ডাক্তার আর এল দত্ত সম্পর্কেও কিছু বৃত্তান্ত হাতে পাওয়া গেল। ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের ভাগ্য কিছুটা ভালো, তার এক সায়েব চিকিৎসক রোগী দেখার পরে হাতে নগদ টাকা পাওয়া সত্ত্বেও তা সবিনয়ে ফিরিয়ে দিয়েছিলেন পথ্য কেনবার জন্য। আর একজন ডাক্তার অর্থ তো নেনইনি, বরং তাঁর দেহাবসানের পরে ডেথ সার্টিফিকেট দিয়ে, পকেট থেকে দশ টাকা বার করে দিয়ে ভক্তদের পরামর্শ দিয়েছিলেন বেঙ্গল ফটোগ্রাফারসকে ডেকে গ্রুপ ফটো তোলাতে। আরেকজন বিখ্যাত ডাক্তার খালি হাতে রোগীর কাছে যেতেন না, এক সময়ে নরেনের চিকিৎসা করতে এসেও রোগীকে তিনি একটি বেল উপহার দিয়েছিলেন। এই ডাক্তারের কাছ থেকেই শ্রীরামকৃষ্ণ সানন্দে একজোড়া চটি উপহার নিয়েছিলেন। যদিও উকিল ও ডাক্তারদের সম্বন্ধে তার মতামত তেমন ভালো ছিল না।
পরবর্তী পর্যায়ে ঠাকুরের ত্যাগী সন্তানদের একজন প্রিয় চিকিৎসক ছিলেন শশী ডাক্তার। পুরো নাম ডাক্তার শশীভূষণ ঘোষ। রোগী বিবেকানন্দ এঁকে কয়েকটি অন্তরঙ্গ চিঠি লিখেছিলেন। তার একটিতে বিশ্বজয়ী সন্ন্যাসী আত্মপক্ষ সমর্থনে ব্যাকুল! কারণ ডাক্তারের কাছে এক গুরুভাই তার সম্বন্ধে রিপোর্ট দিয়েছেন–ডায়াবিটিক বিবেকানন্দ মিষ্টি খাচ্ছেন নিষেধ সত্ত্বেও।
২৯ মে ১৮৯৭ আলমোড়া থেকে শশী ডাক্তারকে স্বামী বিবেকানন্দের করুণ চিঠি : “যোগেন কি লিখছে তা হৃক্ষেপ করবে না। সে নিজেও যেমন ভয়-তরাসে, অন্যকেও তাই করতে চায়। আমি লখনৌ-এ একটি বরফির ষোলভাগের একভাগ খেয়েছিলাম, আর যোগেনের মতে ওই হচ্ছে আমার আলমোড়ার অসুখের কারণ।”
ডায়াবিটিস যে দত্তদের পারিবারিক ব্যাধি তার ইঙ্গিত রয়েছে কলকাতা কর্পোরেশন ডেথ রেজিস্টারে পিতৃদেব বিশ্বনাথ দত্তের অকালমৃত্যুর কারণ সম্পর্কে একটি মন্তব্যে। রোগটি বহুমূত্র।
মার্কিন মুলুকে বড় বড় ডাক্তারদের সান্নিধ্যে এলেও সেখানে স্বামীজির ডায়াবিটিস ধরা পড়েনি। প্রথম প্রবাস সম্পন্ন করে প্রিন্স রিজেন্ট লিওপোল্ট জাহাজে নেপক্স থেকে স্বামীজি কলম্বোতে এলেন ১৫ জানুয়ারি ১৮৯৭। এই সময় (২৫ ফেব্রুয়ারি ১৮৯৭) তিনি লিখছেন, “আমি এখন মৃতপ্রায়…আমি ক্লান্ত–এতই ক্লান্ত যে যদি বিশ্রাম না পাই, তবে আর ছ’মাসও বাঁচব কিনা সন্দেহ।”
স্বামীজির সন্ন্যাসী শিষ্য কৃষ্ণলাল মহারাজের স্মৃতিচিত্র থেকে জানা যাচ্ছে, কলম্বোর ডাক্তাররাই স্বামীজির ডায়াবিটিস ধরেন এবং সেই অনুযায়ী চিকিৎসার পরামর্শ দেন। বলাবাহুল্য সেই সময়ে ডায়াবিটিস চিকিৎসা পদ্ধতির তেমন উন্নতি হয়নি এবং প্রাণদায়িনী ইনসুলিন তখনও অধরা।
ভগ্নস্বাস্থ্য স্বামীজির শরীর সম্পর্কে নানা বর্ণনা রয়েছে তার নিজের চিঠিতেই। তার মধ্যে মৃত্যুচিন্তাও এসে গিয়েছে। কলকাতার আলমবাজার মঠ থেকে আমেরিকায় মাতৃসমা মিসেস সারা বুলকে তিনি লিখছেন (২৫ ফেব্রুয়ারি ১৮৯৭), “যদি টাকা তোলবার আগেই আমার মৃত্যু হয়, তবে আপনি ওই টাকার সবটা তুলে আমার অভিপ্রায় অনুসারে খরচ করতে পারবেন। তা হলে আমার মৃত্যুর পর আমার বন্ধুবান্ধবদের কেউ আর ওই টাকা নিয়ে গোলমাল করতে পারবে না।”
