শানে-নজুল – এক সময় কাফেররা বলিতে লাগিল যে, মানুষের ভালোমন্দ কার্যের প্রতিফল প্রদান করা আল্লার অভিপ্রেত নহে। যদি তিনি পাপীর প্রতি অসন্তুষ্ট ও পুণ্যবানের প্রতি সন্তুষ্ট হইতেন তবে কেয়ামতের প্রতীক্ষা না করিয়া ইহজগতেই কেন সৎ লোকদিগকে সম্পদশালী ও অসৎ লোকদিগকে বিপদগ্রস্ত করেন না? পরলোক মিথ্যা ইত্যাদি। তখন এই সুরা নাজেল হয়।
সুরা ফলক
শুরু করিলাম লয়ে নাম আল্লার
করুণা ও দয়া যাঁর অশেষ অপার।
বল, আমি শরণ যাচি ঊষাপতির,
হাত হতে তার – সৃষ্টিতে যা আছে ক্ষতির।
আঁধার-ঘন নিশীথ রাতের ভয় অপকার-
এ সব হতে অভয় শরণ যাচি তাঁহার।
জাদুর ফুঁয়ে শিথিল করে (কঠিন সাধন)
সংকল্পের বাঁধন, যাচি তার নিবারণ।
ঈর্ষাতুরের বিদ্বেষ যে ক্ষতি করে
শরণ যাচি, পানাহ্ মাগি তাহার তরে।
————-
সুরা ফলক
মদিনা শরিফে অবতীর্ণ; ইহাতে ৫টি আয়াত, ২৩টি শব্দ, ৭৩টি অক্ষর ও ১টি রুকু। ‘ফলক’ – উষা, প্রাতঃকাল। ইহা কোর-আনের ধারাবাহিক ১১৩ নং সুরা।
শানে-নজুল– মদিনা শরিফের অধিবাসী লবিদ নামক একজন ইহুদির কয়েকটি কন্যা ছিল। তাহারা হজরত নবি করিমের মাথার কয়েকটি চুল ও চিরুনির কয়েকটি দাঁতের উপর জাদুমন্ত্র পাঠ করিয়া এগারোটি গ্রন্থি দিয়াছিল এবং তাহা এক একটি খোর্মা মুকুলের মধ্যে রাখিয়া ‘যোরআন’ নামক কূপের তলদেশস্থ প্রস্তরের নীচে স্থাপন করিয়াছিল। এই জাদুর দরুন হজরতের শরীর এরূপ অসুস্থ হইয়াছিল যে, তিনি যে কাজ করেন নাই তাহাও করিয়াছেন বলিয়া কখনও কখনও তাঁহার ধাটণা হইত। হজরত ছয় মাস কাল যাবৎ এরূপ ব্যাধিগ্রস্ত ছিলেন। এক রাত্রে তিনি স্বপ্নে জানিতে পারিলেন তাঁহার ওই পীড়ার কারণ কী। প্রাতে হজরত আলি, আম্মার ও জোবায়েরকে ‘যোরআন’ কূপের দিকে প্রেরণ করেন। তাঁহারা উক্ত কূপের তলদেশ হইতে ওইসব দ্রব্য তুলিয়া হজরতের নিকট নিয়া হাজির করেন। তখন জিব্রাইল ‘ফলক’ ও ‘নাস’ এই দুই সুরা সহ অবতরণ করেন। এই দুই সুরায় এগারোটি আয়াত আছে। তিনি এক এক করিয়া ক্রমান্বয়ে এগারোটি আয়াত পাঠ করিলেন এবং সঙ্গে সঙ্গে এক এক করিয়া উহার এগারোটি গ্রন্থি খুলিয়া গেল। অতঃপর হজরত সম্পূর্ণরূপে রোগ হইতে মুক্তি লাভ করিলেন।
(–এমাম এবনে কছির, জালালায়ন, কবির।)
এস্থলে ইহাও উল্লেখ করা যাইতে পারে যে, জাদুমন্ত্র দ্বারা মানুষের শারীরিক ক্ষতি হওয়া অসমীচীন নয়; কিন্তু সর্বশ্রেষ্ঠ মহাপুরুষ জাদুমন্ত্র-প্রভাবে স্বর্গীয় আদেশ প্রচারের কালে বিকারগ্রস্ত হইয়াছিলেন এরূপ ধারণা করা বাতুলতা মাত্র।
(কবির, হাক্কানী)
সুরা ফাতেহা
শুরু করিলাম) লয়ে নাম আল্লার
করুণা ও দয়া যাঁর অশেষ অপার।
সকলই বিশ্বের স্বামী আল্লার মহিমা,
করুণা কৃপার যাঁর নাই নাই সীমা।
বিচার-দিনের বিভু! কেবল তোমারই
আরাধনা করি আর শক্তি ভিক্ষা করি।
সহজ সরল পথে মোদেরে চালাও,
যাদেরে বিলাও দয়া সে পথ দেখাও।
অভিশপ্ত আর পথভ্রষ্ট যারা, প্রভু,
তাহাদের পথে যেন চালায়ো না কভু।
অর্থ – সংকেত
সুরা ফাতেহা
এই সুরা মক্কা শরিফে অবতীর্ণ হইয়াছে। ইহাতে ৭টি আয়াত, ২৫টি শব্দ, ১২৩টি অক্ষর ও ১টি রুকু। ইহার অপর নাম ‘সাবাউল মাসানী’। ‘সাবা’ অর্থ সাত; ‘মাসানী’ অর্থ পুনঃপুন।
