এই চিঠি লেখার তিন সপ্তাহ পরে স্বামীজির ঠিকানা আলমোড়া। ২০ মে ১৮৯৭ অভিন্নহৃদয় স্বামী ব্রহ্মানন্দকে তিনি স্বাস্থ্যের রিপোর্ট দিচ্ছেন : “আরও ঠান্ডা দেশে যাবার যোগাড় দেখছি। গরমি বা পথশ্রম হলেই দেখছি লিভারের গোল দাঁড়ায়। এখানে হাওয়া এত শুষ্ক যে দিনরাত নাক জ্বালা করছে এবং জিব যেন কাঠের চোকলা।…তুমিও-সব মুখ-ফুর্খদের কথা কি শোন? যেমন তুমি আমাকে কলায়ের দাল খেতে দিতে না–স্টার্চ বলে!! আবার কি খবর-না, ভাত আর রুটি ভেজে খেলে আর স্টার্চ থাকে না!!! অদ্ভুত বিদ্যে বাবা!! আসল কথা আমার পুরোনো ধাত আসছেন। …রাত্রির খাওয়াটা মনে করেছি খুব ‘লাইট’ করব; সকালে আর দুপুরবেলা খুব খাব, রাত্রে দুধ, ফল ইত্যাদি। তাই তো ওৎ করে ফলের বাগানে পড়ে আছি, হে কর্তা!!”
দু সপ্তাহ পরে (৩ জুন ১৮৯৭) যা স্বাস্থ্যের খবর পাওয়া যাচ্ছে তা তেমন ভালো নয়। “আমার দেহ নানাপ্রকার রোগে বারবার আক্রান্ত হচ্ছে এবং ‘ফিনিক্স পাখির মতন আমি আবার বারবার আরোগ্য লাভও করছি। …সব বিষয়েই আমি চরমপন্থী–এমনকী আমার স্বাস্থ্য সম্পর্কেও তাই; হয় আমি লৌহদৃঢ় বৃষের মতো অদম্য বলশালী, নতুবা একেবারে ভগ্নদেহ.. যদি শেষ পর্যন্ত আমার স্বাস্থ্য ভেঙেই পড়ে, তা হলে এখানে কাজ একদম বন্ধ করে দিয়ে আমি আমেরিকায় চলে যাব। তখন আমাকে আহার ও আশ্রয় দিতে হবে–কেমন পারবে তো?”
আরও সতেরো দিন পরে স্বামীজির অদম্য উৎসাহ। প্রিয় ব্রহ্মানন্দকে আলমোড়া থেকে লিখছেন (২০ জুন ১৮৯৭) : “আমি সেরেসুরে গেছি। শরীরে জোরও খুব; তৃষ্ণা নাই, আর রাত্রে উঠিয়া প্রস্রাব বন্ধ, …কোমরে বেদনা-ফেদনা নাই, লিভারও ভালো।”
পরবর্তী রিপোর্টের তারিখ ১৩ জুলাই ১৮৯৭। দেউলধার আলমোড়া থেকে প্রেমাস্পদ স্বামী ব্রহ্মানন্দকে চিঠি : “পেটটা বিষম ফুলিতেছে; উঠতে বসতে হাঁপ ধরে,…পূর্বে আমার দুইবার ‘সান-স্ট্রোক হয়। সেই অবধি রৌদ্র লাগিলেই চোখ লাল হয়, দুই-তিন-দিন শরীর খারাপ যায়।” এই সময়ের আরেকটি উল্লেখযোগ্য খবর : “ স্যাকারিন ও ‘লাইম’ এসেছে।”
আশা-নিরাশার দোলায় নিরন্তর দুলে চলেছেন আমাদের অনন্তবিস্ময় স্বামী বিবেকানন্দ। বেলুড় মঠ থেকে ১৯ আগস্ট ১৮৯৭ মিসেস ওলি বুলকে তিনি নিজের হাতে লিখছেন, “আমার শরীর বিশেষ ভালো যাচ্ছে না…আগামী শীতের আগে পূর্বশক্তি ফিরে পাবো বলে বোধ হয় না।”
পরের মাসে (৩০ সেপ্টেম্বর ১৮৯৭) শ্রীনগর কাশ্মীর থেকে স্বামী ব্রহ্মানন্দকে বিস্ময়কর সংবাদ :”সাধারণ স্বাস্থ্য খুব ভালো ও ডায়াবেটিস অনেকদিন ভাগলওয়া হয়েছেন–আর কোনও ভয় করব না।” ডায়াবিটিস যে দুরারোগ্য, একবার হলে সারাজীবন যে কেবলমাত্র তাকে আয়ত্তে রাখবার চেষ্টা চলতে পারে সেখবর তখনও বোধহয় সাধারণের কাছে অজ্ঞাত।
