শানে-নজুল – মক্কার পৌত্তলিকেরা মুসলমানগণকে ইসলাম গ্রহণ করার দরুন নানা প্রকার উৎপীড়ন করিত। হজরতের নিকট মুসলমানগণ অভিযোগ করায় তিনি উত্তরে বলিয়াছিলেন যে, এক সময় তাহাদের দুর্ব্যবহারের প্রতিশোধ গ্রহণ করিতে খোদা তোমাদিগকে সক্ষম করিবেন। এ কথা শ্রবণ করিয়া কাফেররা বলিতে লাগিল – এরূপ দুর্বল, অপমানিত ও অর্থহীন লোকেরা কীরূপে প্রতিশোধ লইতে সক্ষম হইবে? খোদার ইচ্ছাতেই আমরা সম্মানিত আর তাহারা হেয় ও লাঞ্ছিত। কাফেরদের উক্ত কথার প্রত্যুত্তরস্বরূপ ওই সময় এই সুরা অবতীর্ণ হয়। অগ্নিকুণ্ড স্থাপয়িতাদের পরিণাম বর্ণনা করিয়া ইসলাম ধর্মাবলম্বীদিগকে ইহাতে সান্ত্বনা প্রদান করা হইয়াছে। – (আজিজী)।
সুরা মাঊন
শুরু করি নামে সেই পবিত্র আল্লার
করুণা দয়ার যাঁর নাই শেষ পার।
তুমি কী দেখেছ, বলে ধর্ম মিথ্যা যেই?
পিতৃহীনে তাড়াইয়া দেয়, ব্যক্তি এই।
দরিদ্র কাঙালগণে অন্নদান তরে
এই লোক উৎসাহ দান নাহি করে।
যাবে ভণ্ড তপস্বীরা বিনাশ হইয়া
ভ্রান্ত যারা নিজেদের নামাজ লইয়া;
সৎকাজ করে যারা দেখাইতে লোক,
বাধা দেয় দান ধ্যানে, ধ্বংস তারা হোক!
————–
সুরা মাঊন
মক্কা শরিফে এই সুরা অবতীর্ণ হয়; ইহাতে ৭টি আয়াত, ২৫টি শব্দ ও ১১৫টি অক্ষর আছে।
শানে-নজুল – আবু জহল কোনো মুমূর্ষু ব্যক্তির সন্তানের তত্ত্বাবধানের ভার লইয়া উক্ত ব্যক্তির মৃত্যুর পর নিজেই বালকের পিতার ত্যাজ্য সম্পত্তি ভোগ করিতে থাকে, এবং বালকটিকে বিতাড়িত করিয়া দেয়। উক্ত বালক ক্ষুধার্ত ও বিবস্ত্র অবস্থায় হজরতের নিকট উপস্থিত হইয়া আবু জহলের অসদ্ব্যবহার ও অত্যাচার-কাহিনি প্রকাশ করে। হজরত আবু জহলের নিকট যাইয়া উহার প্রতিকারার্থে তাহাকে কেয়ামতের ভীতি প্রদর্শন করেন। আবু জহল কেয়ামতের প্রতি অসত্যারোপ করিতে থাকায় হজরত দুঃখিত মনে নিজ গৃহে প্রত্যাবর্তন করেন।
আবু সুফিয়ান সম্মান লাভের ইচ্ছায় প্রতি সপ্তাহে দুইটি করিয়া উষ্ট্র জবেহ করিয়া সম্ভ্রান্ত কোরেশদিগকে নিমন্ত্রণ করিয়া খাওয়াইত। একদা জনৈক পিতৃহীন বালক আবু সুফিয়ানের বাড়িতে নিমন্ত্রণের দিন উপস্থিত হইয়া কিছু মাংস ভিক্ষা চাহিয়াছিল। উহাতে সে যষ্টির আঘাত করিয়া উক্ত বালককে বিতাড়িত করে; সেইজন্য এই সুরা নাজেল হয়।
(এমাম রাজী।)
কেহ কেহ বলেন– কেয়ামত অমান্যকারী পাপী আ-স কিংবা ধনশালী, অবাধ্য ও অহংকারী অলীদের সম্বন্ধে ইহা অবতীর্ণ হইয়াছিল।
শেষার্ধ আবদুল্লা-বেনে-ওবাইয়া নামক জনৈক কপটাচারীর সম্বন্ধে অবতীর্ণ হইয়াছিল বলিয়া ‘খাজেনে’ উল্লিখিত আছে।
পরন্তু ধার্মিক বলিয়া পরিচিত যে সকল ব্যক্তির ব্যবহারে অধর্ম প্রকাশ পায় তাহাদের লোক-দেখানো কপটতার উদ্দেশ্যেই এই সুরা নাজেল হইয়াছে।
সুরা লহব্
শুরু করিলাম নামে সেই আল্লার,
করুণানিধান যিনি কৃপার পাথার।
ধ্বংস হোক আবুলাহাবের বাহুদ্বয়,
