০১. জন্মভিটেতে শরিকি সংঘাতের বিষবৃক্ষ
সার্ধশতবর্ষ উৎসবের প্রস্তুতিতে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে বিস্ময়কর বিবেকানন্দ-জীবনের নানা অজানা তথ্য সংগ্রহের বিপুল প্রচেষ্টা শুরু হয়েছে। তাঁর পারিবারিক-জীবন, পরিব্রাজক-জীবন, সন্ন্যাস-জীবন ও সঙ্ঘ-জীবন সম্পর্কে সাধারণ মানুষের কৌতূহল আজও সীমাহীন। সেই সঙ্গে নবযুগের নবাগতদের মনেও নানা প্রশ্ন।
পিতৃদেব বিশ্বনাথ দত্ত কেন অন্য নামে ভিটেবাড়ির শরিকদের নিয়ে উপন্যাস লিখলেন? গর্ভধারিণী জননীকে সাহায্য করার জন্য যে-টাকা মঠের তহবিল থেকে স্বামীজি নিয়েছিলেন তার ওপর সত্যিই কি সুদ দিতে হত তাকে?
দেশে-বিদেশে ভক্তের বেশে এসে বেশ কয়েকজন পুরুষ ও নারী কীভাবে বিবেকানন্দকে বিড়ম্বিত করেছিলেন? সমকালের বাঙালিরা কেন তাকে অর্থসাহায্য করেননি? আবার কারা গুরুনির্দেশে অসাধ্যসাধন করার জন্য তিলে তিলে নিজেদের বিসর্জন দিয়েছিলেন? কলকাতার বিখ্যাত ডাক্তার কি সত্যিই সহায়-সম্বলহীন রোগজর্জরিত সন্ন্যাসীর কাছ থেকে চেম্বারে চল্লিশ টাকা নিলেন?
হিসেবের কড়ি সম্পর্কে স্বামীজির সুচিন্তিত মতামতই কি শেষপর্যন্ত বিবেকানন্দনমিকসের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করল? তবু কেউ কেউ তাকে কেন জোচ্চোর অপবাদ দিল? ব্র্যান্ড রামকৃষ্ণ কি ব্র্যান্ড বিবেকানন্দ থেকে সত্যিই আলাদা? দীর্ঘদিন ধরে এমন সব সংখ্যাহীন প্রশ্নের উত্তর খুঁজেছেন সন্ধানী লেখক শংকর।
স্বামী বিবেকানন্দের সঙ্গে শংকর-এর প্রথম পরিচয় নিতান্ত বাল্যবয়সে ১৯৪২ সালে, যার চল্লিশ বছর আগে সন্ন্যাসী বিবেকানন্দের মহাসমাধি বেলুড়ে। তারই নামাঙ্কিত বিদ্যালয়ের ছাত্র হিসেবে অতি অল্পবয়সে শংকর-এর বিবেকানন্দ-অনুসন্ধানের শুরু। তারপরেই তো একের পর এক বিস্ময়।
‘অচেনা অজানা বিবেকানন্দের’ পরে ‘অবিশ্বাস্য বিবেকানন্দ’ বাংলা জীবনীসাহিত্যে আর এক অবিশ্বাস্য সংযোজন।
.
চতুর্দশ সংস্করণ – নভেম্বর ২০১৮
.
উৎসর্গ – শ্ৰীমতী বন্দনা মুখোপাধ্যায়
বন্দনা,
যাওয়া তো নয় যাওয়া।
তাই তোমাকেই আবার।
শংকর
২৯ নভেম্বর ২০১০
.
