প্রতিবছর ডবল প্রমোশন পেয়ে ১৪ বছর বয়সে রসিকলাল সেকেন্ড ক্লাসে উঠলেন। “সেই বৎসর প্রবেশিকা পরীক্ষার মাত্র তিন মাস বাকি। প্রবেশিকা-ক্লাসে পরীক্ষা পাশ করার উপযুক্ত কোনও ছাত্র ছিল না। সেইজন্য হেডমাস্টার রসিকলালকে জিজ্ঞাসা করলেন যে, এই তিন মাসে প্রবেশিকা পরীক্ষায় উপস্থিত হবার মতো পড়া তৈরি করতে পারবে কিনা।” রসিকলাল রাজী হলেন এবং ১৮৫৯ সালে ১৪ বছর বয়সে প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলেন।
তখনকার দিনকাল অন্যরকম। একইসঙ্গে ভুবনবিদিত প্রেসিডেন্সি কলেজ ও মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি হওয়া সম্ভব ছিল। তখনও গঙ্গার ওপর ভাসমান সেতু তৈরি হয়নি, রসিকাল প্রত্যেকদিন নৌকোয় গঙ্গা পার হয়ে কলেজ করতেন। কিছুদিন পরে ডাক্তারির দিকে ঝুঁকে পড়ে তিনি প্রেসিডেন্সি কলেজ ছেড়ে দেন।
১৮৬২-৬৩ সালে রসিকলাল মেডিক্যাল কলেজের ডিপ্লোমা পাশ করেন এবং একই বছরে খিদিরপুরের গোলাপমোহিনী দেবীর সঙ্গে বিবাহিত হন।
মেডিক্যাল কলেজে পড়তে পড়তেই রসিকলাল ডাক্তারি প্র্যাকটিশ শুরু করেন। শোনা যায় ফিফথ ইয়ারে পড়বার সময়েই তার বিশাল পসার, মাসিক উপার্জন ৬০০ টাকা! “রোগী দেখিবার জন্য তিনি ১৬ জন পাল্কি-বেয়ারা নিযুক্ত করেন। প্রাইভেট প্র্যাকটিশে তিনি এমনই ব্যস্ত হয়ে পড়েন যে ডাক্তারির ফাঁইনাল পরীক্ষায় তিনি উপস্থিত হতে পারলেন না, “এবং কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাধি লাভ তাঁহার অদৃষ্টে ঘটে নাই।”
১৮৭০ সালে রসিকলালের জীবনে প্রবল আঘাত এল। হাওড়া শালকিয়ায় এক মহিলার জটিল চিকিৎসার ব্যাপারে হাসপাতালের বড় বড় ডাক্তাররা এসে ব্যর্থ হন। তখন রসিকলালকে ডাকা হয়। তাঁকে আসতে দেখে হাসপাতালের সার্জন বিরক্ত হন এবং মাতাল ও হাতুড়ে ডাক্তার বলে বিদ্রূপ করেন।
রোগিণীকে নিরাপদে প্রসব করিয়ে বাড়ি ফিরে অপমানিত রসিকলাল দত্ত শয্যাগ্রহণ করলেন। সার্জেনের বিদ্রুপের উত্তর দেওয়া প্রয়োজন, তিনি বিলেত গিয়ে ডাক্তার হতে চান। দাদা বৈকুণ্ঠনাথ দত্ত যতক্ষণ না অনুমতি দিচ্ছেন ততক্ষণ তিনি বিছানা ছেড়ে উঠবেন না। চতুর্থদিনে মায়ের অনুরোধে দাদা অনুমতি দিলেন, তবে জানিয়ে দিলেন বিলেতে যাবার এবং পড়াশোনার খরচপত্র তিনি বহন করতে পারবেন না।
ফ্লাইং ফোম নামে পালবাহী জাহাজে ডাক্তারের কাজ নিয়ে ১৮৭০ সালের মার্চ মাসে রসিকাল এদেশ থেকে ত্রিনিদাদ যাত্রা করলেন। এই জাহাজে ভারতবর্ষ থেকে পাঁচশো কুলি পাঠানো হয়েছিল।
