দিলীপ বলিতেছেন, “যে আসলটুকু আমরা উত্তরাধিকারসূত্রে পেয়েছি,–তাকে হয় সুদে বাড়াও, না হয় আসলটুকু খোয়া যাবে, এই হচ্চে জ্ঞানরাজ্যের ও ভাবরাজ্যের চিরন্তন রহস্য।”
প্রমথবাবু বলিতেছেন, “এ সাধারণ সত্য আমরা সকলেই জানি।” জানিই ত।
পুনশ্চ বলিতেছেন, “কিন্তু সৃজন কাজটা এত সোজা নয় যে, যে-কেউ ইচ্ছা করলেই পারবে। এ পৃথিবী এত উর্বর হলে …। হিন্দুস্থানী সঙ্গীতের ধারায় যদি পঞ্চাশ-ষাট বৎসর কোন নূতন সৃষ্টি না হয়ে থাকে তাহলে সেটা এতবড় দীর্ঘকাল নয় যে, আমাদের অধীর হয়ে উঠতে হবে।”
আমারও ইহাই অভিমত। আমাদের চুল পাকিয়াছে, দিলীপের পাকে নাই। আমরা উভয়ে সমস্বরে বলিতেছি, অধীর হইয়া ছটফট করা অন্যায়। পৃথিবী অত উর্বর নয়। পঞ্চাশ-ষাট বছরের বেশি হয় নাই যে, ইহারই মধ্যে ছটফট করিবে! আর যতই কেন কর না, কিছুই হইবে না সে স্পষ্টই বলিয়া দিতেছি,–ইহাতে ঝাপসা কিছুই নাই।
কিন্তু ইহার পরেই যে প্রমথবাবু বলিতেছেন, “যখন কোন স্রষ্টা সৃষ্টির প্রতিভা নিয়ে আসবে, তখন সে সৃষ্টি করবেই, শৃঙ্খল ভাঙবেই, অচলায়তন ভূমিসাৎ করবেই–তাকে কেউ ঠেকিয়ে, কেউ দাবিয়ে রাখতে পারবে না …”। প্রমথবাবুর এ উক্তি আমি সত্য বলিয়া স্বীকার করিতে পারি না, কারণ সংসারে কয়টা লোকে আমার নাম জানিয়াছে? কয়টা লোক আমাকে স্বীকার করিতেছে? ও-পাড়ার মনু দত্ত যে মনু দত্ত, সে পর্যন্ত আমাকে দাবাইয়া রাখিয়াছে! পৃথিবীতে অবিচার বলিয়া কথাটা তবে আছে কেন? যাক, এ আমার ব্যক্তিগত কথা। নিজের সুখ্যাতি নিজের মুখে করিতে আমি বড়ই লজ্জা বোধ করি।
কিন্তু ইহার পরেই প্রমথবাবু দীর্ঘ অভিজ্ঞতায় উচ্চ-সঙ্গীত সম্বন্ধে যে সত্য ব্যক্ত করিয়াছেন, তাহা অস্বীকার করিবার সাধ্য কাহারও নাই। প্রমথবাবু বলিতেছেন, “ভারতের উচ্চ-সঙ্গীত ভাবসঙ্গত। কেবল সা রে গা মা পর্দা টিপে শ্রুতি-সুখকর শব্দ-পরম্পরা উৎপন্ন করলেই সে সঙ্গীত হয় না। এক কথায় রাগ-রাগিণীর ঠাট বা কাঠাম ভাবগত, পর্দাগত নয়।”
আমিও ইহাই বলি, এবং আমাদের নাগ মহাশয়েরও ঠিক তাহাই অভিমত। তিনি পঞ্চাশোর্ধ্বে লড়াইয়ের বাজারে অর্থশালী হইয়া একটা হারমোনিয়ম কিনিয়া আনিয়া নিরন্তর এই সত্যই প্রতিপন্ন করিতেছেন।
