জীবনের শেষ পনেরো বছর কল্যাণানন্দ বিভিন্ন ব্যাধির শিকার হয়েছেন, কিন্তু তাই বলে থেমে যাওয়া নয়, প্রতিকূল পরিস্থিতির কাছে আত্মসমর্পণ অবশ্যই নয়। স্বয়ং স্বামী বিবেকানন্দ সন্ন্যাস-লক্ষণকে চিহ্নিত, করে গিয়েছেন। তার অনুগত শিষ্যরা জানেন, সন্ন্যাসের অর্থ মৃত্যুকে ভালবাসা। “সংসারী জীবনকে ভালবাসবে, সন্ন্যাসী মৃত্যুকে ভালবাসবে, আমাদের অঙ্গের গৈরিকবাস তো যুদ্ধক্ষেত্রের মৃত্যুশয্যা।”
তবু গুরুর নির্দেশে মৃত্যুকে জয় করবার কি বিরামহীন ব্রত। সেবা দিয়ে, শুশ্রূষা দিয়ে মৃত্যুর কাঠিন্যকে যথাসাধ্য কোমল কর মানুষের জন্য। কল্যাণানন্দ তাই নিজের শরীরের জন্য মাথাব্যথা করতে রাজি নন। প্রতি মুহূর্তের রণক্ষেত্রে তিনি সেনানায়কের যে দায়িত্ব স্বেচ্ছায় গ্রহণ করেছেন সেখানে ছুটি নেই, অবসর নেই, পদত্যাগও নেই।
১৯৩৭। চিকিৎসকদের পরামর্শে কল্যাণানন্দকে মুসৌরি যেতে হলো, শেষবার যাত্রার সময় মহারাজ তার আয়রন সেফের চাবি এক তরুণ সন্ন্যাসীর হাতে দিয়ে বললেন, আমার অনুপস্থিতিতে সব যেন ঠিক ভাবে চলে। ২৫শে অক্টোবর মুসৌরি থেকে তিনি সেবক সর্বগতানন্দকে লিখলেন, একটা হওয়াটার বটল ও কিছু ওষুধ নিয়ে এখানে এসো।
ইতিমধ্যে একদিন বিকেলে তাঁর শরীরে অসহ্য জ্বালা দেখা গেল। স্মিতহাস্যে সন্ন্যাসী বললেন, “ডাক্তার কী আর হবে? আই অ্যাম ডায়িং, আই অ্যাম ডায়িং।” গভীর রাতে অতিশয় স্পষ্টভাবে তিনবার ‘মা’ নাম উচ্চারণ করতে করতে বিবেকানন্দের প্রিয় শিষ্য, চির-অনুগত স্বামী কল্যাণানন্দ মহাসমাধিতে মগ্ন হলেন।
কনখলে যথোচিত মর্যাদা সহকারে তাকে জাহ্নবীগর্ভে সমাহিত করা হয়।
মৃত্যু তার ছোবল না দিলেও সময় কারও জন্যে অপেক্ষা করে থাকে না। কপর্দকশূন্য অবস্থায় অজানা দেশের দুর্গম পথ ধরে হাঁটতে-হাঁটতে গুরুর নির্দেশে প্রবাসে এসে ভিক্ষাবৃত্তি অবলম্বন করে বিবেকানন্দ মন্ত্রে মুগ্ধ শিষ্য যে প্রতিষ্ঠান তৈরি করেছিলেন তা আজও বেঁচে রয়েছে। যথাসময়ে কনখল সেবাশ্রমের বিপুল বিস্তৃতি ঘটেছে, বহু রোগী আজও সেখানে সেবিত হচ্ছেন। সেবাশ্রমের পথ ধরে হাঁটতে-হাঁটতে কোনো পাঠকের যদি কখনও বহুযুগ আগের এক বরিশাল যুবকের অবিশ্বাস্য সাধনার কথা মনে পড়ে যায় তা হলে আশ্চর্য হওয়ায় কিছু থাকে না। যদি প্রশ্ন জাগে, গুরুর কোন্ লোকাতীত শক্তিতে এই আমৃত্যু সাধনা সম্ভব হলো, তা হলে স্মরণ করা যেতে পারে ক্ষণজন্মা সেই সন্ন্যাসীটির কথা যিনি অকালপ্রয়াণের আগে তাঁর প্রিয় শিষ্যকে দূরদেশে গিয়ে রোগীর সেবা করতে নির্দেশ দিয়েছিলেন এবং সেই সঙ্গে অগস্তযাত্রার বিধিনিষেধ এঁটে দিয়ে বলেছিলেন, কিন্তু আর ফিরবি না। অনুগত শিষ্য সেই কথা রেখেছে, গুরুর নির্দেশ মান্য করে সে আর জন্মভূমিতে ফেরেনি।
যারা ফেরে না তাদের কথাও মাঝে মাঝে স্মৃতির পটে ফিরে আসে। জিজ্ঞাসা করতে ইচ্ছে হয়, স্বামীজির কোন্ অলৌকিক শক্তিতে যেমন গুরু তেমন-শিষ্য কথাটি আজও এই পৃথিবীতে এমনভাবে ধ্রুবসত্য হয়ে রইল?
