মনে আছে দাশু রায়ের অনুপ্রাসের ছন্দে গাঁথা দুর্গার স্তব পিতামহের কণ্ঠহারে সেকালে কত বড় রত্নই না ছিল! আজ পৌত্রের হাতে বাসি মালার মত তারা অবজ্ঞাত। অথচ এতখানি অনাদরের কথা সেদিন কে ভেবেছিল?
কিন্তু কেন এমন হয়? কার দোষে এমন ঘটল? সেই অনুপ্রাসের অলঙ্কার ত আজও তেমনি গাঁথা আছে। আছে সবই, নেই শুধু তাকে গ্রহণ করবার মানুষের মন। তার আনন্দবোধের চিত্ত আজ দূরে সরে গেছে। দাশু রায়ের নয়, তার কাব্যেরও নয়, দোষ যদি কোথাও থাকে ত সে যুগধর্মের।
তর্ক উঠতে পারে, শুধু দাশু রায়ের দৃষ্টান্ত দিলেই ত চলে না। চণ্ডীদাসের বৈষ্ণব পদাবলী ত আজও আছে, কালিদাসের শকুন্তলা ত আজও তেমনি জীবন্ত। তাতে শুধু এইটুকুই প্রমাণিত হয় যে, তার আয়ুষ্কাল দীর্ঘ—অতি দীর্ঘ। কিন্তু এর থেকে তার অবিনশ্বরতাও সপ্রমাণ হয় না। তার দোষ-গুণেরও শেষ নিষ্পত্তি করা যায় না।
সমগ্র মানব জীবনে কেন, ব্যক্তিবিশেষের জীবনেও দেখি এই নিয়মই বিদ্যমান। ছেলেবেলায় আমার ‘ভবানী পাঠক’ ও ‘হরিদাসের গুপ্তকথা’ই ছিল একমাত্র সম্বল। তখন কত রস, কত আনন্দই যে এই দুইখানি বই থেকে উপভোগ করেছি, তার সীমা নেই। অথচ, আজ সে আমার কাছে নীরস। কিন্তু এ গ্রন্থের অপরাধ, কি আমার বৃদ্ধত্বের অপরাধ বলা কঠিন। অথচ এমনই পরিহাস, এমনই জগতের বদ্ধমূল সংস্কার যে, কাব্য উপন্যাসের ভালমন্দ বিচারের শেষ ভার গিয়ে পড়ে বৃদ্ধদের পরেই। কিন্তু এ কি বিজ্ঞান ইতিহাস? এ কি শুধু কর্তব্য কার্য, শুধু শিল্প যে, বয়সের দীর্ঘতাই হবে বিচার করবার সবচেয়ে বড় দাবী?
বার্ধক্যে নিজের জীবন যখন বিস্বাদ, কামনা যখন শুষ্কপ্রায়, ক্লান্তি অবসাদে জীর্ণ দেহ যখন ভারাক্রান্ত,—নিজের জীবন যখন রসহীন, বয়সের বিচারে যৌবন কি বার বার দ্বারস্থ হবে গিয়ে তারই?
ছেলেরা গল্প লিখে নিয়ে গিয়ে যখন আমার কাছে উপস্থিত হয়, তারা ভাবে এই বুড়ো লোকটার রায় দেওয়ার অধিকারই বুঝি সবচেয়ে বেশি। তারা জানে না যে, আমার নিজের যৌবনকালের রচনারও আজ আমি আর বড় বিচারক নই।
তাদের বলি, তোমাদের সম-বয়সের ছেলেদের গিয়ে দেখাও। তারা যদি আনন্দ পায়, তাদের যদি ভালো লাগে, সেইটিই জেনো সত্য বিচার।
তারা বিশ্বাস করে না, ভাবে দায় এড়াবার জন্যই বুঝি এ কথা বলচি—তখন নিঃশ্বাস ফেলে ভাবি, বহু যুগের সংস্কার কাটিয়ে উঠাই কি সোজা? সোজা নয় জানি, তবুও বলব, রসের বিচারে এইটেই সত্য বিচার।
বিচারের দিক থেকে যেমন, সৃষ্টির দিক থেকেও ঠিক এই এক বিধান। সৃষ্টির কালটাই হলো যৌবনকাল—কি প্রজা সৃষ্টির দিক দিয়ে, কি সাহিত্য সৃষ্টির দিক দিয়ে | এই বয়স অতিক্রম করে’ মানুষের দূরের দৃষ্টি হয়ত ভীষণতর হয়, কিন্তু কাছের দৃষ্টি তেমনি ঝাপসা হয়ে আসে। প্রবীণতার পাকা বুদ্ধি দিয়ে তখন নীতিপূর্ণ কল্যাণকর বই লেখা চলে কিন্তু আত্মভোলা যৌবনের প্রস্রবণ বেয়ে যে রসের বস্তু ঝরে পড়ে, তার উৎসমুখ রুদ্ধ হয়ে যায়। আজ তিপ্পান্ন বছরে পা দিয়ে আমার এই কথাটাই আপনাদের কাছে সবিনয়ে নিবেদন করতে চাই,—অতঃপর রসের পরিবেশনে ত্রুটি যদি আপনাদের চোখে পড়ে, নিশ্চয় জানবেন তার সকল অপরাধ আমার এই তিপ্পান্ন বছরের।
