ভক্ত-বাক্যের মত প্রামাণ্য সাক্ষ্য আর কি আছে? অতএব, তাঁহার নিশ্চয় বিশ্বাস জন্মিয়াছে আধুনিক সাহিত্যে কেবল সত্যের নাম দিয়া নর-নারীর যৌনমিলনের শারীর ব্যাপারটাকেই অলঙ্কৃত করা চলিয়াছে। তাহাতে লজ্জা নাই, শরম নাই, শ্রী নাই, সৌন্দর্য নাই, রস-বোধের বাষ্প নাই,—আছে শুধু ফ্রয়েডের সাইকো-এনালিসিস। অথচ, যে-কোন সাহিত্যিককেই যদি তিনি ডাকিয়া পাঠাইয়া জিজ্ঞাসা করিতেন ত শুনিতে পাইতেন তাহারা প্রত্যেকেই জানে যে, সত্যমাত্রই সাহিত্য হয় না, জগতে এমন অনেক নোংরা সত্য ঘটনা আছে যে তাহাকে কেন্দ্র করিয়া কোন মতেই সাহিত্য রচনা করে চলে না।
কবির হঠাৎ চোখে পড়িয়াছে যে, সজিনা, বক, কুমড়া প্রভৃতি কয়েকটা ফুল কাব্যে স্থান পায় নাই। গোলাপজাম ফুলও না, যদিচ সে, শিরীষ ফুলের সর্ববিষয়েই সমতুল্য। কারণ? না, সেগুলো মানুষে খায়! রান্নাঘর তাহাদের জাত মারিয়াছে। তাই উদাহরণের জন্য ছুটিয়া গিয়াছেন গঙ্গাদেবীর মকরের কাছে। অথচ, হাতের কাছে বাগ্দেবীর বাহন হাঁস খাইয়া যে মানুষে উজাড় করিয়া দিল, সে তাঁহার চোখে পড়িল না! কুমুদ ফুলের বীজ হইতে ভেটের খৈ হয়, এমন যে পদ্ম তাহারও বীজ লোকে ভাজিয়া খাইতে ছাড়ে না। তিল ফুলের সহিত নাসিকার, কদলী বৃক্ষের সহিত সুন্দরীর জানুর উপমা কাব্যে বিরল নহে। অথচ, সুপক্ক মর্তমান রম্ভার প্রতি বিতৃষ্ণার অপবাদ কোন কবির বিরুদ্ধেই শুনি নাই। আজ নরেশচন্দ্র বৃথাই তাঁহাকে স্মরণ করাইয়া দিতে গিয়াছেন যে, বিম্বফল অনেকে তরকারি রাঁধিয়া খায়। উত্তরে কবি কি বলিবেন জানি না, কিন্তু তাঁহার ভক্তরা হয়ত ক্রুদ্ধ হইয়া জবাব দিবেন, খাওয়া অন্যায়। যে খায় সে সৎ-সাহিত্যের প্রতি বিদ্বেষ-বুদ্ধিবশতঃই এরূপ করে।
কিন্তু এই লইয়া প্রবন্ধের কলেবর বৃদ্ধি করা নিরর্থক! এগুলি যুক্তিও নয়, তর্কও নয়, কোন কাজেও লাগে না। অথচ, এই ধরনের গোটা-কয়েক এলোমেলো দৃষ্টান্ত আহরণ করিয়া কবি চিরদিনই জোর করিয়া বলেন, এর পরে আর সন্দেহ-ই থাকতে পারে না যে, আমি যা বোলচি তাই ঠিক এবং তুমি যা বোলচ সেটা ভুল।
কিন্তু এ কথাও আমি বলি না যে, আধুনিক বাঙ্গালা সাহিত্যে দুঃখ করিবার আদৌ কারণ ঘটে নাই, কিংবা রবীন্দ্রনাথের এবংবিধ মনোভাব একেবারেই আকস্মিক। তাঁহার হয়ত মনে নাই, কিন্তু বছর-কয়েক পূর্বে আমাকে একবার বলিয়াছিলেন যে, সে দিন তাঁহার বিদ্যালয়ের একটি বারো-তেরো বছরের ছাত্র ‘পতিতা’র সম্বন্ধে একটা গল্প লিখিয়াছে।
আমার ছেলেবেলার একটা ঘটনা মনে পড়ে। আমাদের ছোড়দা হঠাৎ কবি-যশোলুব্ধ হইয়া কাব্য-কলায় মনোনিবেশ করিলেন। এবং বাঙ্গালা ভাষায় গভীর ভাব প্রকাশের যথেষ্ট সুবিধা হয় না বলিয়া ইংরাজী ভাষাতেই কবিতা রচনা করিলেন। রচনা করিলেন কি চুরি করিলেন জানি না, কিন্তু কবিতাটি আমার মনে আছে :
A lion killed a mouse
And carried it into his house;
Then cried his mother,
And therefore cried his sister!
