১৮৯৩ সালে রসিকলাল কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের অফিসিয়েটিং প্রফেসর। পরবর্তী পদ বর্ধমান এবং যথাসময়ে হুগলির সিভিল সার্জন।
কোনও এক সময়ে কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের অধ্যক্ষের পদ খালি হল। “উক্ত পদে তার দাবি সমধিক ছিল। কিন্তু তিনি বাঙালি বলে তাকে নিযুক্ত করা হল না; একজন জুনিয়র ইংরেজ কর্মচারীকে প্রিন্সিপ্যাল নিযুক্ত করায় তেজস্বী রসিকলাল দু’বছরের ফার্লো আবেদন করে চাকরি থেকে অকাল অবসর গ্রহণ করেন।”
স্বামীজি যে-বছর নানা অসুখে জর্জরিত (১৮৯৮) সেই বছরই রসিকলাল কলকাতায় স্বাধীনভাবে চেম্বার খুলে প্র্যাকটিশ আরম্ভ করে বিপুল সাফল্য অর্জন করেন।
এখন প্রশ্ন, স্বামীজিকে ডাক্তারের কোন চেম্বারে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করেছিলেন পরম বিশ্বস্ত স্বামী ব্রহ্মানন্দ? এই ব্যবস্থা পাকা করতেই তো স্বামী ব্রহ্মানন্দ ২৮ অক্টোবর ১৮৯৮ বেলুড় মঠ থেকে কলকাতায় গিয়েছিলেন। এর উত্তর কঠিন নয়–২ নম্বর সদর স্ট্রিট, ইন্ডিয়ান মিউজিয়মের উত্তরদিকের পথ। এই রাস্তায় একসময় ভাড়াটে ছিলেন রবীন্দ্রনাথের দাদা আই সি এস সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর, সেই বাড়িতে বসেই একদিন ভোরে কবি রবীন্দ্রনাথ ‘নিঝরের স্বপ্নভঙ্গ’ কবিতাটি লিখেছিলেন। সদর স্ট্রিটের ২ নম্বর বাড়িতে রসিকলাল যে বিশাল পসার জমিয়ে বসেছিলেন তার যথেষ্ট প্রমাণ রয়েছে। তবে স্বামীজির চেম্বারে আসার তারিখটা নিয়ে একটু গোলমাল রয়েছে। যুগনায়ক বিবেকানন্দ বইটির তৃতীয় খণ্ডের ১৫০ পাতায় স্বামী গম্ভীরানন্দ ২৭ অক্টোবর ১৮৯৮ উল্লেখ করছেন, অথচ একই পাতার ফুটনোটে স্বামী ব্রহ্মানন্দের নোট বইতে উল্লেখ, ২৮ অক্টোবর তিনি সব ব্যবস্থা পাকা করতে কলকাতায় ডাক্তার আর এল দত্তের কাছে গিয়েছিলেন।
স্বামী গম্ভীরানন্দ নোট বইকেই নির্ভর করা আমাদের পক্ষে যুক্তিযুক্ত হবে, এবং সেক্ষেত্রে রোগী দেখার তারিখ ২৯ অক্টোবর ১৮৯৮।
এখন বিবেকানন্দ-অনুরাগীদের কৌতূহল, সদর স্ট্রিটে স্বামীজির কী চিকিৎসা হয়েছিল? স্বামীজির চিকিৎসার কোনও প্রেসক্রিপশন কারও সংগ্রহে আছে বলে আমাদের জানা নেই। প্রেসক্রিপশন তো দূরের কথা তার ডেথ সার্টিফিকেটও আমাদের আয়ত্তের বাইরে।
ডাক্তার আর এল দত্তের সদর স্ট্রিটের চেম্বার সম্বন্ধে আমাদের খবরাখবর সীমাবদ্ধ। স্বামী ব্রহ্মানন্দের দিনলিপি থেকে আমরা জানি স্বামীজির ওষুধের খরচ লেগেছিল দশ টাকা। এবং স্বামী গম্ভীরানন্দ লিখেছেন, “তদানীন্তন সুপ্রসিদ্ধ ডাক্তার আর এল দত্তের নিকট তাহার বুক পরীক্ষা করানো হয়, কবিরাজদেরও সাহায্য লওয়া হয়। উক্ত ডাক্তারবাবু ও কবিরাজগণ সকলেই বলিয়া দেন, সাবধানে থাকা উচিত, নতুবা রোগ প্রবলাকার ধারণ করিতে পারে।”
