কেদারবাবা বলতেন, “ধ্যানধারণা সম্বন্ধে স্বামীজি খুব স্ট্রিক্ট ছিলেন।…প্রত্যেককেই ভোর চার ঘটিকায় উঠে ঠাকুরঘরে এসে ধ্যান করতে হত। তিনি নিজেও এসে বসতেন।..কেউ না আসলে তিনি প্রথম প্রথম বিদ্রূপচ্ছলে বলতেন,–”ওহে সন্ন্যাসিবাবুরা, আর কতক্ষণ নিদ্রা যাবে?
স্বামীজির অগ্নিময় সংস্পর্শে বাস করতে করতে বৈরাগ্যের উত্তপ্ত প্রেরণা কেদারবাবাকে বেশিদিন আর নীরব থাকতে দেয় নাই। স্বামীজিকে একদিন একান্তে পেয়ে, তারই পদপ্রান্তে আশ্রয়ভিক্ষা করে সন্ন্যাসের জন্য তিনি মুখ ফুটে প্রার্থনা জানালেন। স্বামীজি বললেন, “দশবাড়ি ভিক্ষা করে খেতে পারবি?” কোদারবাবা যুক্ত করে উত্তর দিলেন, “আপনার আশীর্বাদ হলেই পারব।” উত্তর শুনে প্রসন্ন হয়ে স্বামীজি বলেছিলেন, “আচ্ছা এখানেই পড়ে থাক–সব ঠিক হয়ে যাবে।”
অবশেষে পরবর্তী বৈশাখ মাসের বুদ্ধপূর্ণিমাতে (মে, ১৯০২) স্বামীজি কেদারবাবার মনস্কাম পূর্ণ করেন। স্বামী বোধানন্দকে স্বামীজি আদেশ করেছিলেন, সন্ন্যাসানুষ্ঠানের আবশ্যকীয় সব ব্যবস্থাদি করতে। নির্দিষ্ট সেই রাত্রে আনন্দে ও উদ্বেগে কেদারবাবার চোখে ঘুম নেই রাত্রি ২-২০ মিনিটেই ভোর হয়ে গেছে মনে করে, নিশ্চয়ানন্দ স্বামীকে ঘণ্টা বাজাতে বলেছিলেন। নিশ্চয়ানন্দও তাঁর কথায় ঘণ্টা দিলে, বোধানন্দ উঠে ঠাকুরঘরের দিকে যাচ্ছিলেন। এমন সময় স্বামীজি খোঁজ নিলেন, “এত রাত্রে ঠাকুরঘরে কে যায় রে?” বোধানন্দ যখন ঘণ্টার কথা বললেন, তখন স্বামীজি সস্নেহে বলেছিলেন, “ছোঁড়াটা খুব নার্ভাস হয়ে পড়েছে।”
কিছুক্ষণ পরে স্বামীজি স্বয়ং ঠাকুরঘরে গিয়ে যথানির্দিষ্ট আসনে উপবেশন করে কেদারবাবাকে সন্ন্যাসদীক্ষা প্রদান করলেন। শিষ্য বিরজা হোমাগ্নিতে পূর্ণাহুতি দেবার পরে, ব্রহ্মবিদ আচার্য তাঁকে ‘বহুজনহিতায় বহুজনসুখায়’ শ্রীরামকৃষ্ণ-চরণে অর্পণ করলেন। অচলা ভক্তি বিশ্বাসের আশীর্বাদ প্রদান করে শ্রীগুরু তার নাম দিলেন অচলানন্দ। অচলানন্দ সাষ্টাঙ্গ প্রণাম করে উঠতেই, স্বামীজি বললেন, “আজ হতে তোর সমস্ত সাংসারিক কর্ম নাশ হয়ে গেল।” স্বামী অচলানন্দই স্বামীজির শেষ সন্ন্যাসি-শিষ্য– অতঃপর তিনি আর কাকেও সন্ন্যাস-দীক্ষা দেননি।
এরপরেই ১৯০২ সালে ফেব্রুয়ারি মাসে স্বামীজি সদলবলে বারাণসীতে হাজির হলেন। পরবর্তী বর্ণনার জন্য আমরা স্বামী অজজানন্দর কাছে নির্ভরশীল।
বারাণসীতে স্বামীজি একদিন চারুচন্দ্রকে বলেছিলেন, “সেবাধর্ম সহায়ে সর্বভূতের সহিত ঈশ্বরের ঐক্য সহজে অনুভবগম্য। তোমরা কি তোমাদের কর্মজীবনে দয়াকে উচ্চ স্থান নির্দেশ করেছ। মনে রেখো, দয়া প্রদর্শনের অধিকার তোমাদের নেই। যিনি সর্বভূতের ঈশ্বর তিনিই দয়া প্রদর্শনের অধিকারী।