ছন্দ ও ভাবের দিক দিয়া কবিতাটি অনবদ্য। কিন্তু তুমুল তর্ক উঠিল, ‘মাদার’ কার? সিঙ্গীর না ইঁদুরের? বড় বৌঠাকরুন ক্ষণকাল কান পাতিয়া শুনিয়া বলিলেন, না না ওদের নয়। ও কবির ‘মাদার’। ‘পতিতা’ গল্প রচনার বিবরণ শুনিলে বৌঠাকরুন হয়ত বলিবেন, এ ক্ষেত্রে কাঁদা উচিত ব্রহ্মচর্য বিদ্যালয়ের কর্তৃপক্ষদের। আর কাহারও নয়। এ ত গেল অসাধু-সাহিত্যের দিক। আবার সাধু-সাহিত্যের দিকেও তরুণ কবির অভাব নাই। এদিকে যিনিই কবিতা বা গান লেখেন, তিনিই লেখেন, তোমার বীণা আমার তারে বাজিতেছে। পাতার ফাঁকে ফাঁকে তোমার ঝিলিক-মারা অরূপমূর্তিটি দেখিতে পাইতেছি, বুকের মাঝে তোমার নিঃশব্দ পদধ্বনি শুনিতে পাইতেছি, খেয়ার ঘাটে বসিয়া সন্ধ্যা হইয়া আসিল, কাণ্ডারি! এখন পার কর। ইত্যাদি।
একটা উদাহরণ দিই। ভাদ্র মাসের ‘কেতকী’ পত্রিকার গান ছাপা হইয়াছে :
তোমার ভাঙার গানে তোমায় নেব চিনি
পরাণ পাতি শুনবো পায়ের রিনিঝিনি!
(তোমার) কালবোশেখীর ঝড়ে তোমায় নেব দেখে
(তোমার) শ্রাবণ-ধারা অঙ্গে আমার নেব মেখে।
(আমার) বুকের মাঝে তোমার আঘাত চিহ্নখানি—
আমার রোদনের মাঝে তোমার দৈববাণী!
ভুল করে’ যে ভুলবো তোমায় হ’বে না তা’
(তোমার) আঘাত এলে কোথায় বা তার
লুকাবো ব্যথা?
আমার ছড়িয়ে প’ল সকল খানে—
সারা বুকে
আমার জড়িয়ে গেল সকল হিয়া
দুঃখে সুখে!
সেথায় আমি তোমায় খুঁজে নেব চিনি—
(আমার) পরাণ পাতি শুন্বো নূপুর রিনিঝিনি।
উপরের উদ্ধৃত ইংরাজী কবিতাটির ন্যায় এ গানখানিও অনবদ্য, কি ঝঙ্কারে, কি ভাবের গভীরতায়, কি বৈরাগ্যের বেদনায়! ‘কেতকী’র তরুণ সম্পাদককে জিজ্ঞাসা করিলাম, রচয়িতার বয়স কত? সে বন্ধু-গৌরবে মুখ উজ্জ্বল করিয়া কহিল, আজ্ঞে, পোনর-ষোলর বেশি নয়!
মনে মনে দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলিয়া ভাবিলাম, দেশ-সুদ্ধ সাহিত্যিক বালক-বালিকার দল যখন প্রহ্লাদ হইয়াই উঠিল, এবং ‘ক’ লিখিতে কৃষ্ণ স্মরণ করিয়া কাঁদিয়া আকুল হইতে লাগিল, তখন ওরে অতিবৃদ্ধ! এক মাথা পাকাচুল লইয়া আর বাঁচিয়া আছিস কিসের জন্য?
সাহিত্য-সৃষ্টি অনুকরণের মধ্যে নাই। ভালোরও না, মন্দেরও না। হৃদয়ের সত্যকার অনুভূতি আনন্দ ও বেদনার আলোড়নে অলঙ্কৃত বাক্যে বিকশিত হইয়া না উঠিলে সে সাহিত্য পদবাচ্য হয় না। বৃদ্ধ কবির গীতাঞ্জলিও যত বড় কাব্যগ্রন্থ তাঁহার যৌবনের চিত্রাঙ্গদাও ঠিক তত বড়ই কাব্য-সৃষ্টি। লাঞ্ছনার আঘাত ও গৌরবের মালা যেমন করিয়াই তাঁহার শিরে বর্ষিত হউক না। অথচ, অনুভূতিহীন বাক্য যত অলঙ্কৃতই হউক ব্যর্থ। পতিতার অনুকরণও ব্যর্থ, গীতাঞ্জলির অনুকরণও ঠিক ততখানিই ব্যর্থ। দেশের সাহিত্যসম্পদ ইহাতে কণামাত্রও বর্ধিত হয় না।