ফাতেহা – উদ্ঘাটিকা। এই ‘সুরা’ দিয়াই পবিত্র কোর-আন শরিফের আরম্ভ। এইজন্য এই সুরার নাম ‘ফাতেহা’। ইহা কোর-আনের শেষ খণ্ড আমপারায় নাই, ইহা কোর-আন শরিফের প্রথম খণ্ডের প্রথম ‘সুরা’। নামাজ, বন্দেগী, প্রার্থনা প্রভৃতি সকল পবিত্র কাজেই সুরা ফাতেহার প্রয়োজন হয় বলিয়া আমপারার সঙ্গে ইহার অনুবাদ দেওয়া হইল।
শানে-নজুল– (অবতীর্ণ হইবার কারণ) – একদা হজরত মোহাম্মদ (দঃ) মক্কার প্রান্তর অতিক্রম করিবার সময় দৈববাণী শুনিতে পাইলেন, মোহাম্মদ! আমি স্বর্গীয় দূত জেব্রাইল, আপনি পয়গম্বর, আমি শপথ করিতেছি – আল্লাহ্ ভিন্ন আর কোন উপাস্য নাই, মোহাম্মদ (দঃ) আল্লাহ্র রসুল (তত্ত্ববাহক)। আপনি বলুন, আলহামদোলিল্লাহ্- সকল প্রশংসাই বিশ্বপতি আল্লার, ইত্যাদি।
(–তফসীরে আজিজী ও তফসীরে মাজহারী)
সুরা ফীল
শুরু করিলাম শুভ নামে সে আল্লার,
করুণানিধান যিনি কৃপা-পারাবার।
দেখ নাই, তব প্রভু কেমন (দুর্গতি)
করিলেন সেই গজ-বাহিনীর প্রতি?
(দেখ নাই, তব প্রভু) করেননি কি রে
বিফল তাদের সেই দুরভিসন্ধিরে?
পাঠালেন দলে দলে সেথা পক্ষী আর
করিতে লাগিল তারা প্রস্তর প্রহার
গজপতিদেরে। তিনি তাদেরে তখন
করিলেন ভক্ষিত সে তৃণের মতন।
————-
সুরা ফীল
এই সুরা মক্কা শরিফে অবতীর্ণ হইয়াছে। আবরাহার দলের উপর জয়ী হওয়ায় আবিসিনিয়াবাসীদের সম্বন্ধে এই সুরা অবতীর্ণ হয়। ইহাতে ৫টি আয়াত, ২৪টি শব্দ ও ৯৪টি অক্ষর আছে।
শানে-নজুল – ইমন প্রদেশের শাসনকর্তা আবরহা ঈর্ষার বশবর্তী হইয়া ইমনের ‘ছানয়া’ নামক স্থানে রত্নরাজি খচিত ‘কলিসা’ নামে একটি গির্জা প্রস্তুত করিয়া তথায় উপাসনার নিমিত্ত লোকদিগকে আহ্বান করেন। ধার্মিক লোকেরা তাঁহার আদেশ মানিতে রাজি না হওয়ায় তিনি কাবাগৃহ ধ্বংসের নিমিত্ত বহু সৈন্যসামন্ত ও ১৩টি হাতি (‘মামুদ’ সহ) প্রেরণ করেন। হজরতের পিতামহ আবদুল মোতালেব ‘মোগাম্মছ’ নামক স্থানে হান্নাতা নামক ব্যক্তির সহিত যাইয়া আবরাহার নিকট হাজির হন ও যথেষ্ট সম্মান পান এবং তাঁহার লুণ্ঠিত দুই শত উষ্ট্র ফেরত পাইবার দাবি জানান। আবরাহা কাবা ধ্বংসের বাসনা জ্ঞাপন করায় তিনি বলেন – আমি উটের মালিক, উট ফেরত চাই – কাবা গৃহের মালিক স্বয়ং আল্লাহ্, কাজেই তিনি উহা রক্ষা করিবেন। আরবের অপর যে-সকল নেতা তাঁহার সঙ্গে গিয়াছিলেন তাঁহারা মক্কার ধনসম্পদ বা চতুষ্পদ জন্তুসমূহের দুই-তৃতীয়াংশ আবরাহাকে দিতে চাওয়া সত্ত্বেও আবরহা কাবা ধ্বংসের সংকল্প ত্যাগ করিলেন না, আবদুল মোতালেবের উটগুলি ফেরত দিতে আদেশ দিলেন।
আবরাহা যুদ্ধ ঘোষণা করিলেন। তখন কাবার মর্যাদা রক্ষার নিমিত্ত আল্লাহ্তালা দলে দলে পাখি প্রেরণ করিলেন। উহারা উপর হইতে কঙ্কর নিক্ষেপ করতঃ আবরাহার সমস্ত হস্তী ও সৈন্য বিনাশ করিয়া দিল।
এই ঘটনার কিছুকাল পর হজরতের জন্ম হয়। কোরেশগণের উপর যে আল্লাহ্ মহা অনুগ্রহ প্রকাশ করিয়াছিলেন তাহাই এই সুরায় বর্ণিত হইয়াছে। উক্ত অনুগ্রহ স্মরণ করিয়া আল্লার এবাদত করা কোরায়েশগণের কর্তব্য, এই উদ্দেশ্যে এই সুরা অবতীর্ণ হইয়াছে।
সুরা বাইয়েনাহ্
শুরু করিলাম নামে পবিত্র আল্লার,
সীমা নাই যাঁর দয়া কৃপা করুণার।