সর্বপ্রকার সভা-সমিতিতেই গতিবিধি আমার অল্প। কখনো বা খবর পাই না বলিয়া, এবং কখনো বা পারিয়া উঠি না বলিয়াই যাওয়া হয় না। অতএব সাহিত্যের নাম দিয়া দেশের মধ্যে সচরাচর যে-সকল দরবার বসে, সেখানে ঠিক যে কি-সব হয় আমি জানি না। তবে, ঘরে বসিয়া সংবাদপত্রাদির মারফতে যে-সকল তথ্য পাই তাহা হইতে মোটামুটি একটা ধারণা জন্মিয়াছে। আজিকার এই সমবেত সাহিত্যিকগণের সম্মুখে আমি সবিনয়ে তাহারই কিঞ্চিৎ আভাস দিবার চেষ্টা করিব।
বহু ধনীর সমাগমে আড়ম্বর-বহুল দেশের এই-সকল সাহিত্যিক-জনতায় দরিদ্র সাহিত্যিকগণ উপস্থিত হন কি না আমি নিশ্চয় জানি না। এবং হইলেও, কিছু তাঁহারা তথায় বলিবার প্রয়াস করেন কি না, তাহাও অবগত নই। হয়ত কিছু বলেন, কিন্তু সভার একান্ত হইতে নিরন্ন, নিছক-সাহিত্যসেবীর ক্ষীণকণ্ঠ প্রবল পক্ষের উদ্দাম কোলাহলে খুব সম্ভব ঢাকা পড়িয়া যায়—তাঁহাদের কথা আমাদের কানে পৌঁছে না।
কিন্তু কণ্ঠ যাঁহাদের চাপা পড়ে না,—কথা যাঁহাদের সাধারণের কানে ঢাকের মত পিটিতে থাকে,—গলায় তাঁহাদের জোর আছে বলিয়া আমি দ্বেষ করি না, কিংবা সাহিত্য-সাধনায় বৎসরের তিন শ’ চৌষট্টি দিনই সাহিত্যিকগণকে অকাতরে ছাড়িয়া দিয়া কেবল মাত্র একটি দিন যাঁহারা নিজেদের হাতে রাখিয়াছেন, এইরূপ বিনীত ও উদার ব্যক্তিদের প্রতি ঈর্ষা হওয়াও সম্ভবপর নয়। কিন্তু এই একটা মাত্র দিনের উদ্যম যখন তাঁহাদের সকল সীমা অতিক্রম করিয়া যায়, তখন দুই-একটা কথা বলিবার প্রয়োজন হইয়া পড়ে।
এইখানে আমি একটা কথা ভাল করিয়া বলিয়া রাখিতে চাই যে, কোন ব্যক্তি বা সমিতিবিশেষকে লক্ষ্য করিয়া আমি একটা কথাও বলিতেছি না। কারণ, ইহা বিশেষ কোন লোক বা বিশেষ কোন সমিতির খেয়ালের ব্যাপার হইলে বলার কোন প্রয়োজনই হইত না। আমি সাধারণভাবেই আমার মন্তব্য প্রকাশ করিতেছি।
আমি লক্ষ্য করিয়াছি যে, সাহিত্য রচনার কাজটাকে বাহুল্য মনে করিয়া যাঁহারা ইহার সমালোচনার কাজে মনোনিবেশ করিয়াছেন, বক্তব্য তাঁহাদের প্রধানতঃ দুইটি। অন্য শাখা-প্রশাখা অনেক আছে,—সে কথা পরে হইবে।
প্রথমে তাঁহারা বলেন যে, বাঙ্গালা ভাষার মত ভাষা আর কাহার আছে? আমাদের সাহিত্য বিশ্ব-সাহিত্যে স্থান পাইয়াছে; আমাদের সাহিত্য ‘নোবেল প্রাইজ’ পাইয়াছে; এমন কি আমাদের সাহিত্য যে খুব ভালো, এ কথা বিলাতের সাহেবরা পর্যন্ত বলিতেছে। পঞ্চাশ বৎসরের মধ্যে এতবড় উন্নতি কোন্ দেশে আর কবে করিয়াছে?