আজ আমি বৃদ্ধ, কিন্তু বুড়ো যখন হইনি, তখন পূজনীয়গণের পদাঙ্ক অনুসরণ করে অনেকের সাথে ভাষা-জননীর পদতলে যেটুকু অর্ঘ্যের যোগান দিয়েছি, তার বহুগুণ মূল্য আজ দুই হাত পূর্ণ করে আপনারা ঢেলে দিয়েছেন। কৃতজ্ঞ চিত্তে আপনাদের নমস্কার করি।
(১৩৩৫ সালের ভাদ্র মাসে ৫৩তম বাৎসরিক জন্মদিন উপলক্ষে ইউনিভারসিটি ইন্স্টিটিউটে দেশবাসী প্রদত্ত অভিনন্দনের উত্তর।)
২.০৯ অভিভাষণ (২)
আবার একটা বছর গড়িয়ে গেল। জন্মদিন উপলক্ষে সে দিনও এমনই আপনাদের মাঝখানে এসে দাঁড়িয়েছিলাম, সে দিনও এমনি স্নেহ, প্রীতি ও সমিতির একান্ত শুভ কামনায় আজকের মতই হৃদয় পরিপূর্ণ করে’নিয়েছিলুম, শুধু দেশের অত্যন্ত দুর্দিন স্মরণ করে তখন আপনাদের উৎসবের বাহ্যিক আয়োজনকে সঙ্কুচিত করতে অনুরোধ জানিয়েছিলাম। হয়ত আপনারা ক্ষুণ্ণ হয়েছিলেন, কিন্তু অনুরোধ উপেক্ষা করেন নি, সে কথা আমার মনে আছে। দুর্দিন আজও অপগত হয়নি, বরঞ্চ শতগুণে বেড়েচে, এবং কবে যে তার অবসান ঘটবে তাও চোখে পড়ে না, কিন্তু সেই দুর্দশাকেই সব চেয়ে উচ্চস্থান দিয়ে শোকাচ্ছন্ন স্তব্ধতায় জীবনের অন্যান্য আহ্বান
অনির্দিষ্টকাল, অবহেলা করতেও মন আর চায় না। আজ তাই আপনাদের আমন্ত্রণে শ্রদ্ধানত চিত্তে এসে উপস্থিত হয়েছি।
শুনেছি সমিতির প্রার্থনায় কবিগুরু একটুখানি লিখন পাঠিয়েছেন, Liberty-তে তার ইংরেজী তর্জমা প্রকাশিত হয়েছে। তার শেষের দিকে আমার অকিঞ্চিৎকর সাহিত্য-সেবার অপ্রত্যাশিত পুরস্কার আছে। এ আমার সম্পদ। তাঁকে নমস্কার জানাই, এবং সমিতির হাত দিয়ে একে পেলাম বলে আপনাদের কাছে আমি কৃতজ্ঞ।
এই লেখাটুকুর মধ্যে রবীন্দ্রনাথ বাঙ্গালার কথা-সাহিত্যের ক্রমবিকাশের একটুখানি সংক্ষিপ্ত পরিচয় দিয়েছেন। বিস্তারিত বিবরণও নয়, দোষগুণের সমালোচনাও নয়, কিন্তু এরই মধ্যে চিন্তা করার, আলোচনা করার, বাঙ্গালা সাহিত্যের ভবিষ্যৎ দিক্-নির্ণয়ের পর্যাপ্ত উপাদান নিহিত আছে। কবি বঙ্কিমচন্দ্রের ‘আনন্দমঠের’ উল্লেখ করে বলেছেন, ‘বিষবৃক্ষ’ ও ‘কৃষ্ণকান্তের উইলের’ তুলনায় এর সাহিত্যিক মূল্য সামান্যই। এর মূল্য স্বদেশ-হিতৈষণায়, —মাতৃভূমির দুঃখ-দুর্দশার বিবরণে, তার প্রতিকারের উপায় প্রচারে, তার প্রতি প্রীতি ও ভক্তি আকর্ষণে। অর্থাৎ, ‘আনন্দমঠে’ সাহিত্যিক বঙ্কিমচন্দ্রের সিংহাসন জুড়ে বসেছে প্রচারক ও শিক্ষক বঙ্কিমচন্দ্র। বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাস সম্বন্ধে এমন কথা, বোধ করি এর পূর্বে আর কেউ বলতে সাহস করেনি।