ঐকালে সেবাপ্রাপ্ত কয়েকজন রোগীর বিবরণ আমরা উপস্থিত করছি, কাশীর দুঃস্থ মানুষদের অবস্থা কোন পর্যায়ে পৌঁছেছিল তা স্মরণ করিয়ে দেবার জন্য :
“পঞ্চানন হাজরা নামক ৩৫ বৎসর বয়স্ক জনৈক ব্রাহ্মণসন্তান গলিতকুষ্ঠ রোগগ্রস্ত হইয়া রোগযন্ত্রণা ও দরিদ্রতা-নিবন্ধন স্বদেশ বাঁকুড়া জেলা হইতে বারাণসীতে আসিয়া ভিক্ষাবৃত্তি অবলম্বন করেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশতঃ সংক্রামক রোগগ্রস্ত বলিয়া ভিক্ষা দেওয়া দূরে থাকুক, কেহ তাহাকে জলবিন্দু পর্যন্ত দান করেন নাই। তিনি চারদিন অনশনে নারদঘাটে পড়িয়া থাকেন। তাঁহার আর্তনাদে জনৈক ভদ্রলোক করুণার্দ্র হইয়া সমিতির সেবকদিগকে সংবাদ দেন। সেবক-সভ্যরা ভেলুপুরের অ্যাসিট্যান্ট সার্জন ডাক্তার মন্মথনাথ বসু মহোদয়কে লইয়া নারদঘাটে উপস্থিত হইয়া রোগীর ঔষধাদির ব্যবস্থা করিয়া দেন, এবং দুইবেলা সমিতি হইতে অন্নপথ্যাদি প্রস্তুত করিয়া তাহার সেবা করাইয়া আসিতেন। দুর্ভাগ্যক্রমে উক্ত রোগীর কলেরা হয়। তখন যে কী শোচনীয় অবস্থা হইয়াছিল, তাহা সকলেই অনায়াসে বুঝিতে পারেন। এই অবস্থায়ও জনৈক সেবক তাঁহার সেবা ত্যাগ করেন নাই। উক্ত কলেরা হইতে আরোগ্যলাভ হইবার পরও তাঁহাকে অন্নাদি দেওয়া হইত।”
সরয়ু তেওয়ারী নামে ১৪ বছরের একটি বালকের বাবা-মা থাকা সত্ত্বেও তাদের এমন দারিদ্র্য যে সরযূ দারুণ জ্বরে আক্রান্ত হয়ে অন্ধকূপের মতো একটা জায়গায় পড়েছিল–চিকিৎসার কোনো ব্যবস্থা হয়নি। রাজলক্ষ্মী দেবী নিঃস্ব মহিলা, ডবল নিউমোনিয়া হলেও বিনা চিকিৎসায় পড়েছিলেন। গিরিবালা দেবী ‘আমরক্ত, প্রদর প্রভৃতি জটিল রোগগ্রস্ত হওয়ায় বাড়িওয়ালা তাকে রাস্তায় বের করে দেন। আশি বছরের বৃদ্ধা মুন্না বাঈ ‘অতি সম্ভ্রান্ত ধনী মহারাষ্ট্র-পরিবারের মানুষ, ‘অদৃষ্টচক্রে পথের ভিখারিণী। বাঁকুড়ার গোপীনাথ দত্ত পক্ষাঘাতগ্রস্ত, কাশীতে নিরুপায়ে কোনোক্রমে এসেছেন ভিক্ষাদ্বারা জীবনধারণ করবেন এই ইচ্ছায়, কিন্তু শূদ্র বলে সত্রে ভিক্ষা মেলেনি, আত্মহত্যা করতে গঙ্গায় ঝাঁপ দেন, এক সহৃদয় ব্যক্তি তাকে উদ্ধার করেন।
.