তাঁহাদের দ্বিতীয় বক্তব্য এই যে, বাঙ্গালা সাহিত্য রসাতলে গেল,—আর বাঁচে না। আবর্জনায় বাঙ্গালা সাহিত্য বোঝাই হইয়া উঠিল, আমাদের কথা কেহ শুনে না; হায়! হায়! বঙ্কিমচন্দ্র বাঁচিয়া নাই, মুগুর মারিবে কে? ঝুড়ি ঝুড়ি নাটক নভেল ও কবিতা বাহির হইতেছে, তাহাতে সুশিক্ষা নাই—তাহা নিছক দুর্নীতিপূর্ণ। ইহার কুফলও স্পষ্ট দেখা যাইতেছে। কারণ প্রত্নতত্ত্বের যে-সকল বই এখনও লেখা হয় নাই, তাহার প্রতি পাঠকদিগের আগ্রহ দেখা যাইতেছে না, এবং ইতিহাস, বিজ্ঞান প্রভৃতি ভাল ভাল বই পাঠকদিগের উৎসাহের অভাবে লেখাই হইতেছে না।
অবশ্য আমি স্বীকার করি, যে-সকল বই লেখা হয় নাই, তাহা না পড়িবার প্রায়শ্চিত্ত কি আমি জানি না, এবং পাঠকের আগ্রহের অভাবে যে-সকল পণ্ডিত ব্যক্তিদের বই লেখা বন্ধ হইয়া আছে, ইহারই যে কি উপায় আছে, তাহাও আমার গোচর নয়, কিন্তু ঝুড়ি ঝুড়ি বই লেখা সম্বন্ধে আমার কিছু বলিবারও আছে এবং বোধ হয় বলিবার সামান্য দাবীও আছে।
যাঁহারা এই অভিযোগ আনেন তাঁহারা কখনো কি হিসাব করিয়া দেখিয়াছেন বাস্তবিক কয়টা বই মাসে মাসে বাহির হয়? ভাল ও মন্দে মিলাইয়া আজ পর্যন্ত কয়খানা নাটক, নভেল ও কবিতার বই বঙ্গভাষায় প্রকাশিত হইয়াছে এবং তাহাদের সংখ্যা কত? বঙ্গসাহিত্য আমাদের বিশ্ব-সাহিত্যে জায়গা লইয়াছে জানি, কিন্তু শুধু কেবল আমরাই ত নয়, আরও ত কেহ কেহ আছেন বিশ্ব-সাহিত্যে যাঁহারা আমাদেরই মত স্থান পাইয়াছেন, তাঁহাদের নাটক নভেলের তুলনায় কয়খানা নাটক নভেল বাঙ্গালায় আছে? কবিতার বই বা কয়টা বাহির হইয়াছে? নাটক নভেলে বাঙ্গালা দেশ প্লাবিত হইয়া গেল, এ বুলি কে আবিষ্কার করিয়াছিলেন আমি জানি না, কিন্তু এখন যে-কেহ দেখি আপনাকে বঙ্গ-সাহিত্যের বিচারক বলিয়া স্থির করেন, তিনিই এই বুলি নির্বিচারে আবৃত্তি করিয়া যান, মনে করেন, সমঝদার বলিয়া খ্যাতি অর্জন করিবার ইহার চেয়ে বড় পথ আর নাই।
কথায় কথায় তাঁহারা বিশ্ব-সাহিত্যের উল্লেখ করেন, কিন্তু বিশ্ব-সাহিত্যের সহিত সত্যকার পরিচয় যদি তাঁহাদের থাকিত, ত জানিতেন যাহাকে তাঁহারা আবর্জনা বলিয়া ঘৃণা প্রকাশ করেন, সেই আবর্জনাই সকল সাহিত্যের বনিয়াদ, তাহারাই সাহিত্যের অস্থি-মজ্জা। মেঘদূত, চণ্ডীদাস, গীতাঞ্জলি কোন সাহিত্যেই ঝুড়ি ঝুড়ি সৃষ্টি হয় না। এবং আবর্জনা থাকে বলিয়াই ইহাদের জন্মলাভ সম্ভবপর হইয়াছে; না হইলে হইত না। আবর্জনার বালাই যেদিন দূর হইবে, সেদিন যাহাকে তাঁহারা সারবস্তু বলিতেছেন, সেও সেই পথেই অন্তর্হিত হইবে। আবর্জনা চিরজীবী হইয়া থাকে না, নিজের কাজ করিয়া সে মরে, সেই তাহার প্রয়োজন, সেই তাহার সার্থকতা। কিন্তু সেই আবর্জনার ভার বহিতে যেদিন দেশ অস্বীকার করিবে, সেদিন আনন্দ করিবার দিন নহে, সেদিন দেশের দুর্দিন।