“যে দয়া করতে চায়, সে নিশ্চয়ই গর্বিত ও অহষ্কৃত। কারণ সে অপরকে নিজের চেয়ে নীচ ও হীন মনে করে। দয়া নয়–সেবা-ই তোমাদের জীবনের নীতি হোক। দেবমূর্তিজ্ঞানে জীবসেবা দ্বারা কর্মকে ধর্মে পরিণত কর। ঈশ্বর ব্যতীত অন্য কেউ জীবের দুঃখ দূর করতে পারে না।
স্বামী শিবানন্দ একদিন চারুচন্দ্রের ও তার দু’একটি বন্ধুর জন্য স্বামীজির কাছে প্রার্থনা জানালেন যাতে তিনি কৃপা করে যুবকগণকে দীক্ষা প্রদান করেন। স্বামীজিও প্রসন্ন হয়ে চারুচন্দ্রকে মন্ত্র-দীক্ষা প্রদান করেছিলেন।
সেই সময়ে আরও একটি ঘটনা, চারুচন্দ্রের অনুরোধে সেবাশ্রমের প্রচারের জন্য স্বামীজি স্বয়ং একটি বিজ্ঞাপনপত্র লিখে দিলেন। এই আবেদনপত্রটির মূলভাষা ইংরিজি এবং এখনও সেবাশ্রমের বার্ষিক বিবরণীর শুরুতে স্বামী বিবেকানন্দর স্বাক্ষরসহ ছাপা হয়।
.
এবার ভক্ত চারুচন্দ্রের শেষ পর্বের কথা। ১৯২৬ এপ্রিল মাসে স্বামী সারদানন্দ নিমন্ত্রণ পাঠালেন শুভানন্দাকে বেলুড়ে শ্রীরামকৃষ্ণ কনভেনশনে যোগ দিতে এবং তারপর স্বাস্থ্যোদ্ধারে পুরী যেতে। শেষ মুহূর্তে শুভানন্দ বারাণসী ছেড়ে বেলুড় রওনা হতে রাজি হলেন না। ছোটছেলের মতো বললেন, “আমার এই দেহ আর বেশিদিন স্থায়ী হবে না, আমি বাকি ক’টা দিন মায়ের বুকের কাছে থেকে যেতে চাই।”
স্বামী সারদানন্দ সব খবর পেয়ে বুঝলেন শুভানন্দর শরীর সত্যিই ভেঙে পড়েছে, তাকে কোনো স্বাস্থ্যকর জায়গায় পাঠানো প্রয়োজন। তখন এক চিঠিতে সারদানন্দ তাকে কনখলে স্বাস্থ্যোদ্ধারে যাবার পরামর্শ দিলেন। একই সঙ্গে তিনি কল্যাণানন্দকে লিখলেন, শুভানন্দের যথাযোগ্য অভ্যর্থনার জন্য।
চিঠিটি পেয়ে শুভানন্দ মাথায় ঠেকালেন। বললেন, “ভেবেছিলাম এই নশ্বর দেহটা গঙ্গাতেই বিসর্জন দেওয়া হবে। কিন্তু বিশ্বনাথ অন্যরকম ভেবে বসে আছেন। তাই হোক, দেহটা কনখলেই চলুক।’
গাড়িতে উঠে শুভানন্দ ডাকলেন প্রিয় স্বামী অমরানন্দকে। বললেন, “আমি যাচ্ছি, বোধ হয় আর ফিরবো না। পোস্টাপিস সেভিংস ব্যাংকে আমার কিছু টাকা আছে, তার ব্যবস্থা কোরো। যখন শুনবে এই দেহটা আর নেই তখন এটাকার একটা অংশ মা সারদাদেবীর পূজায় খরচ করবে এবং সাধুদের জন্য ভাণ্ডারায়। বাকি সবটা যাবে দরিদ্রনারায়ণের সেবায়।”
কনখলে সেদিন ছিল বাংলা বছরের প্রথম দিন। খুব ভোরবেলায় সহকারী চৈতন্যানন্দকে নিয়ে তিনি অজানা উদ্দেশে বেরিয়ে পড়লেন।