কিন্তু এ-সব আমার নিতান্ত ব্যক্তিগত কথা। আর না। তবে এ সম্বন্ধে আর একটা কথা বোধ হয় বলা ভালো। তোমরা হয়তো তখন ছোট, অধুনালুপ্ত একখানা মাসিক পত্রে তখন রবীন্দ্রনাথকে এবং তাঁর ভক্তশিষ্য বলে আমাকেও মাসের পর মাস আক্রমণ চলছে, গালি-গালাজ ব্যঙ্গ-বিদ্রূপের অবধি নেই—তার ভাষাও যেমন নিষ্ঠুর, অধ্যবসায়ও তেমনি দুর্দাম। কিন্তু কবি নীরব। আমি উত্ত্যক্ত হয়ে একদিন অভিযোগ করায় শান্তকণ্ঠে বলেছিলেন—উপায় কি! যে অস্ত্র নিয়ে ওরা লড়াই করে, সে অস্ত্র স্পর্শ করাও যে আমার চলে না। আর একদিন এমনিই কি একটা কথার উত্তরে বলেছিলেন—যাকে সুখ্যাতি করতে পারিনে, তার নিন্দে করতেও আমার লজ্জা বোধ হয়।
তাঁর কাছে অনেক কিছু শিখেছি—কিন্তু সব চেয়ে বড় এ দুটি আর ভুলিনি। আজ জীবনের পঞ্চান্ন বছর পার করে দিয়ে সকৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করি যে আমি ঠকিনি। বরঞ্চ নিজের অজ্ঞাতসারে লাভের অঙ্কে অনেক জমা পড়েছে। মানুষের শ্রদ্ধা পেয়েছি, ভালবাসা পেয়েছি। বস্তুতঃ এই ত কালচার,—নইলে এর কি আর কোন মানে আছে? ভাষার দখল আমার যেটুকু আছে—হয়তো একটু আছেও—তাকে কি শেষকালে এই দুর্গতির মধ্যে টেনে নামাব?
এবার তোমার সাহিত্যের সম্বন্ধে বড় প্রশ্নটার উত্তর দিই।
তুমি সসঙ্কোচে প্রশ্ন করেছো, “অনেকে বলচেন আপনি ‘শেষ প্রশ্নে’ বিশেষ একটা মতবাদ প্রচার করবার চেষ্টা করেছেন,—একি সত্যি?”
সত্যি কিনা আমি বলবো না। কিন্তু ‘প্রচার করলে, প্রচার করলে—দুয়ো দুয়ো’ বলে রব তুলে দিলেই যারা লজ্জায় অধোবদন হয়, এবং না না বলে তারস্বরে প্রতিবাদ করতে থাকে আমি তাদের দলে নই। অথচ, উলটে যদি আমিই জিজ্ঞাসা করি এতে অতবড় অপরাধটা হলো কিসে, আমার বিশ্বাস বাদী-প্রতিবাদী কেউ তার সুনিশ্চিত জবাব দিতে পারবে না। তখন একপক্ষ বে-বুঝের মতো ঘাড় বেঁকিয়ে কেবলই বলতে থাকবে—ও হয় না—ও হয় না। ওতে art for art’s sake নীতি জাহান্নমে যায়। আর অপর পক্ষের অবস্থাটা হবে আমাদের হরির মত।
গল্পটা বলি। আমার এক দূর সম্পর্কের ভগ্নীর বছর-চারেকের একটি ছেলের নাম হরি,—সাক্ষাৎ শয়তান। মারধর গালিগালাজ, একপায়ে কোণে দাঁড় করিয়ে দেওয়া—কোন উপায়েই তার মা তাকে শাসন করতে পারলে না। বাড়িসুদ্ধ লোকে যখন একপ্রকার হার মেনেছে, তখন ফন্দিটা হঠাৎ কে যে আবিষ্কার করলে জানিনে, কিন্তু হরিবাবু একেবারে শায়েস্তা হয়ে গেল। শুধু বলতে হোতো এবার পাড়ার পাঁচজন ভদ্রলোক ডেকে এনে ওকে অপমান করো। অপমানের ধারণা তার কি ছিল সেই জানে,কিন্তু ভয়ে যেন শীর্ণকায় হয়ে উঠতো।