১১. চিকিৎসকের চেম্বারে চল্লিশ টাকা
বিদেশে বসবাসকালে স্বামীজি যে কয়েকশো চিঠি লিখেছিলেন তার কোথাও-কোথাও আমরা কয়েকজন সহৃদয় ডাক্তারের খবর পাচ্ছি যারা শুধু বিনামূল্যে সহায়সম্বলহীন সন্ন্যাসীর চিকিৎসা করেছিলেন তা নয়, প্রয়োজনে তারা স্বামীজিকে স্বগৃহে আশ্রয় দিয়েছিলেন। এই সুযোগে আমরা তাদের গভীর কৃতজ্ঞতা জানাই এবং লজ্জা প্রকাশ করি এই কারণে যে পাশ্চাত্যবাসীর কাঞ্চনপ্রীতি প্রাচ্যদেশ অপেক্ষা অনেক বেশি–এই গুজবটি আজও যথেষ্ট পরিমাণে ছড়ানো হয়ে থাকে।
অপরিচিত দেশে অপরিচিত চিকিৎসক বিনা পারিশ্রমিকে বিদেশির চিকিৎসা করতে উৎসাহী নাও হতে পারেন, কিন্তু নিজের জন্মনগরী খোদ কলকাতায় বিশ্ববন্দিত বিবেকানন্দ খ্যাতনামাদের কাছে কী আচরণ পেয়েছিলেন তার এক অস্বস্তিকর ইঙ্গিত এতদিন লুকিয়েছিল স্বামীজির গুরুভাই, রামকৃষ্ণ মঠ মিশনের প্রথম সভাপতি স্বামী ব্রহ্মানন্দের নোটবুকে। স্বামী ব্রহ্মানন্দ মঠ মিশনের খরচাপাতির নানা বিবরণ তার এই বইতে নিয়মিত টুকে রাখতেন। বহুযুগ পরে সেই দিনলিপির ছোট্ট একটি উদ্ধৃতি টীকাকারদের দৃষ্টি আকর্ষণ করবে তা হয়তো তার কল্পনার বাইরে ছিল।
সময় অক্টোবর ১৮৯৮। ইংরিজি ভাষায় দিনলিপিতে উল্লেখ : “October 28, 1898. (1) Gone to Calcutta to settle Dr. R. L. Dutt to see Swamiji. October 29, 1898 : Paid to Dr. R. L Dutt Rs. 40/-. Paid for medicines and other expenses Rs. 10/-.”
উনিশ শতকের শেষপ্রান্তে নগর কলকাতার উকিল, ব্যারিস্টার ও ডাক্তারদের অনেকের ভারতজোড়া খ্যাতি। দেশের সমস্ত প্রান্ত থেকে মক্কেল ও রোগীরা তাদের কাছে ছুটে আসতেন। কিন্তু তাদের পারিশ্রমিকের পরিমাণ যে হিমালয় সদৃশ হতে পারে তা যেন বিশ্বাস হতে চায় না।
অসুস্থ স্বামীজির জন্য ডাক্তারের এই ফি কি মঠে গিয়ে রোগী দেখার জন্য? না চেম্বারেই এই ৪০ টাকা দেয়? আজকের হিসেবে এই চল্লিশ টাকাটা কত? একশো না, দুশো নয়, তিনশ দিয়ে গুণ করলে কি কাছাকাছি একটা অঙ্কে পৌঁছনো যাবে?
স্বামীজির জীবনকালের শেষপর্বে চিকিৎসাখরচ যে কোথায় উঠতে পারে এবং আমাদের এই বাংলার একজন সন্ন্যাসীর সঙ্গে কেউ কেউ কেমন আর্থিক ব্যবহার করেছিলেন তার খোঁজখবর করাটা বোধহয় তেমন অন্যায় হবে না।