হইবে বিধ্বস্ত তাহা হইবে নিশ্চয়।
করেছে অর্জন ধন-সম্পদ সে যাহা
কিছু নয়, কাজে তার লাগিবে না তাহা।
শিখাময় অনলে সে পশিবে ত্বরায়
সাথে তার সে অনল-কুণ্ডে যাবে হায়
জায়া তার – অপবাদ – ইন্ধনবাহিনী,
তাহার গলায় দড়ি বহিবে আপনি।
————-
সুরা লহব্
মক্কায় অবতীর্ণ; ইহাতে ৫টি আয়াত, ২৪টি শব্দ, ৮১টি অক্ষর।
শানে-নজুল – বোখারী ও মোছলেম প্রভৃতি টীকাকারদের মতে খোদাতালা হজরতের আত্মীয়-স্বজনদের সম্বন্ধে শাস্তির ভীতি প্রদর্শনসংক্রান্ত আয়ত অবতীর্ণ করিলে তিনি সাফা পর্বতের উপর আরোহণ করিয়া আরবের তদানীন্তন নিয়মানুসারে উচ্চৈঃস্বরে ‘সাবধান’ ‘সাবধান’ বলিয়া চিৎকার করিতে থাকেন। তাহাতে কোরায়েশ বংশের অনেক লোক তথায় উপস্থিত হইয়া হজরতকে জিজ্ঞাসা করে, কী হইয়াছে? হজরত তাহাদের সম্বোধন করিয়া বলিলেন যে, যদি আমি বলি যে, একদল শত্রু তোমাদিগকে আক্রমণ করিবার জন্য পর্বতের অপর পার্শ্বে উপস্থিত হইয়াছে, তবে তোমরা আমার এই কাজের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করিবে কি? তদুত্তরে তাহারা বলিল, নিশ্চয় বিশ্বাস স্থাপন করিব। আমরা বেশ পরীক্ষা করিয়াছি, আপনি কখনও মিথ্যা কথা বলেন না। তৎপরে হজরত বলিলেন, – হে কোরেশগণ! তোমাদের সম্মুখে জ্বলন্ত দোজখের মহাশাস্তি রহিয়াছে; যদি তোমরা আমার ও খোদার বাণীর উপর আস্থা স্থাপন না কর, তবে তোমাদিগকে ওই শাস্তি ভোগ করিতে হইবে। তোমরা স্ব স্ব আত্মাকে উক্ত শাস্তি হইতে রক্ষা করো। ইহা শুনিয়া আবু লহব (হজরতের পিতার বৈমাত্রেয় ভ্রাতা, তাহার স্ত্রী আবু সুফিয়ানের ভগ্নী উম্মে জামিলা) রাগান্বিত হইয়া বলিল, ‘তাব্বান লাকা’ – তোর ধ্বংস হউক। এই ঘটনার পর এই সুরা অবতীর্ণ হয়।
(বোখারী)
সুরা লায়ল্
শুরু করি শুভ নাম লয়ে আল্লার,
দয়া করুণার যিনি মহা-পারাবার।
শপথ রাতের আবৃত যখন করে সে অন্ধকারে
দিনের শপথ প্রোজ্জ্বল যাহা করে দেয় জ্যোতিঃধারে,
নর ও নারীর শপথ – যাদের তিনি সে স্রষ্টা প্রভু,
তোমাদের যত কর্মফল একমত নহে কভু।
যারা দাতা সংযমী, সত্যধর্মে সত্য বলিয়া লয়,
সহজ করিয়া দিব কল্যাণে তাহাদেরে নিশ্চয়।
কিন্তু যাহারা কৃপণ, নিজেরে ভাবে অতি বড়ো যারা,
বলে সত্যধর্মে মিথ্যা, শীঘ্র দেখিতে পাইবে তারা,
সহজ করিয়া দিয়াছি তাদের দোজখের পথ, আর
রক্ষা করিতে পারিবে না তারে তার ধন-সম্ভার।
তখন ধ্বংস হইবে সে, জেনো সুপথ প্রদর্শন
কর্তব্য সে আমার, একাল পরকাল সবখন
কেবল আমারই এক্তিয়ারে সে। করি তাই সাবধান,
প্রজ্বলিত সে অনল হইতে জ্বলজ্বল লেলিহান।
হত ভাগা সেই জন সত্য হতে যে মুখ ফিরায়,
সে ছাড়া সেই যে অগ্নিকুণ্ডে পশিবে না কেহ হায়।
সে অনল হতে রক্ষা পাইবে সেই সংযমী জন
শুদ্ধ হবার মানসে যে জন করে ধন বিতরণ।
কাহারও দয়ার প্রতিদানরূপে করে না সে ধন দান,
তাহার মহিমময় সে প্রভুরে তুষিতে যত্নবান।