এই রোগ সম্বন্ধে আরও আলোকপাত করছেন স্বামীজি নিজেই বেলুড়মঠ হাওড়া থেকে ২ মার্চ ১৮৯৮। লিখছেন মার্কিন মুলুকে স্নেহের মিস মেরী হেলকে : “লন্ডন থেকে ফিরে এসে যখন আমি দক্ষিণ ভারতে এবং যখন লোকেরা আমাকে উৎসবে ভোজে আপ্যায়িত করছে এবং আমার কাছ থেকে ষোল আনা কাজ আদায় করে নিচ্ছে, এমন সময় একটি বংশগত পুরোনো রোগ এসে দেখা দিল। রোগের প্রবণতা (সম্ভাবনা) সব সময়ই ছিল, এখন অত্যধিক মানসিক পরিশ্রমে তা আত্মপ্রকাশ করল। সঙ্গে সঙ্গে শরীরে এল সম্পূর্ণ ভাঙন ও চূড়ান্ত অবসাদ।”
কিন্তু নিরাশ হতে প্রস্তুত নন আমাদের রোগজর্জরিত নায়ক। “তুমি আমার জন্য উদ্বিগ্ন হয়ো না, কারণ রোগটা আরও দুই তিন বছর আমাকে টেনে নিয়ে যাবে। বড়জোর নির্দোষ সঙ্গীর মতো থেকে যেতে পারে। আমার কোন খেদ নেই।…বহুদিন আগে যেদিন জীবনকে বিসর্জন দিয়েছি, সেইদিনই আমি মৃত্যুকে জয় করেছি।”
ডায়াবিটিস ছাড়াও অন্য কয়েকটি রোগের নিগ্রহ শুরু হয়েছে ইতিমধ্যে। ২৮ আগস্ট ১৮৯৮ শ্রীনগর, কাশ্মীর থেকে আমেরিকায় স্নেহের মেরী হেলকে স্বামীজি খবর দিচ্ছেন, “আমি খুশি যে, দিন-দিন আমার চুল পাকছে। তোমার সঙ্গে পরবর্তী সাক্ষাতের পূর্বেই আমার মাথাটি পূর্ণ-বিকশিত একটি শ্বেতপদ্মের মতো হবে।”
রসিকতা করে স্বামীজি পরিস্থিতি যতই হালকা করুন, কাশ্মীরে তিনি যে গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন তা কারও অজানা নয়। যা তেমন জানা নয়, চিকিৎসার খরচে বিব্রত কপর্দকশূন্য সন্ন্যাসীর মনোবেদনা। বিব্রত সন্ন্যাসী এই অবস্থায় দুখানি চিঠি লিখেছিলেন দুঃখদিনের দুই বন্ধুকে। দুটি চিঠিরই তারিখ ১৭ সেপ্টেম্বর ১৮৯৮।
স্নেহের হরিপদ মিত্রকে লিখছেন : “মধ্যে আমার শরীর অত্যন্ত অসুস্থ হইয়া পড়ায় কিঞ্চিৎ দেরি হইয়া পড়িল, নতুবা এই সপ্তাহের মধ্যেই পাঞ্জাবে যাইবার কল্পনা ছিল। …আমার সঙ্গে এবার কেহ নাই। দু’জন আমেরিকান লেডি ফ্রেন্ড মাত্র আছেন। ..আমার এখানকার সমস্ত খরচপত্র উক্ত আমেরিকান বন্ধুরা দেন এবং করাচি পর্যন্ত ভাড়া প্রভৃতি তাহাদের নিকট হইতেই লইব। তবে যদি তোমার সুবিধা হয়, ৫০ টাকা টেলিগ্রাম করিয়া C/o ঋষিবর মুখোপাধ্যায়, চিফ জজ, কাশ্মীর স্টেট, শ্রীনগর–এঁর নামে পাঠাইলে অনেক উপকার হইবে। কারণ সম্প্রতি ব্যারামে পড়িয়া বাজে খরচ কিছু হইয়াছে এবং সর্বদা বিদেশী শিষ্যদের নিকট টাকা ভিক্ষা করিতে লজ্জা করে।”