লেখকের নিবেদন
‘অচেনা অজানা বিবেকানন্দ’ প্রকাশিত হয়েছিল নভেম্বর ২০০৩ সালে, কিন্তু তার পিছনে ছিল সাত বছরের প্রস্তুতি-নানা সূত্র থেকে খুঁটে-খুঁটে ছোট ছোট তথ্য সংগ্রহ ও যাচাই করতে সময় লেগে যায়। এবারেও অনেক সময় লেগে গেল। যে-বিবেকানন্দ বিস্ময়কর, যার বহু কীর্তিই অবিশ্বাস্য এবং সমকাল যাঁকে জয়মাল্য দেবার আগে কারণে অকারণে বার বার নানা অগ্নিপরীক্ষায় আহ্বান করেছিল তাকে খুঁজে বার করতে, জানতে এবং বুঝতে যথেষ্ট সময়ের প্রয়োজন হল।
এই কঠিন কাজে আমাকে অবশ্য কখনও নিঃসঙ্গ বোধ করতে হয়নি, রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের সন্ন্যাসীরা আমাকে বারবার উৎসাহ জুগিয়েছেন, কেউ কেউ সস্নেহে লুপ্ত পথের সন্ধানও দিয়েছেন। আবার কেউ কেউ পথভ্রষ্ট হবার আগেই বিভ্রান্ত লেখককে যথাসম্ভব সচেতন করে দিয়েছেন।
আরও একটি কথা, স্বদেশে এবং বিদেশে বহুজনের হাতে বিড়ম্বিত বিবেকানন্দের কাছাকাছি এবং পাশাপাশি এমন কিছু অবিশ্বাস্য ভক্তকে এবার খুঁজে পাওয়া গেল যাঁদের নিঃশব্দ আত্মনিবেদনের কথা বিশ্বজনের কাছে প্রায় অজ্ঞাত। এঁদের কথা বলতে গিয়ে মূল ঘটনাপ্রবাহ যদি কোথাও-কোথাও একটু বিলম্বিত হয়ে থাকে তার জন্যে ক্ষমা প্রার্থনা করি, তবে অনুসন্ধানকালে মনে হয়েছিল যে এইসব আশ্চর্য মানুষকে এমনভাবে অনুপ্রাণিত করার অলৌকিক শক্তি না-থাকলে সন্ন্যাসী বিবেকানন্দ কিছুতেই অবিশ্বাস্য বিবেকানন্দে রূপান্তরিত হতে পারতেন না।
শংকর
৭ ডিসেম্বর ২০১০
.
প্রচ্ছদ চিত্র
১৮৮৬-১৯০১ এই পনেরো বছরে দেশে-বিদেশে স্বামীজির যত ছবি ভোলা হয়েছিল তার মধ্যে মাত্র ১০৬টি উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে। এই ছবিগুলি সম্বন্ধে বিস্তারিত তদন্ত করেছেন বেদান্ত সোসাইটি অফ নর্দার্ন ক্যালিফোর্নিয়া।
প্রচ্ছদের ছবিটি কবে কোথায় তোলা হয় সে নিয়ে মতভেদ আছে। প্রথমে ধারণা ছিল ছবির তারিখ ১৮৯৭, কিন্তু পরবর্তীকালে অনুসন্ধানীদের সিদ্ধান্ত ছবিটি কলকাতায় তোলা হয় স্বামীজির দ্বিতীয়বার বিদেশযাত্রার দিনে, অর্থাৎ ২০ জুন ১৮৯৯। ওইদিন রামকৃষ্ণজায়া সারদামণি তার সন্ন্যাসীসন্তানদের মধ্যাহ্নভোজনে আপ্যায়ন করেন বশীশ্বর সেনের বাগবাজার ৮ বোসপাড়া লেনের ভাড়াটে বাড়িতে। পরবর্তীকালে বশীশ্বর জগদ্বিখ্যাত বৈজ্ঞানিক হয়েছিলেন।
স্মরণীয় এক গ্রুপ ফটো থেকে স্বামীজিকে সাবধানে বার করে আনা হয়েছে। মুখের কোথাও অসুস্থতার চিহ্ন নেই। মূল গ্রুপ ফটোতে যে ছ’জন ছিলেন তাদের নাম : স্বামী ত্রিগুণাতীতানন্দ, স্বামী শিবানন্দ, স্বামী বিবেকানন্দ, স্বামী তুরীয়ানন্দ, স্বামী ব্রহ্মানন্দ এবং বিবেকানন্দশিষ্য স্বামী সদানন্দ। শ্রীমা এই সময়ে বাগবাজার বোসপাড়া লেনেই থাকতেন।
সেবারের বিদেশযাত্রায় জাহাজে স্বামীজির সঙ্গে ছিলেন স্বামী তুরীয়ানন্দ ও সিস্টার নিবেদিতা। সেবারেই জাহাজে স্বামীজি তাঁর অনন্য ভ্রমণকাহিনি ‘পরিব্রাজক’ রচনা করেন যা বাংলা সাহিত্যের অক্ষয় সম্পদ বলে স্বীকৃতি পেয়েছে।