অবস্থা কতটা সঙ্গীন হলে সামান্য কয়েকটা টাকার জন্যে স্বামীজির মতন মানুষ এমন চিঠি লিখতে পারেন তা সহজেই অনুমান করা যায়।
অর্থের এমনই প্রয়োজন যে একই দিনে (১৭ সেপ্টেম্বর ১৮৯৮) তার আর্থিক পরিত্রাতা খেতড়ির মহারাজা অজিৎ সিংকে আর একটি চিঠি লেখেন। “এখানে আমি দু-সপ্তাহ খুবই অসুস্থ হয়ে পড়েছিলাম। এখন সুস্থ হয়ে উঠেছি। আমার কিছু টাকার টান পড়েছে। যদিও আমেরিকান বন্ধুরা আমাকে সাহায্যের জন্য তাদের সাধ্যমতো সবকিছুই করছেন, কিন্তু সবসময়ই তাদের কাছে হাত পাততে সঙ্কোচ হয়, বিশেষত অসুখ করলে খরচের বহর অনেক বেড়ে যায়। এই জগতে শুধু একজনের কাছেই আমার কিছু চাইতে লজ্জা হয় না, এবং তিনি হলেন আপনি। আপনি দিলেন কি না দিলেন–আমার কাছে দুই সমান। যদি সম্ভব হয়, অনুগ্রহ করে কিছু টাকা পাঠাবেন।”
বোঝা যাচ্ছে, এই পরিস্থিতিতে মহারাজের সঙ্গে টেলিগ্রামে কিছু সংবাদ চালাচালি হয়েছিল, মনে হয় তারে’ (টেলিগ্রাফিক মানি অর্ডার) কিছু অর্থ খেতড়ি থেকে শ্রীনগর পাঠানো হয়েছিল। ১৬ অক্টোবর ১৮৯৮ স্বামীজির চিঠি : “মহামান্য মহারাজ, আমার ‘তারের পরে যে চিঠিখানা গিয়েছে, তাতে আপনার অভিপ্রেত সংবাদ ছিল; সেজন্য আপনার তারের উত্তরে আমার স্বাস্থ্যের সংবাদ দিয়ে আর কোনও তার করিনি।”
একই দিনে লাহোর থেকে হরিপদ মিত্রকে লেখা চিঠিতে আবার অর্থের উল্লেখ। “কাশ্মীরে স্বাস্থ্য একেবারে ভাঙিয়া গিয়াছে এবং ৯ বৎসর যাবৎ দুর্গাপূজা দেখি নাই–এ বিধায় কলিকাতা চলিলাম। …৫০ টাকা আমার গুরুভ্রাতা সারদানন্দ লাহোর হইতে করাচি পাঠাইবেন।”
‘যুগনায়ক বিবেকানন্দ’ গ্রন্থে স্বামী গম্ভীরানন্দের মন্তব্য : “স্বামীজি তখন কপর্দকশূন্য ছিলেন–আমেরিকান মহিলাদের অর্থে তাহার ব্যয় নির্বাহ হইত, ভারত হইতে তিনি কিছুই পাইতেন না।”
লাহোর থেকে ১৬ অক্টোবর (১৮৯৮) স্বামী সদানন্দের সঙ্গে স্বামী বিবেকানন্দ কলকাতায় চললেন, বেলুড়ে নীলাম্বরবাবুর বাড়িতে পৌঁছলেন ১৮ অক্টোবর। তাঁর শরীরের অবস্থা দেখে মঠের মানুষদের চিন্তার অবধি নেই। :
এবার শরচ্চন্দ্র চক্রবর্তীর বিখ্যাত বই ‘স্বামী শিষ্য সংবাদে’ আসা যাক। স্থান-বেলুড়, ভাড়াটিয়া মঠ-বাটী। “কাল-নভেম্বর ১৮৯৮”, মনে হয় সময়টি ভুল, অক্টোবর হবে, কারণ পরিচ্ছেদের শুরু : “আজ দুই-তিনদিন হইল স্বামীজি কাশ্মীর হইতে প্রত্যাবর্তন করিয়াছেন।”
স্বামীজির শরীর তেমন ভালো নেই। “শিষ্য মঠে আসিতেই স্বামী ব্রহ্মানন্দ বলিলেন, কাশ্মীর থেকে ফিরে আসা অবধি স্বামীজি কারও সঙ্গে কোনও কথাবার্তা কন না, স্তব্ধ হয়ে বসে থাকেন। তুই স্বামীজির কাছে গল্পসল্প করে স্বামীজির মনটা নীচে আনতে চেষ্টা করিস।…শিষ্য স্বামীজির ঘরে গিয়া দেখিল, স্বামীজি মুক্ত-পদ্মাসনে পূর্বাস্য হইয়া বসিয়া আছেন…মুখে হাসি নাই। …স্বামীজির বামনেত্রের ভিতরটা রক্তবর্ণ দেখিয়া শিষ্য জিজ্ঞাসা করিল, “আপনার চোখের ভিতরটা লাল হয়েছে। কেন?’ ‘ও কিছু না বলিয়া স্বামীজি পুনরায় স্থির হইয়া বসিয়া রহিলেন।”
শিষ্য তামাক সাজিয়ে দিল। আস্তে আস্তে ধূমপান করতে করতে স্বামীজি বললেন, অমরনাথ যাবার কালে পাহাড়ের একটা খাড়া চড়াই ভেঙে উঠেছিলুম। যে রাস্তায় যাত্রীরা কেউ যায় না…আমার কেমন রোক হ’ল, ওই পথেই যাব। যাব তো যাবই। সেই পরিশ্রমে শরীর একটু দমে গেছে।
শিষ্য। শুনেছি, উলঙ্গ হয়ে অমরনাথকে দর্শন করতে হয়। কথাটা কি সত্য?
