এতরকম ব্যাধি ও শারীরিক যন্ত্রণাকে পরোয়া না করে সন্ন্যাসী বিবেকানন্দ কীভাবে এমন বিধ্বংসী ঝড় তুলে গেলেন তাও মানুষের অনুসন্ধানের বিষয়।
স্বামীজির শরীর-স্বাস্থ্য প্রসঙ্গে ‘অচেনা অজানা বিবেকানন্দ’ বইতে কিছু লেখা হয়েছে, এ-বিষয়ে আরও একটু ঝালিয়ে নেওয়া যেতে পারে। স্বামী সারদানন্দকে লন্ডনে স্বামী বিবেকানন্দ জিজ্ঞেস করলেন, “হারে, দেশের লোকগুলো এত শীঘ্র মরে যায় কেন? যার কথা জিজ্ঞেস করি, খবর নেই, সে মারা গেছে। জাতটা কি মরে বিলোপ পেয়ে যাবে নাকি?…ওরা যে দুখচেটে খায়, তাতে এত শীঘ্র মরে যায়। ওদের খাওয়াটা বদলে দেওয়া দরকার। আমেরিকাতে যখন ছিলুম, তখন কয়েক বৎসরের ভিতর কোনো ব্যামো হয় নাই। কয়েকদিন সামান্য সর্দিকাশি হয়েছিল। ভূতের মতো পরিশ্রম করেছি, তাতে কিন্তু শরীর খারাপ হয় নাই।”
এসব ১৮৯৬ সালের কথা, স্বামীজির ভ্রাতা মহেন্দ্রনাথ ও গুরুভাই স্বামী সারদানন্দ তখন লন্ডনে উপস্থিত। সেই সময়েই কিন্তু স্বামীজির আসন্ন শারীরিক বিপর্যয়ের আগাম ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে মহেন্দ্রনাথের স্মৃতিচারণে : “একদিন মধ্যাহ্ন ভোজনের পর স্বামীজি তাঁহার ঠেসান দেওয়া চেয়ারখানিতে বসিয়া ভাবিতেছিলেন অথবা ধ্যান করিতেছিলেন। ফক্স ও বর্তমান লেখক অপরদিকের দেওয়ালের নিকট পাশাপাশি দুইখানি চেয়ারে বসিয়াছিলেন। হঠাৎ যেন তাঁহার মুখে বড় কষ্টের ভাব দেখা গেল। খানিকক্ষণ পর তিনি নিশ্বাস ফেলিয়া ফক্সকে বলিলেন, “দেখ ফক্স, আমার প্রায় হার্ট ফেল করছিল। আমার বাবা এই রোগে মারা গেছেন। বুকটায় বড় যন্ত্রণা হচ্ছিল; এইটা আমাদের বংশের রোগ।”
এই সময়ে স্বামীজি যে কোনও ডাক্তারকে পরামর্শ করার সুযোগ পাননি তা বেশ স্পষ্ট। বিদেশে তখন পরের দয়ায় খাওয়া-থাকা, সেই সঙ্গে ঘাড়ে চেপেছে ভাই ও গুরুভাইদের দায়িত্ব।
এবার চলে আসা যাক কনিষ্ঠ ভ্রাতা ভূপেন্দ্রনাথ দত্তর স্মৃতিকথায়। স্থান কলকাতা, সময় শনিবার ৫ জুলাই, ১৯০২, ঠিকানা দিদিমার বাড়ি, ৭ রামতনু বসু লেন। ভিটেবাড়ি গৌরমোহন মুখার্জি স্ট্রিট থেকে সময়ে অসময়ে কারণে অকারণে বিতাড়িত হয়ে বিবেকানন্দ-জননী ভুবনেশ্বরী দেবী অসহায় পুত্রকন্যাদের নিয়ে পিতা-মাতার একমাত্র সন্তান হিসাবে রামতনু বসু লেনে আশ্রয় নিতেন। এই বাড়িতেই সন্ন্যাসী বিবেকানন্দ বিশ্ববিখ্যাত হওয়ার পরে মায়ের সঙ্গে দেখা করতে আসতেন। ভূপেন্দ্রনাথ স্পষ্ট ভাষায় বলে গিয়েছেন, গৌরমোহন মুখার্জি স্ট্রিটের বাড়িতে কেউ কখনও গৈরিক বেশ পরিহিত নরেন্দ্রনাথ দত্তকে দেখেনি।
ভূপেন্দ্রনাথ লিখছেন : ‘এক সকালে স্বামীজির সেবক ব্রহ্মচারী নাদু (হরেন) স্বামীজির মৃত্যু সংবাদ নিয়ে আসেন। আমি মাকে এবং দিদিমাকে এই শোকসংবাদ জানালাম। মা জানতে চাইলেন, হঠাৎ কী হল, আমি বললাম, “বাবার যা হয়েছিল। তারা শোকবিহ্বল হয়ে পড়লেন, পাড়ার একজন ভদ্রমহিলা এসে তাদের সান্ত্বনা দিতে লাগলেন।
স্বামীজির প্রথম ও শেষ হার্ট অ্যাটাকের মধ্যে আরও একটি সামান্য অ্যাটাকের অস্পষ্ট উল্লেখ সংগ্রহ করা গিয়েছে। স্বামী বিবেকানন্দ তখন কিংবদন্তি ফরাসি গায়িকা মাদাম এমা কালভের অতিথি হয়ে মিস ম্যাকলাউড-এর সঙ্গে মিশর দেশ ঘুরে বেড়াচ্ছেন। প্যারিস থেকে যাত্রা শুরু হয়েছিল ২৪ অক্টোবর ১৯০০। ভুবনবিদিত ওরিয়েন্ট এক্সপ্রেসে। মাদাম কালভে একবার প্রাণঘাতিণী হওয়ার চেষ্টা করেছিলেন, বিবেকানন্দর সান্নিধ্যে তিনি নবজীবন লাভ করেন, অতএব অতিথির আদর আপ্যায়নের কোনও ত্রুটি হওয়ার কথা নয়।