পরের ইতিহাস সংক্ষেপে এইরকম : যামিনীরঞ্জন ছুটলেন চারুচন্দ্রের কাছে; দু’বন্ধু গেলেন হরিদ্বার থেকে সদ্য-প্রত্যাগত কেদারনাথের কাছে। এঁরা ও অন্য বন্ধুরা মিলে বৃদ্ধার শুশ্রূষার ও আশ্রয়ের সাময়িক ব্যবস্থা করলেন। পরে চাঁদা তুলে বৃদ্ধাকে ভেলুপুর হাসপাতালে রাখলেন। এই বৃদ্ধার নামই নৃত্যকালী দাসী।
আর থামা সম্ভব ছিল না। এই বন্ধুগোষ্ঠী “বারাণসী-দরিদ্র-দুঃখ প্রতিকার-সমিতি” গঠন করে ফেললেন। সমিতির জুলাই ১৯০১ থেকে জুন ১৯০২ সময়ের রিপোর্ট সমাজতাত্ত্বিকদের জ্ঞাতব্য বহু বিষয় আছে। এই রিপোর্ট স্পষ্ট দেখিয়ে দেয়, কোন্ সামাজিক ভেদবুদ্ধির মধ্যে বিবেকানন্দের ভাবানুপ্রাণিত যুবকেরা সম্পূর্ণ অসাম্প্রদায়িক মনোভাব নিয়ে সেবা করে গিয়েছিলেন।
রিপোর্টে সমিতির সংক্ষিপ্ত ইতিহাস’এইরকম:”পরম পবিত্র অবিমুক্ত বারাণসীক্ষেত্র হিন্দুমাত্রেরই সর্বপ্রধান তীর্থ বলিয়া শাস্ত্রে বর্ণিত আছে। এ কারণে সমগ্র ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রদেশ হইতে সমাগত মুমুক্ষু সাধু সন্ন্যাসী, ব্রহ্মচারী, গৃহস্থ প্রভৃতি নানাবিধ নরনারী, যাঁহাদের অন্নবস্ত্রের কোনোরূপ সংস্থান নাই তাহারাও অন্নপূর্ণা বিশ্বনাথের উপর নির্ভর করতঃ কাশীবাস করিয়া অক্ষয় পুণ্য অর্জন করিতেছেন।
“এই অসহায়, ভরণপোষণ সংস্থানহীন ব্যক্তিগণের এবং গ্রাসাচ্ছাদন বিষয়ে সম্পূর্ণ উদাসীন ধর্মনিরত সাধু-সন্ন্যাসিগণের সাহায্যার্থে অনেক মহোদয় অন্নসত্রাদি স্থাপন করিয়াছেন। কিন্তু সেইসকল অন্নসত্রাদির অন্নদান কেবল ব্রাহ্মণবর্ণের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকায় এবং ব্রাহ্মণবর্ণেরও যাঁহারা স্বয়ং দানস্থলে উপস্থিত হইয়া দানগ্রহণে সমর্থ হইবেন তাহারা প্রাপ্ত হইবেন, উপস্থিত হইতে অসমর্থ ব্যক্তিবর্গ পাইবেন না, ইত্যাদি অনুদার নিয়ম থাকায় প্রকৃত অভাবগ্রস্ত দুর্বল অসমর্থ ব্যক্তিগণের অতিশয় কষ্ট হয়। বিশেষতঃ এইসকল ব্যক্তি পীড়িত হইলে ঔষধ-পত্রাদি ও সেবাশুশ্রূষাভাবে কেহ বা অসময়ে কালকবলে পতিত হন, আর অনেকেই সম্পূর্ণ আশ্রয়শূন্য অবস্থায় রাস্তায় ও গঙ্গাতীরে পতিত হইয়া মানবলীলা সংবরণ করেন।
“এই অবিমুক্ত বারাণসী বৈদিক ধর্মের কেন্দ্রস্থল। এই স্থানেই ভগবান্ শঙ্করাচার্য জীব ব্রহ্মের অভেদত্ব সর্বপ্রথমে ঘোষণা করিয়াছিলেন। আর আজ এই স্থলে লক্ষ-লক্ষ নরনারী প্রত্যহ অন্নপূর্ণা বিশ্বনাথের অর্চনা করিয়াও বিশ্বনাথের সাক্ষাৎ মূর্তিস্বরূপ জীবগণ যে অনাথা-অন্যরা, অন্ধ, পঙ্গু, বৃদ্ধ-বৃদ্ধা রূপ ধারণপূর্বক রাস্তায় পতিত আছে, ইহা বুঝিতেছেন না। কেহই তাহাদের সেবা করিতেছেন না।