ডাক্তার রসিকলাল দত্তর চিকিৎসা-বিশেষত্ব সম্বন্ধে আমরা যা জানতে পেরেছি তা এইরকম : “প্রাচ্য এবং পাশ্চাত্য চিকিৎসা-কৌশলের সমন্বয়ই তাকে চিকিৎসক-শিরোমণিরূপে পরিণত করেছিল এবং ওইটাই ছিল তার চিকিৎসার বিশেষত্ব। তিনি ভারতীয় চিকিৎসাশাস্ত্র প্রথমবার বিলাত যাওয়ার পূর্ব থেকে কিছু কিছু অধ্যয়ন করতেন।…ভারতবর্ষে ফিরে আসবার পর তিনি চরক, সুশ্রুত, বাদ্ভট প্রভৃতি চিকিৎসা গ্রন্থ পুনরায় অধ্যয়ন করে উভয় বিদ্যায় পারদর্শী হয়েছিলেন। বিশেষত ভারতীয় দ্রব্যগুণ তিনি বিশেষভাবে আয়ত্ত করেন। এইভাবে তিনি ক্রমে আয়ুর্বেদীয় পথ্যের অনুরাগী হন এবং রোগ-নির্ণয়েও ভারতীয় প্রথা অনেকাংশে অবলম্বন করেন।”
ডায়াবিটিস, হৃদরোগ ও নিদ্রাহীনতা রোগে জর্জরিত সন্ন্যাসী বিবেকানন্দ যে শেষপর্যন্ত বড় ডাক্তারের কড়ি জুগিয়েও তেমন কিছু শারীরিক সুফল পাননি তার ইঙ্গিত জীবনীকারদের রচনায় রয়েছে। স্বামীজির স্বাস্থ্যের আশানুরূপ উন্নতি হচ্ছে না দেখে শুভানুধ্যায়ীরা স্থির করলেন অন্যত্র বায়ুপরিবর্তন প্রয়োজন। সেইমতো ব্রহ্মচারী হরেন্দ্রনাথের সঙ্গে ১৯ ডিসেম্বর ১৮৯৮ স্বামীজি বৈদ্যনাথধাম যাত্রা করলেন। সেখানে কয়েক সপ্তাহ কাটিয়ে ২২ জানুয়ারি ১৮৯৯ তিনি কলকাতায় ফিরলেন। দেওঘরে তার শরীর এত খারাপ হয় যে টেলিগ্রাম পেয়ে স্বামী সারদানন্দ ও স্বামী সদানন্দ বেলুড় থেকে সেখানে ছুটে যান।
দেওঘরে প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায়ের বাড়িতে সময় সময় স্বামীজির এত শ্বাসকষ্ট হত যে মুখ-চোখ লাল হয়ে উঠত, সর্বাঙ্গে আক্ষেপ হতে এবং উপস্থিত সকলে মনে করতেন, বুঝিবা প্রাণবায়ু নির্গত হয়ে যাবে। স্বামীজি বলেছেন, এই সময় একটা উঁচু তাকিয়ার ওপর ভর দিয়ে বসে তিনি মৃত্যুর প্রতীক্ষা করতেন, ভিতর থেকে যেন নাদ উখিত হত–”সোহহং সোহহং”।
এই সময়ে শ্রীমতী ম্যাকলাউডকে স্বামীজির চিঠি (২ ফেব্রুয়ারি ১৮৯৯) : “বৈদ্যনাথে বায়ুপরিবর্তনে কোনও ফল হয়নি। সেখানে আট দিন আট রাত শ্বাসকষ্টে প্রাণ যায় যায়। মৃতকল্প অবস্থায় আমাকে কলকাতায় ফিরিয়ে আনা হয়। এখানে এসে বেঁচে উঠবার লড়াই শুরু করেছি। ডাক্তার সরকার এখন আমার চিকিৎসা করছেন।”
আমরা ২ সদর স্ট্রিটের প্রসঙ্গ এখনও শেষ করিনি। স্বামী ব্রহ্মানন্দের fraria on oma Giaco hooo : Paid to Dr. R. L. Dutt Rs 40/-… তারিখ ২৯ অক্টোবর ১৮৯৮। দরিদ্র সন্ন্যাসী চেম্বারে ডাক্তারের নগদ কড়ি দিচ্ছেন চল্লিশ টাকা উনিশ শতকের কলকাতায়! বিশ্বাস হতে চায় না! আজকের মূল্য মানে সেই চল্লিশ টাকা কত? চার হাজার, না আট হাজার, না বারো হাজার তা হিসেব করে লাভ কী? চিকিৎসার খরচের বোঝায় আমাদের প্রিয় মহামানব বিব্রত ও বিধ্বস্ত হয়েছিলেন সেকথা ভেবে এতদিন পর লাভ কি?