শানে-নজুল – একদা রাত্রিতে হজরতের গৃহে তাঁহার পিতৃব্য আবু তালেব উপস্থিত হইলে পর, তাঁহার সামনে আহারের নিমিত্ত রুটি ও দুগ্ধ হাজির করা হয়। তাঁহারা উভয়ে যখন খাদ্য গ্রহণে রত তখন একটি উল্কাপিণ্ডের জ্যোতিতে ওই গৃহ উদ্ভাসিত হইলে ওই জ্যোতিতে আবু তালেবের চোখের জ্যোতি ক্ষীণ হইয়া গেল। ব্যস্ততা-সহকারে ভোজন ত্যাগ করিয়া উঠিয়া তিনি জিজ্ঞাসা করিলেন – ইহা কী? হজরত বলিলেন – শয়তানেরা যখন আশমানের গুপ্ত তত্ত্ব অনুসন্ধান করিবার নিমিত্ত উড্ডীয়মান হয়, তখন ফেরেশতারা উল্কাপিণ্ড নিক্ষেপ করিয়া উহাদিগকে বিতাড়িত করে। আবু তালেব বিস্ময়ান্বিত হইয়া নিস্তব্ধ হইলেন। তখন এই সুরা নাজেল হয়।
সুরা তাৎফিফ
শুরু করি লয়ে পূত নাম বিধাতার
করুণা ও দয়া যার অনাদি অপার।
সর্বনাশ তাহাদের, হ্রাসকারী যারা,
যখন লোকের কাছে মেপে লয় তারা,
তখন পূর্ণ করে চায় মেপে নিতে,
তাদেরে ওজন করে হয় যবে দিতে,
তখন কম সে করে মাপে ও ওজনে।
উঠিতে হইবে পুন, করে না তা মনে।
উঠিবে মানব পুন মহান সেদিন,
বিশ্বপালকের কাছে দাঁড়াবে যেদিন।
পাপিষ্ঠ লোকের সে কার্য সমুদয়
নিশ্চয় ‘সিজ্জিনে’ থাকে, কভু মিথ্যা নয়।
জান কি, সে ‘সিজ্জিন’ কী? লিখিত কেতাব
(লেখা রবে যাতে তার পাপের হিসাব)।
– সর্বনাশ হবে
তাদের – সত্যেরে বলে মিথ্যা যারা সবে।
কর্মফল প্রাপ্তির এদিন হাশরের –
বলে মিথ্যা – সর্বনাশ হবে তাহাদের।
আদেশ-লঙ্ঘনকারী পাতকী ব্যতীত
আর কেহ বলে না – এ সত্যের অতীত।
তার কাছে পাঠ হলে আমার এ বাণী,
সে বলে এ ‘পূর্বতন লোকের কাহিনি!’
– কখনই নহে, তাহা নহে
অভ্যস্ত তাদের নিজ কাজগুলি রহে,
জমেছে মরিচারূপে তাহাদের মনে।
সেদিন তাহারা নিজ খোদার সদনে,
পারিবে না যেতে নিশ্চয়! তারপর
প্রবেশ করিবে তারা দোজখ ভিতর।
সেই কর্মের ফল জেনো ইহা সেই,
তোমরা মিথ্যা সদা বলিতে এরেই।
কখনই মিথ্যা নহে, রহিবে নিশ্চয়,
লেখা ‘ইল্লিয়নে’ সব কার্য সমুদয়
যত সৎলোকের সে। জান ‘ইল্লিয়ন’
কারে কয়? লিখিত সে কেতাব রতন।
প্রত্যক্ষ কেবল তারা করিবে দর্শন
আল্লার নিকটে যাবে যে মানবগণ।
সুপ্রচুর সুখে রবে পুণ্য-আত্মাগণ,
সুউচ্চ তখ্তে রহি করিবে দর্শন।
– সে সুখ-পুলকে
দেখিতে পাইবে তারা নিজ মুখে চোখে
–শিলমোহর করা
তাহারা করিবে পান সুপবিত্র সুরা।
কস্তুরীর সে মোহর। কামনা কারুর
থাকে যদি – করুক কামনা এ দারুর।
‘তস্নীম’ সুধা মেশা হয় সে সুরায়,
‘তস্নীম’ সে প্রস্রবণ-উৎস যাহায়
আল্লার নিকট যারা, করে তারা পান।
অবিশ্বাসী সবার প্রতি বিদ্রুপ-বাণ
হানিত যে অপরাধিগণ নিশ্চয়,
আঁখি-ঠারে ইঙ্গিত তারা যে সময়
করিত পরস্পরে বিশ্বাসীরে দেখে
তাহাদের পাশ দিয়া যাইলে তাহাকে।
স্বজনের কাছে সব ফিরে গিয়ে পুন
করিত বিদ্রুপ ব্যঙ্গ ইহারা তখনও।
দেখায়ে (বিশ্বাসিগণ) বলিত, ‘ইহারা
নিশ্চয়, নিশ্চয়ই, সবে পথহারা!’