স্বামীজি। হাঁ, আমিও কৌপীনমাত্র পরে ভস্ম মেখে গুহায় প্রবেশ করেছিলাম।”
বেলুড়ে ফেরার পরে স্বামীজির চিকিৎসার জন্য কলকাতার সেরা ডাক্তারের খোঁজখবর পড়ে যায়। সবারই ধারণা বিশ্ববন্দিত বিবেকানন্দকে কোন্ ডাক্তারই না, বিশেষ করে বাঙালি ডাক্তার চিকিৎসা করতে আগ্রহী হবেন?
ডাক্তার-সন্ধানে প্রধান ভূমিকায় স্বামী ব্রহ্মানন্দ। তার দিনলিপিতে ছোট্ট একটি নোটিং : ২৮ অক্টোবর ১৮৯৮ তিনি কলকাতায় যান ডাক্তার আর এল দত্তর সঙ্গে কথাবার্তা পাকা করতে।
এই ডাক্তার দত্ত সম্বন্ধে দীর্ঘদিন ধরে অনেকের কৌতূহল। এঁর সম্বন্ধে যতটুকু তথ্য সংগ্রহ করতে পেরেছি তার প্রধান সূত্র মহানগরীর– সুবৰ্ণবণিক সমাজ। উনিশ শতকের শেষপ্রান্তে ডাঃ দত্তর খ্যাতি ভারতজোড়া। পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন লেখকের স্মৃতিকথায় তার কাছে চিকিৎসা করানোর বিবরণও নজরে এসেছে। আরও যা আকর্ষণীয়, তার পারিবারিক বাড়ি পঞ্চাননতলা হাওড়ায় যেখানকার চৌধুরীবাগানে এই প্রতিবেদকের বহুবছর কেটেছে।
ইদানীং এই খ্যাতনামা চিকিৎসক সম্বন্ধে যা জানতে পেরেছি তার কিছুটা অংশ কৌতূহলী পাঠক-পাঠিকাদের কাছে নিবেদন করতে চাই। আমাদের এই খবরের প্রধান উৎস সুবর্ণবণিক কথা ও কীর্তি।
রসিকলাল দত্ত কলকাতায় লেফটেনান্ট কর্নেল আর এল দত্ত নামে পরিচিত ছিলেন। গুরুচরণ দত্ত ও দিগম্বরী দত্তর তিনি চতুর্থ পুত্র, জন্ম ২০ আগস্ট ১৮৪৫। তার যখন একবছর বয়স তখন পিতৃদেব হাওড়ায় চলে আসেন। দত্তদের আদিবাড়ি স্বামী প্রেমানন্দের পৈতৃক বাড়ি আটপুরে, যেখানে স্বামীজির অনেক স্মৃতি ছড়িয়ে আছে।
রসিকলাল দত্তের ব্যক্তিজীবন এমনই নাটকীয় যে তার সামান্য ইতিবৃত্ত এখানে লিপিবদ্ধ করার অপরাধ মার্জনীয়। প্রথমে পাঠশালা, পরে এগারো বছর বয়স পর্যন্ত রেভারেন্ড গোপাল মিত্রর অ্যাংলো ভার্নাকুলার স্কুলে অধ্যয়ন। তারপর হাওড়া জেলা ইস্কুল।