সিংহল, বিষুবরেখা, মাদাগাস্কার অতিক্রম করে পালতোলা জাহাজ যখন আটলান্টিক মহাসাগরের দিকে চলল, তখন প্রবল ঝড় জাহাজকে ঠেলে ৪০০ মাইল দক্ষিণে নিয়ে গেল এবং ভীষণ বেগে একটা ভাসমান বরফ স্কুপের উপর নিক্ষেপ করল। ফ্লাইং ফোম সেই স্কুপে আটকে গেল।
“ওজন কমিয়ে জাহাজ রক্ষার জন্য কাপ্তেন ২০০ মণ চাল ও ডাল সমুদ্রে ফেলে দেবার নির্দেশ দিলেন। কিন্তু অনাহারের আশঙ্কায় কুলিরা গোলযোগ আরম্ভ করলো।”
জাহাজের ডাক্তার রসিকলাল অনেক চেষ্টায় অবস্থা সামাল দিয়ে, বিদ্রোহীদের “প্রিজন সেলে নিয়ে যান এবং তথায় আবদ্ধ করেন।”
দশদিন এই অবস্থায় থাকার পরে, একাদশ দিনে দূরে একটা বাষ্পীয় পোত দেখা গেল এবং এই জাহাজটি বিপন্ন পালতোলা জাহাজকে বরফ-স্কুপ থেকে মুক্ত করে, টানতে টানতে সেন্ট হেলেনা দ্বীপে পৌঁছে দিল। দুস্তর পারাবার পেরিয়ে যাত্রার চার মাস পরে ফ্লাইং ফোম জাহাজ ত্রিনিদাদ পৌঁছলো।
ফ্লাইং ফোম জাহাজের চাকরি ইস্তফা দিয়ে রসিকলাল যে ডাক জাহাজে এবার ইংল্যান্ডের উদ্দেশে যাত্রা করলেন সেটিও পাল ও দাঁড়বাহী। লন্ডনে এসেও নবাগত রসিকলাল নানা বিপদে পড়েন। নিরুপায় হয়ে শহরের ডিরেক্টরি দেখে লন্ডনের এক বাঙালি ডাক্তারকে (ক্ষেত্রমোহন দত্ত) তিনি তার করেন এবং ক্ষেত্রমোহন দয়াপরবশ হয়ে তাকে নিজের বাসায় নিয়ে যান। পরবর্তী পর্যায়ে লন্ডনে যাঁদের সঙ্গে রসিকলাল একটা বাসা ভাড়া করেন তাদের মধ্যে ছিলেন বিখ্যাত তারকনাথ পালিত, কিশোরীমোহন চট্টোপাধ্যায়, সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় ও গিরিশচন্দ্র মিত্র।
লন্ডন থেকে যথাসময়ে রসিকলাল যেসব ডাক্তারি পরীক্ষায় পাশ করেন তাদের মধ্যে রয়েছে এম বি, এম আর সি এস ও এম ডি। এই সময়ে আই এম এস পরীক্ষায় বসবার জন্যে চেষ্টা করেন। সঙ্গে গোপাল রায় ও ডাক্তার কে ডি ঘোষ। শেষের মানুষটি ঋষি রাজনারায়ণ …বসুর জামাই এবং শ্রীঅরবিন্দের বাবা খ্যাতনামা সিভিল সার্জেন কৃষ্ণধন
ঘোষ। এঁদের আবেদন, যতদিন না আই এম এস পরীক্ষায় বসতে দেওয়া হচ্ছে ততদিন, নেটুলে মিলিটারি ট্রেনিং স্কুলে তাদের সুযোগ দেওয়া হোক। কিন্তু ইন্ডিয়া অফিস এই দরখাস্ত না-মঞ্জুর করেন। হতাশ হয়ে রসিকলাল দেশে ফিরে আসেন ১৮৭১ সালে এবং ডিব্রুগড়ে মেডিকেল অফিসার নিযুক্ত হন। কাজে যোগ দেবার জন্যে রসিকলাল যখন প্রস্তুত হচ্ছেন সেই সময় লন্ডন থেকে নতুন খবর এল ফেব্রুয়ারি ১৮৭২ সালে। ৪০ জন বিদেশিকে আই এম এস পরীক্ষায় বসবার অনুমতি দেওয়া হবে।
পরীক্ষার মাত্র আটদিন আগে রসিকলাল আবার লন্ডনে হাজির হতে পারলেন। আই এম এস-এ সফল হয়ে, নেটুলে মিলিটারি ট্রেনিং স্কুলে প্রয়োজনীয় ট্রেনিং নিয়ে রসিকলাল লেফটেনান্ট পদ লাভ করলেন এবং ৫১ আইরিশ রেজিমেন্টে কাজ নিয়ে ১৮৭২ নভেম্বর মাসে বম্বেতে হাজির হলেন।