স্বামীজীর কৃপাদৃষ্টি এই যুবকদের উপর এতখানি বর্ষিত হয়েছিল যে, মঠ থেকে একবার নির্মলানন্দকে প্রেরণ করে কাশীর অনাথাশ্রম সম্পর্কে তিনি বিস্তারিত সব সংবাদ নিয়েছিলেন। আর একবার তিনি মন্তব্য করেছিলেন, “ছোঁড়ারা কেউ কিছু করলে না। যাই হোক, তবু কাশীর ছেলেরা আমার spirit-এ কিছু কাজ করছে।” কাশীতে যুবকগণ এতদিন “যাঁকে শুধু কল্পনার বিগ্রহ করে রেখেছিলেন, এখন যেন তার সাক্ষাৎ সংস্পর্শ তাহাদের সকলের হৃদয়কে আলোড়িত করে তুলল। “যাঁরে না দেখে নাম শুনেই কানে, মন গিয়ে তাঁর লিপ্ত হল।” না-দেখা সেই আশ্চর্য বৈদ্যুতিক আকর্ষণ কেদারনাথকেও এবার বেলুড়ের দিকে নিশ্চিত টানল তিনি অনাথাশ্রম থেকে দু’সপ্তাহের অবকাশ নিয়ে বেলুড়ে চলে এলেন। তখন ১৯০১ খ্রিস্টাব্দ। শারদীয়া মহাপূজার ষষ্ঠীর দিন কেদারনাথ মঠে এসে পৌঁছলেন।
কেদারনাথ মঠে এলে, স্বামী ব্রহ্মানন্দজী তাকে সঙ্গে নিয়ে স্বামীজির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন। মঠবাড়ীর দোতলায় স্বামীজি নিজের ঘরেই তখন ছিলেন– কেদারনাথ তাঁর চরণপ্রান্তে উপস্থিত হয়ে সাষ্টাঙ্গ প্রণাম করলেন। মুণ্ডিতশির, কেবলমাত্র কৌপীনধারী, অনন্যভূষণ, জ্যোতির্ময় সদাশিবের মতো স্বামীজির সেদিনের দিব্যমূর্তি কেদারনাথের মানসপটে নিত্যকালের জন্য অঙ্কিত হয়েছিল।
কেদারনাথ পরম আনন্দে স্বামীজির পবিত্র সান্নিধ্যে মঠবাস করতে লাগলেন। স্বামীজিও তার ত্যাগ-বৈরাগ্য ও সাধননিষ্ঠা দেখে তাকে একটু বিশেষ স্নেহই দেখিয়েছিলেন। আদর করে তাকে তিনি ‘কেদার বাবা বলে ডাকতেন। কাশী থেকে মাত্র দুই সপ্তাহের কথা বলে কেদারবাবা মঠে এসেছিলেন, কিন্তু স্বামীজির ভালবাসার টানে দুই সপ্তাহ কবে উত্তীর্ণ হয়ে গিয়েছে কিছুই ঠিকঠিকানা ছিল না–স্বামীজিও অনুরক্ত ভাবী শিষ্যকে নিজের কাছে আরও কিছুদিন থেকে যেতে আদেশ করেছিলেন। কেদারবাবার এই যাত্রায় প্রায় নয় মাস মঠবাসী হয়েছিলেন। স্বামীজির ব্যক্তিগত সেবাধিকারলাভও তার এই কালের স্মরণীয় ঘটনা। পরবর্তী জীবনে অতীতের এই দিনগুলি স্মরণ করে কেদারবাবা রোমাঞ্চিত হতেন। স্বামীজির কথা বলতে বলতে তাকে আত্মহারা হতে দেখা যেত। তার স্বামীজির স্মৃতি-প্রসঙ্গ থেকে কিছু উদ্ধৃতি :
“পূজ্যপাদ স্বামীজি মহারাজের আমাদের প্রতি যে কী গভীর ভালবাসা ছিল–তাহা ভাষায় বর্ণনা করিবার নয়।”