এরপরে স্বাস্থ্যসন্ধানে স্বামীজির দার্জিলিং যাত্রা-২৬শে মার্চ ১৮৯৭। সেখান থেকে আর এক পত্রে মিসেস বুলকে তিনি তাঁর শরীর সম্পর্কে কিছু পারিবারিক খবরাখবর দিয়েছেন : “পশ্চিমে একটানা খাটুনি ও ভারতে একমাস প্রচণ্ড পরিশ্রমের পরিণাম বাঙালির ধাতে–বহুমূত্র রোগ। এ একটি বংশগত শত্রু এবং বড়জোর কয়েক বছরের মধ্যে এই রোগে আমার দেহাবসান পূর্বনির্দিষ্ট। শুধু মাংস খাওয়া, জল একেবারে না খাওয়া এবং সর্বোপরি, মস্তিষ্কের সম্পূর্ণ বিশ্রামই বোধ হয়, জীবনের মেয়াদ বাড়াবার একমাত্র উপায়।”
আর এক চিঠির তারিখ ২৬ মার্চ ১৮৯৭। অর্থ-প্রসঙ্গে কলকাতাবাসীদের বিচিত্র ব্যবহার এই সময়ে স্বামীজির মানসিক দুঃখের কারণ হয়েছিল। তার ইঙ্গিত রয়েছে, ভারতী সম্পাদিকা, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আত্মীয়া সরলা ঘোষালকে দার্জিলিং থেকে লেখা আর একটা চিঠিতে–তারিখ ৬ এপ্রিল ১৮৯৭। ব্যাপারটা বিশ্বাস হতে চায় না, কিন্তু স্বয়ং বিবেকানন্দ মনের দুঃখে নিজের কথা লিখে গিয়েছেন। কলকাতায় তাঁকে যে বিশেষ অভ্যর্থনা দেওয়া হয়েছিল, যথাসময়ে তার খরচের একটি বিল সংগঠকরা তাঁকেই ধরিয়ে দিয়েছিলেন। আমাকে অভ্যর্থনা করিবার ব্যয়নির্বাহের জন্য কলকাতাবাসীরা টিকিট বিক্রয় করিয়া লেকচার দেওয়াইলেন এবং তাহাতেও সঙ্কুলান না হওয়ায় ৩০০ টাকার এক বিল আমার নিকট প্রেরণ করেন!!!” উদারহৃদয় সন্ন্যাসী অবশ্যই বিস্মিত, কিন্তু লিখছেন, “ইহাতে কাহারও দোষ দিতেছি না বা কুসমালোচনাও করিতেছি না; কিন্তু পাশ্চাত্য অর্থবল ও লোকবল না হইলে যে আমাদের কল্যাণ অসম্ভব, ইহাই পোষণ করিতেছি।”
দার্জিলিং থেকে লেখা আরও কয়েকটি চিঠি থেকে স্বামীজির স্বাস্থ্য সম্পর্কে আরও কিছু খবর পাওয়া যাচ্ছে। কোথাও ডায়াবিটিসের উল্লেখ, কোথাও ডাক্তারদের পরামর্শে খেতড়ির রাজা অজিত সিং-এর সঙ্গে বিদেশে যাওয়ার সুযোগ ছেড়ে দেওয়ার খবর, আবার কোথাও দেহ বর্ণনা যা দুশ্চিন্তার উদ্রেক করে। মিস মেরী হেলকে (২৮ এপ্রিল ১৮৯৭) দার্জিলিং থেকে স্বামীজি লিখছেন, “আমার চুল গোছগোছ পাকতে আরম্ভ করেছে এবং আমার মুখের চামড়া অনেক কুঁচকে গেছে–দেহের এই মাংস কমে যাওয়াতে আমার বয়স যেন আরও কুড়ি বছর বেড়ে গিয়েছে। এখন আমি দিন দিন ভয়ঙ্কর রোগা হয়ে যাচ্ছি, তার কারণ আমাকে শুধু মাংস খেয়ে থাকতে হচ্ছে–রুটি নেই, ভাত নেই, আলু নেই, এমনকী আমার কফিতে একটু চিনিও নেই!! …আমি এখন মস্ত দাড়ি রাখছি; আর তা পেকে সাদা হতে আরম্ভ করেছে…হে সাদা দাড়ি, তুমি কত জিনিসই না ঢেকে রাখতে পারো! তোমারই জয় জয়কার।”