এদেরও দেখি তাই। একবার বললে হোলো—প্রচার করেছে। Art for art’s sake হয়নি। কিন্তু কি প্রচার করেচি, কোথায় করেচি, কি তার দোষ, কোন্ মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে গেল—এ সব প্রশ্নই অবৈধ। তখন কেউবা দিতে লাগলো গালাগালি, কেউবা জোড় হাতে ভগবানের আরাধনায় লেগে গেল—”রূপকার যদি সংস্কারক হয়ে ওঠেন,তবে হে ভগবান ইত্যাদি ইত্যাদি”। ওরা বোধ হয় ভাবেন অনুপ্রাসটাই যুক্তি এবং গালিগালাজটাই সমালোচনা। তাঁদের এ কথা বলা চলবে না যে, জগতের যা’ চিরস্মরণীয় কাব্য ও সাহিত্য, তাতেও কোন না কোন রূপে এ বস্তু আছে। রামায়ণে আছে, মহাভারতে আছে, কালিদাসের কাব্যগ্রন্থে আছে,আনন্দমঠ, দেবীচৌধুরাণীতে আছে, ইবসেন-মেটারলিঙ্ক-টলস্টয়ে আছে, হামসুন-বোয়ার-ওয়েলসে আছে। কিন্তু তাতে কি? পশ্চিম থেকে বুলি আমদানি হয়েছে যে art for art’s sake—এ সব যেন ওদের নখাগ্রে! গল্পের গল্পত্বই মাটি, কারণ চিত্ত-রঞ্জন হোলো না যে! কার চিত্ত-রঞ্জন? না আমার! গাঁয়ের মধ্যে প্রধান কে? না, আমি আর মামা।
তুমি ‘চিত্ত-রঞ্জন’ কথাটা নিয়ে অনেক লিখেচো কিন্তু এটা একবার ভেবে দেখোনি যে ওটা দু’টো শব্দ। শুধু ‘রঞ্জন’ নয়, ‘চিত্ত’ বলেও একটা বস্তু রয়েছে! ও পদার্থটা বদলায়। চিৎপুরের দপ্তরীখানায় ‘গোলেবকাওলির’ স্থান আছে। ও অঞ্চলে চিত্ত-রঞ্জনের দাবী সে রাখে, কিন্তু সেই দাবীর জোরে বার্নার্ড শ’কে গাল দেবার তার অধিকার জন্মায় না।স্বীকার করি যে, বুলি আওড়ানোর মোহ আছে, ব্যবহারে আনন্দ আছে, পণ্ডিতের মতো দেখতেও হয়, কিন্তু উপলব্ধি করার জন্যে দুঃখ স্বীকার করতে হয়। অমুক for অমুক sake বললেই সকল কথার তত্ত্ব নিরূপণ করা হয় না।
নানা কারণে ‘পথের দাবী’ রবীন্দ্রনাথের ভালো লাগেনি। সে কথা জানিয়েও চিঠির শেষের দিকে লিখেছিলেন,“এ বই প্রবন্ধের আকারে লিখিলে মূল্য ইহার সামান্যই থাকিত, কিন্তু গল্পের মধ্যে দিয়া যাহা বলিয়াছ দেশে ও কালে ইহার ব্যাপ্তির বিরাম রহিবে না”। সুতরাং কবি যদি একে গল্পের বই মনে করে থাকেন ত এটা গল্পের-ই বই। অন্ততঃ, এটুকু সম্মান তাঁকে দিয়ো।
উপসংহারে তোমাকে একটা কথা বলি। সমাজ-সংস্কারের কোন দুরভিসন্ধি আমার নাই। তাই, বইয়ের মধ্যে আমার মানুষের দুঃখ-বেদনার বিবরণ আছে, সমস্যাও হয়ত আছে, কিন্তু সমাধান নেই। ও কাজ অপরের, আমি শুধু গল্প লেখক, তাছাড়া আর কিছুই নই।
একটা মিনতি। তুমি অপরিচিতা, বয়সে হয়তো অনেক ছোট। আমি সরল মনে তোমার নানা প্রশ্নের দুই-একটার জবাব যথাশক্তি দিতে চেয়েছি। তবু, অনিচ্ছা সত্ত্বেও দু’-একস্থানে কঠিন যদি কিছু লিখে থাকি রাগ কোরো না।