“এই সকল অবস্থা দেখিয়া, রাস্তায় নিপতিত ব্যক্তিগণের ক্লেশ দূরীকরণপূর্বক তাহাদের সেবাদ্বারা মানবজীবনের সার্থকতা সম্পাদন করিতে কৃতসংকল্প হইয়া রামকৃষ্ণ মিশনের প্রতিষ্ঠাতা শ্রীমৎ বিবেকানন্দ স্বামীর কয়েকজন ব্রহ্মচারী-শিষ্য সেবাকার্য আরম্ভ করিয়া এই ‘দরিদ্র দুঃখ-প্রতিকার সমিতি’ গঠন করেন। পরে ১৯০০ সালের ১৫ই সেপ্টেম্বর তারিখে স্থানীয় বাঙালীটোলা স্কুলভবনে এক সাধারণ সভার অধিবেশন হয়। সমিতির কার্যাদি উত্তরোত্তর বর্ধিত করিয়া সুশৃঙ্খলরূপে সম্পন্ন করিবার জন্য উক্ত সভায় নিম্নলিখিত ব্যক্তিবর্গ কার্যনির্বাহক সমিতির সভ্যরূপে নির্বাচিত হন।”
‘আশ্রমের উদ্দেশ্য সম্বন্ধে রিপোর্টে বলা হয় :
“যাঁহারা অসহায় পীড়িত অবস্থায় রাস্তায় পতিত থাকেন, সমিতি তাঁহাদিগকে রাস্তা হইতে উঠাইয়া আশ্রমবাটীতে আনিয়া সেবাশুশ্রূষা করেন ও ঔষধপথ্যাদি দান করেন।
“ঐ রাস্তায় পতিত ব্যক্তিদিগের মধ্যে যাঁহারা হাসপাতালে যাইতে ইচ্ছুক এবং হাসপাতালের কর্তৃপক্ষগণ যাঁহাদিগকে রাখেন, সমিতি তাহাদিগকে হাসপাতালে রাখিয়া আশ্রমবাটী হইতে পথ্যাদি পৌঁছিয়া দেন ও সেবা করেন এবং আবশ্যক হইলে হাসপাতালেও খোরাকী জমা দিয়া থাকেন।
“যাঁহারা অন্ধ বা অথর্ব বা বৃদ্ধ বলিয়া ভিক্ষাদি করিতে অসমর্থ, সমিতি তাহাদের বাসস্থলে যাইয়া আবশ্যকীয় অন্ন-বস্ত্র, বাসাভাড়া ইত্যাদি দিয়া থাকেন।
“যাঁহারা কায়িক পরিশ্রমে বা আত্মীয়স্বজনের সামান্য সাহায্যে কোনোরূপে কায়ক্লেশে গ্রাসাচ্ছাদন সম্পন্ন করেন, তাহারা পীড়িত হইলে চিকিৎসিত হইবার উপায় থাকে না বা সেবাশুশ্রূষা করিবারও কেহ থাকে না। সমিতি এইসকল ব্যক্তিগণের বাটীতে ডাক্তার কবিরাজ লইয়া গিয়া ঔষধ-পত্রাদির ব্যবস্থা করেন এবং সমিতির সেবকগণ বাটীতে যাইয়া সেবা করেন।
“যে-সকল ভদ্রবংশীয় ব্যক্তি অদৃষ্টবশে অতি নিঃস্ব হইয়া প্রাণত্যাগে প্রস্তুত কিন্তু সাধারণ দান-স্থলে উপস্থিত হইবেন না বা ভিক্ষাপ্রার্থনা করেন না, সমিতি বিশেষরূপে তাহাদের অবস্থা অবগত হইয়া তাঁহাদিগকে সাধ্যানুযায়ী সাহায্য করিয়া থাকেন।
“অভাবগ্রস্ত ব্যক্তি যে-কোনো জাতি হউন বা যে-কোনো ধর্মাবলম্বী হউন, তিনি স্ত্রীই হউন বা পুরুষই হউন, সমিতি তাহাদের সেবা করেন।”
রিপোর্ট থেকে আরও জানা যায়, ৮ জন সেবক বা কর্মী কাজ চালাচ্ছেন। “সেবকগণ সমিতি বাটীস্থ রোগীদের সেবাশুশ্রষা, এমনকি মলমূত্রাদি পর্যন্ত স্বহস্তে পরিষ্কার করিয়া থাকেন। সমিতির প্রথম অবস্থায় সাত মাস কাল পর্যন্ত সেবকগণ মেথরের সাহায্য না লইয়া কার্যনির্বাহ করেন। পরে আর্থার রিচার্ডসন সাহেব-মহোদয় দয়াপ্রকাশ করিয়া জনৈক মেথর নিযুক্ত করিয়া দিয়া সমিতিকে কৃতজ্ঞতাপাশে আবদ্ধ করিয়াছেন।”