শুভানন্দ হেঁটে চলেছেন হরিদ্বারের পথ ধরে। হঠাৎ তিনি গতিপরিবর্তন করে গঙ্গার স্নানের ঘাটের দিকে চলতে লাগলেন। ঘাটের সিঁড়িতে তিনি কিছুক্ষণ বসলেন। তারপর গায়ের চাদর ও পায়ের চটি খুলে ফেলে স্রোতের মধ্যে গিয়ে পড়লেন হাত জোড় করে। একবার তিনি কোমর পর্যন্ত জলে চলে গেলেন, আবার একটু উপরে উঠলেন। এইরকম কয়েকবার করলেন তিনি।
চৈতন্যানন্দ জিজ্ঞেস করলেন, “আপনি কি এখানে স্নান করবেন?”
স্বামী শুভানন্দ উত্তর দিলেন, “না।”
চৈতন্যানন্দ জানেন প্রতিদিন স্নানের আগে তিনি শরীরে তেল মাখেন। আজ তো তা সম্ভব নয়, তিনি ইতিমধ্যেই জলে নেমে পড়েছেন। তার ধারণা হলো শুভানন্দ অবশ্যই স্নান করবেন। তারপর একটা শুকনো কাপড়ের দরকার হবে। সুতরাং উনি যতক্ষণ স্নান করছেন ততক্ষণে আশ্রম থেকে একটা কাপড় নিয়ে আসাই ভাল। দ্রুতপায়ে তিনি সেবাশ্রম মুখো হলেন।
একটু পরেই চৈতন্যানন্দ ফিরে এসে আঁতকে উঠলেন। স্বামী শুভানন্দ সেখানে নেই। তার স্যান্ডাল রয়েছে, চাদর রয়েছে, কিন্তু তিনি নেই। কয়েকবার হাঁক দিয়ে ডাকলেন তিনি কিন্তু কোথাও থেকে কোনো উত্তর এলো না। হঠাৎ মনে পড়ল শুভানন্দ সাঁতার কাটতে জানেন না।
স্রোতের নিশানা ধরে পাগলের মত ছুটছেন চৈতন্যানন্দ। কোথায় তিনি। একসময় গঙ্গা ও খাল যেখানে মিশেছে সেখানে যাঁরা স্নান করেছিলেন তাদের জিজ্ঞেস করলেন, কোনো সাধুকে স্রোতে ভেসে যেতে দেখেছেন?
তারা সঙ্গে সঙ্গে বললেন, হ্যাঁ একজন বাঙালি সাধু ভেসে যাচ্ছিলেন। আমরা তাকে উদ্ধার করে দেখলাম, এখনও বেঁচে আছেন। তাকে বাঙালি হাসপাতালে পাঠিয়ে দিয়েছি। চারজন সাধু তাঁকে বয়ে নিয়ে গিয়েছে। সেবাশ্রমে ফিরে গিয়ে চৈতন্যানন্দ দেখলেন, একজন ডাক্তার ও কয়েকজন সেবক তার জ্ঞান ফিরিয়ে আনবার চেষ্টা করছে। চৈতন্যানন্দের একটি চিঠিতে বিবরণ দিয়েছেন : “জল সমস্ত বাহির হইল। কিন্তু ধমনীতে আর প্রাণের স্পন্দন হইল না।”
কাশী সেবাশ্রমের কর্তা শুভানন্দ নিজের সম্পর্কে বলতেন, “আমি সেবাশ্রমের তত্ত্বাবধান করি মাত্র, কর্তা আমি নই।”
তাঁর একটি আশ্চর্য অভ্যাস ছিল। যখনই কাশীর পথে বার হতেন তখনই কিছু চাল, ডাল বা কোনো খাবার জিনিস সঙ্গে নিতেন। কাউকে অভুক্ত দেখলে তাকে নিজে হাতে কিছু দিতেন।
.