১৯০২ ফেব্রুয়ারিতে স্বামীজি যখন কাশী আসেন, তখন স্বভাবতই তার কাছে ভিড় করে এসেছিলেন তাঁরই আদর্শে জাগ্রত যুবকের দল। চারুচন্দ্রসহ তাঁদের অনেককে স্বামীজি দীক্ষা দেন, পূর্ণ মনুষ্যত্বের যথার্থ রূপ সম্বন্ধে তাদের মনে সচেতনতা এনে দেন, এবং—’দরিদ্র-দুঃখ-প্রতিকার-সমিতির’ কাজে বিশেষ সন্তোষ প্রকাশ করেও কর্মীদের আদর্শের সঙ্গে প্রতিষ্ঠানের নামের যে-ভাববিরোধ ঘটছে, তাও দেখিয়ে দেন। তিনি বলেন :
“দরিদ্রের দুঃখ প্রতিকার করবার তুমি কে? সেবাতেই শুধু তোমাদের ।অধিকার।…যখনই কর্মীর মনে কর্তৃত্বাভিমান আসে, অধঃপতনের কারণ সেই মুহূর্তে ঘটে। কর্তৃত্ব ও ভোগস্পৃহা কায়মনোবাক্যে পরিত্যাগ করে, সত্যানুরাগে, শিবোহ হম্ বোধে জীবসেবারূপ কর্মের অনুষ্ঠান করো। এইরূপ কৌশলে কর্ম করলে শুধু যে ব্যক্তিগত জীবন ধন্য হয় তাই নয়, সমাজ ও দেশের প্রকৃত কল্যাণ হবে, এবং জীবজগতের সঙ্গে ভগবানের একত্ব অনুভব করে তোমরা কৃতার্থ হয়ে যাবে। তোমরা কর্মের মধ্যে দয়াকে স্থান দিয়েছে কিন্তু কখনো বাক্যে, কার্যে বা মনে মানুষ যেন দয়া করবার স্পর্ধা না রাখে।”
স্বামীজীর নির্দেশে দরিদ্র-দুঃখ-প্রতিকার-সমিতির’ নূতন নাম হল সেবাশ্রম।
সমিতি গঠনের কিছুদিন পরেই একটি ষোলো বছরের টাইফয়েড রোগীর দায়িত্ব ঘাড়ে চাপল, তাকে কোথায় রাখা যায়? প্রথমে একটা ভাড়াকরা ঘরের সন্ধান পাওয়া গেল, কিন্তু সেটায় নানা অসুবিধা থাকায় শেষপর্যন্ত কেদারনাথের বাড়িতে তাকে আনা হলো। বন্ধুদের দিবারাত্র সেবায় এবং স্থানীয় বিশিষ্ট চিকিৎসকদের দয়ায় গিরীন্দ্রনাথ সুস্থ হয়ে নিজের দেশ ফরিদপুরে ফিরে গেলেন। ইনিই কাশী সেবাশ্রমের প্রথম ইনডোর রোগী!
পরে মাসিক পাঁচটাকা ভাড়ায় জঙ্গমবাড়ীতে একটা ছোট্ট বাড়ি পাওয়া গেল। এইসময়কার তিনজন সারাসময়ের কর্মী কেদারনাথ, যামিনীরঞ্জন ও চারুচন্দ্র।
সেবাকার্যের নাম ক্রমশই ছড়িয়ে পড়ছে। সেবাব্রতী যুবকগণ কেমন করে তার ভাব গ্রহণ করে আশ্চর্য সব কাজ করছেন, নানা সূত্র থেকে এ সংবাদ স্বামী বিবেকানন্দের কানে পৌঁছয়। এবিষয়ে স্বামীজির পদপ্রান্তে গ্রন্থ (স্বামী অজজানন্দ) থেকে কিছু উদ্ধৃতি অপ্রাসঙ্গিক হবে না।
“স্বামীজী তখন বেলুড় মঠে অবস্থান করিতেছেন। কাশীর সেবাব্রতী যুবকগণ তাঁহার ভাব গ্রহণ করিয়া কেমন আশ্চর্য সব কার্য সেখানে করিতেছেন, এ-সংবাদ নানা সূত্রে তাহার কর্ণগোচর হইয়াছিল। কাশী হইতে কেহ মঠে গেলে, তিনি খুব আগ্রহ সহকারে এই নবীন অনুরাগীদের খোঁজখবর লইতেন, তাহাদের কার্যেরও প্রশংসা করিতেন। এই তরুণদলের অন্যতম যামিনী মজুমদার একদা স্বামীজীকে দর্শন করিতে মঠে গিয়াছিলেন। যামিনীর সহিত কথা বলিয়া, তাঁহার আদর্শানুরাগ দেখিয়া তিনি অত্যন্ত প্রসন্ন হইয়াছিলেন এবং কৃপা করিয়া তাহাকে মন্ত্র দীক্ষাদানও করিয়াছিলেন। যামিনীর মুখে স্বামীজী কাশীর অনাথাশ্রম ও কর্মী ছেলেদের সম্পর্কে সবিশেষ সব শুনিয়া খুব আশীর্বাদ করিয়া বলিয়াছিলেন, “এমন আশ্ৰম ভারতের প্রত্যেক তীর্থস্থানে হওয়া উচিত।”