বিশ্বাসীদের পরে অথচ বেশক
প্রেরিত হয়নি এরা হইয়া রক্ষক।
ইমান এনেছে যারা, তারা আজিকে
উপহাস করিবে বিধর্মী দেখে।
উঁচু সে তখ্তে বসি করিবে দর্শন,
কর্মফল পেল আজ বিধর্মিগণ॥
————
সুরা তাৎফিফ
এই সুরা মক্কায় কি মদিনায় নাজেল হয় এ-সম্বন্ধে মতভেদ দৃষ্ট হয়। ইহাতে ৩৬টি আয়াত, ১৭২টি শব্দ ও ৭৫৮টি অক্ষর আছে।
শানে-নজুল – হজরত মদিনায় পদার্পণ করিয়া দেখিলেন যে, উক্ত স্থানের অধিবাসীগণ পরিমাণ ও ওজনে কম-বেশি করিয়া থাকে, তখন এই সুরা নাজেল হয়।
মক্কায় এই সুরা প্রথম নাজেল হইয়াছিল। হজরত মদিনায় যাওয়ার পর সেখানে ইহা পাঠ করিয়া শুনাইয়াদিলেন।
সুরা তীন
শুরু করি লয়ে শুভ নাম আল্লার,
করুণা ও কৃপা যাঁর অনন্ত অপার।
শপথ ‘তীন’ ‘জায়তুন’ ‘সিনাই’ পাহাড়
শপথ সে শান্তিপূর্ণ নগর মক্কার –
নিশ্চয় মানুষে আমি করেছি সৃজন
দিয়া যত কিছু শ্রেষ্ঠ মুরতি গঠন।
(যে জন সুবিধা এর লইল না তারে)
করিয়াছি নীচাদপি নীচ সে জনারে।
কিন্তু যে ইমান আনে, সৎকাজ করে,
অনন্ত সে পুরস্কার আছে তার তরে।
‘সুবিচার পাবে সবে’ বলিলে তোমায়
মিথ্যার আরোপ করে কে সে তবে, হায়?
আল্লাহ্ কি নন
সব বিচারক চেয়ে শ্রেষ্ঠতম জন?
————
সুরা তীন
এই সুরা মক্কা শরিফে নাজেল হইয়াছে। ইহাতে ৮টি আয়াত, ৩৪টি শব্দ ও ১৬৫টি অক্ষর আছে।
শানে নজুল –
১। তীন-আঞ্জির, জায়তুন-তৈল বৃক্ষ বিশেষ। উভয় নামে পরিচিত পর্বতে হজরত ইশার জন্ম ও নবুয়ত-প্রাপ্তি হয়।
২। সিনিনা – সিনাই পাহাড়; এ স্থানে হজরত মুসা ‘তওরত’ গ্রন্থ প্রাপ্ত হন।
৩। বালাদুন আমিন – ‘শান্তিময় নগর’ – এই বাক্যাংশ দ্বরা হজরত মোহাম্মদ মোস্তফার (দঃ) জন্মভূমি মক্কা নগরকে বুঝায়।
উক্ত তিনটি পাক স্থানের নামি উপরোক্ত নবিগণের স্মরণার্থ আল্লাহ্তালা শপথ করিয়া মানবগণকে এই সাবধান-বাণী জানাইতেছেন যে, তিনি আদেশ-প্রদাতাদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ (আদেশ-প্রদাতা)।
সুরা দ্বোহা
শুরু করি লয়ে পাক নাম আল্লার,
অনন্ত সাগর যিনি দয়া করুণার।
শপথ প্রথম দিবস-বেলার
শপথ রাতের তিমির-ঘন,
করেননি প্রভু বর্জন তোমা,
করেননি দুশমনি কখনও।
পরকাল সে যে উত্তমতর
ইহকাল আর দুনিয়া হতে,
অচিরাৎ তব প্রভু দানিবেন
(সম্পদ) খুশি হইবে যাতে।
পিতৃহীন সে তোমারে তিনি কি
করেননি পরে শরণ দান?
ভ্রান্ত-পথে তোমারে পাইয়া
তিনিই না তোমা পথ দেখান?
তিনি কি পাননি অভাবী তোমারে
অভাব সব করেন মোচন?
করিয়ো না তাই পিতৃহীনের
উপরে কখনও উৎপীড়ন।
যে জন প্রার্থী তাহারে দেখিয়ো
কোরো না তিরস্কার কভু,
ব্যক্ত করহ নিয়ামত যাহা
দিলেন তোমারে তব প্রভু।
————-
সুরা দ্বোহা
এই সুরা মক্কা শরিফে নাজেল হয়। ইহাতে ১১টি আয়াত, ৪০টি শব্দ ও ১৬৬টি অক্ষর আছে।