যে আলোতে প্রাণের প্রদীপ জ্বালিয়ে বারাণসী সেবাশ্রমের কয়েকজন বিবেকানন্দ-শরণাগত বিশ শতকের শুরুতে নতুন ইতিহাস তৈরি করলেন সেই একই আলোয় নিজেদের প্রদীপ্ত করে আর এক অসম্ভবকে সম্ভব করেছিলেন দুই বিবেকানন্দ শিষ্য কল্যাণানন্দ ও নিশ্চয়ানন্দ। গুরু তাদের উৎসমুখে ফিরতে বারণ করেছিলেন, তারা গুরুর আদেশ অমান্য করেন নি। চিন-জাপান যুদ্ধের সময় আহতদের সেবার জন্য মেডিক্যাল মিশনের সভ্য হয়ে ভারতীয় ডাক্তার কোটনিস চিনে গিয়েছিলেন, আর ফেরেননি। তার জীবনগাথা যে বইতে ধরে রাখা হয়েছে, তার নাম ‘ফেরে নাই শুধু একজন। কনখলের অবিশ্বাস্য কাহিনি আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় স্বামীজির আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে, তার ইচ্ছার প্রতি সম্মান জানিয়ে একজন নয়, ফেরে নাই কয়েকজন।
নিজেদের সম্পূর্ণ মুছে ফেলে গুরু বিবেকানন্দের ভাবধারাকে প্রাণবন্ত রাখাটাই ছিল দুই সন্ন্যাসীর ব্রত। এতই অহংকে অবহেলা যে ১৯৪০ সালে দেখা গেল যে-মানুষটি প্রায় চারদশক ধরে কনখল সেবাশ্রমের আকাশবাতাস প্রাণবন্ত রেখেছিলেন সেই নিশ্চয়ানন্দ মহারাজের কোনো ছবিই নেই সেবাশ্রমে। সেই সময় সেবাশ্রমে এসেছেন আমেরিকান সন্ন্যাসী স্বামী অতুলানন্দ। শুনে তিনি বললেন, মার্কিনী ফক্স ভগ্নীরা সেবার যখন কনখলে এসেছিলেন তখন নিশ্চয় তারা নিশ্চয়ানন্দকে কোনো না কোনো ছবির ফ্রেমে বন্দি করে রেখেছিলেন। তিনি মার্কিন দেশে চিঠি লিখে দিলেন। ফক্স ভগ্নীদের একজন তখনও বেঁচে ছিলেন, তিনি একটা ছবি পাঠালেন, সেই অস্পষ্ট ছবিটাই এখন আমাদের একমাত্র স্মৃতি।
একই বিবেকানন্দ-শিলা থেকে কুঁদে বার করা কল্যাণানন্দ। বরাবর দশ আনা দামের জুতো ব্যবহার করতেন। দারুণ ঠাণ্ডাতেও পশম নয়, তুলোর জামাই ছিল তাঁর ভরসা।
শেষ পর্বে কল্যাণানন্দের শরীর ভাল যাচ্ছিল না। শত সহস্র মানুষকে ব্যাধিমুক্তিতে সাহায্য করাই যাঁর জীবনব্রত তিনি নিজেই এবার ভগ্নস্বাস্থ্য হলেন। কিন্তু শয্যাশায়ী হয়ে অপরের বোঝা বাড়ানোর মানসিকতা নিয়ে তিনি এই দূরদেশে গুরু বিবেকানন্দের নির্দেশ পালন করতে আসেননি। অতএব রোগ যতই হোক, কাজের বিরাম নেই। এই শরীরই যে ব্যাধিমন্দির তা তার থেকে ভাল কি আর বুঝতো? সেই সঙ্গে প্রবল মানসিক ও আধ্যাত্মিক শক্তি।
মৃত্যুকে ভয় পাবার জন্য মানুষ সন্ন্যাসী হয় না, মরণের সঙ্গে আগাম মোকাবিলার জন্যই তো জীবিতকালে আদ্যশ্রাদ্ধ, তবু ব্যাধির বিরুদ্ধে সংগ্রাম শেষ হতে চায় না। মৃত্যুও বোধ হয় তাদের প্রতি সন্তুষ্ট নয় যাঁরা ব্যাধিগ্রস্ত মানুষকে দেবজ্ঞানে দিবারাত্র সেবা করে মৃত্যুকে এবং দেহযন্ত্রণাকে বাধা দেয়। এক বছর দু’বছর নয়, সহায়হীন সম্পর্কহীন অচেনা অজানা দেশে দীর্ঘ পঁয়ত্রিশ বছর ধরে ভিক্ষাবৃত্তিতে ক্ষুধানিবৃত্তি করে নরনারায়ণের সেবা করে গুরুনির্দেশ পালন করেছেন মুখ বুজে। জগতের ইতিহাসে এমন জিনিস যে আজও ঘটে তা কল্যাণানন্দের জীবনী জানলে বিশ্বাস হয় না।