মঠে থাকাকালে কেদারবাবা একবার সামান্য অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। স্বামীজির কাছে তাই দুই চার দিন আসতে পারেন নি। কিন্তু তার প্রতি স্বামীজির কী অহেতুক স্নেহ ছিল! অন্য সেবকের হাত দিয়ে কেদারবাবার জন্য বেদানা বা কোন ফল পথ্য নিজেই পাঠিয়ে দিতেন। হয়তো আহার করছিলেন, এমন সময়ে মনে পড়ে গিয়েছে, অমনিই সেই খাবার কোন সেবকের হাতে পাঠিয়ে, কেদারবাবাকে দিয়ে আসতে বললেন। স্বামীজির এই শিষ্যবৎসলতার কথা স্মরণ করে কেদারবাবা পরে একদা বলেছিলেন, “একবার কানাই মহারাজ (নির্ভয়ানন্দ) তার সেবা করতে করতে তার বুকে মাথা রাখে ঘুমিয়ে পড়েন। পাছে তাঁর নিদ্রাভঙ্গ হয় এই ভয়ে স্বামীজি অনেকক্ষণ পর্যন্ত একভাবে শান্ত হয়ে শুয়ে থাকেন। পরে কানাই মহারাজ আপনা থেকে নিদ্রোথিত হলে, তবে তিনি উঠলেন।”
স্বামীজি একদিন কেদারবাবাকে বলেছিলেন, “বাবা তুই আমাকে ঘুম পাড়িয়ে দিতে পারিস? তুই যা চাস্, তোকে আমি তাই দেব।”
স্বামীজি ছিলেন অহেতুক কৃপাসিন্ধু। একদিন মঠবাড়ির একতলার বারান্দায় তিনি বেঞ্চের উপর বসে আছেন কাছেই স্বামী শিবানন্দজিও ছিলেন। কেদারবাবা সামনে যেতেই, স্বামীজি সহসা বলে উঠলেন, “যা তোর কিছুই করতে হবে না। তোর সব আপনি আপনি হয়ে যাবে।”
কেদারবাবা তার মঠবাসের স্মৃতিকথা-প্রসঙ্গে একবার বলেছিলেন– “আমি স্বামীজির খুব কাছাকাছি থাকতুম–কিন্তু কিছু জিজ্ঞাসা করতুম না। কতলোক সব আসছেন–নিবেদিতা, ওলি বুল, ওকাকুরা প্রভৃতি কত সব কথা হচ্ছে। আমি মুখ লোক, অত বুঝতুম না। স্বামীজি যখন তাঁর গুরুভাইদের নিয়ে ফষ্টিনষ্টি বা কখনও বকাবকি করছেন, আমি তখন হাতের কাজ সেরে রাখতুম। হয়তো বা তিনি দুই-একবার নিজেই বলতেন, ‘কেদার বাবা, তামাক নিয়ে আয়’, নয়তো সবই তার ইঙ্গিতে বুঝে নিতুম। আহা, মাকে দেখলুম, আবার স্বামীজিকেও দেখলুম! সবাই যাকে পৌঁছে না, তারা তাকেই বেশি ভালবাসেন। তার খবরই বেশি নিতেন, যত্ন নিতেন। দেখ, আমার কি গুণ আছে? আমার দ্বারা তাদের কোন কাজই হবার নয়। অথচ তাদের এত অহৈতুকী স্নেহ-ভালবাসা কেন জানি না! আমাদের মধ্যে কী যে দেখেছেন তারা তাও বুঝি না।…স্বামীজির প্রতি এমনই একটি আকর্ষণ অনুভব করি যে সে এক অদ্ভুত ব্যাপার। তার এতটুকু সেবা করবার জন্য মন তখন উদগ্রীব হয়ে থাকত। সিঁড়ি দিয়ে ওঠা-নামা লাফিয়ে লাফিয়ে করতুম।…একদিন বাবু আমাকে খুব উৎসাহিত করছেন তার সঙ্গে দক্ষিণেশ্বর-তীর্থে যাবার জন্য। আমি তো মহারাজকে না বলে কিছুই করি না। তাকে জিজ্ঞাসা করাতে, তিনি বললেন, ‘আরে বলছ কি! স্বামীজি রয়েছেন মঠে। তাকে ছেড়ে কোথায় যাবে? দক্ষিণেশ্বর চিরকালই থাকবে–ওসব পরে ঢের হবে, এখন থাক। সত্যিই মহারাজ আমার চঞ্চল মতিকে স্থির রেখে আজ আমায় স্বামীজির কৃপালাভে ধন্য করেছেন। তানা হলে সন্ন্যাসও হত না, আর কোথায় গিয়ে কোন ভাগাড়ে পচে মরতুম কে জানে! তখন সকাল থেকে রাত দশটা অবধি স্বামীজির কাছেই থাকতুম। দিনে বিশ্রাম করতুম না–স্নান করতে, খেতে যা একটু সময় নষ্ট হত।”