তিনি স্পষ্টই বলেন, সা রে গা মা আর কিছুই নয়, সা’র পরে জোরে চেঁচাইলেই রে হয়, এবং আরও একটু চেঁচাইলে গা হয়, এবং আর ও জোর করিয়া একটুখানি চেঁচাইলে গলায় মা সুর বাহির হয়। খুব সম্ভব, তাঁহারও মতে উচ্চ সঙ্গীত ‘ভাবগত’, ‘পর্দাগত’ নয়। এবং ইহাই সপ্রমাণ করিতে হারমোনিয়মের চাবি টিপিয়া ধরিয়া নাগ মহাশয় ভাবগত হইয়া যখন উচ্চাঙ্গ-সঙ্গীতের শব্দ-পরম্পরা সৃজন করিতে থাকেন, সে এক দেখিবার শুনিবার বস্তু। শ্রীযুক্ত প্রমথবাবুর সঙ্গীত-তত্ত্বের সহিত তাঁহার যে এতাদৃশ মিল ছিল, আমিও এতদিন তাহা জানিতাম না। আর তখন দ্বারদেশে যে প্রকারের ভিড় জমিয়া যায় তাহাতে প্রমথবাবুর উল্লিখিত ওস্তাদজীর রেয়াজের গল্পটির সহিত এমন বর্ণে বর্ণে যে সাদৃশ্য আছে তাহাও লক্ষ্য করিবার বিষয়।
প্রমথবাবু বলিতেছেন, “যে চালের ধ্রুপদ লুপ্তপ্রায় হয়েছে, এবং যা লুপ্ত হয়ে গেলেও দিলীপকুমারের মতে আক্ষেপ করবার কিছুই নেই, আমার মতে সেই হচ্চে খাঁটি উঁচুদরের ধ্রুপদ। এ ধ্রুপদের নাম খাণ্ডারবাণী ধ্রুপদ!”
ঠিক তাহাই। আমারও মতে ইহাই খাঁটি উঁচুদরের ধ্রুপদ। এবং, মনে হইতেছে নাগ মহাশয় সম্প্রতি এই খাণ্ডারবাণী ধ্রুপদের চর্চাতেই নিযুক্ত আছেন। তাঁহার জয় হউক।
বৈশাখের ‘ভারতী’তে দিলীপকুমার কোন্ ওস্তাদজীকে মল্লযোদ্ধা এবং কোন্ ওস্তাদজীর গলায় বেসুরা আওয়াজ বাহির হইবার কথা লিখিয়াছেন, আমি পড়ি নাই কিন্তু অনেকের সম্বন্ধেই যে এই দু’টি অভিযোগই সত্য, তাহা আমিও আমার দীর্ঘ অভিজ্ঞতায় সত্য বলিয়া জানি। প্রমথবাবু বাঙ্গালাদেশের প্রতি প্রসন্ন নহেন। চাটুয্যে-বাঁড়ুয্যে মশায়ের মুখের গান তাঁহার ভাল লাগে না, কিন্তু বেশিদিনের কথা নয়, এই দেশেরই একজন চক্রবর্তীমশাই ছিলেন, প্রমথবাবুর বোধ করি তাঁহাকে মনে নাই।
প্রমথবাবু লিখিতেছেন, “যে জন্য আলাপের পর ধ্রুপদ, ধ্রুপদের পর খেয়াল এবং খেয়ালের পর টপ্পা ঠুংরির সৃষ্টি হয়েছিল, সেই জন্যই ওই-সবের পর বাঙ্গালা দেশে কীর্তন, বাউল ও সারি গানের সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু এই শেষোক্ত তিন রীতির সঙ্গীত আমার খাঁটি বাঙ্গালার জিনিস হলেও উচ্চ-সঙ্গীতের তরফ থেকে আমি তাদের বিকাশকে অভিনন্দন করতে পারি না। কেন?”
কেন? কেননা আমরা বলচি যে “তারা অতীতের সঙ্গে যোগভ্রষ্ট!”
কেন? কেননা আমরা বলচি “তারা অনেকটা ভুঁই-ফোঁড়ের মত নিজের বিচ্ছিন্ন অহঙ্কারে ঠেলে উঠেছে।” এমন কি একজনের পাকা চুল এবং আর একজনের ন্যাড়া মাথার অহঙ্কারের উপরেও।
কেন? কেননা, “আজকাল এইটেই বড় মজা দেখতে পাই যে, অতীতকে তুচ্ছ করে কেবল প্রতিভার জোরে ভবিষ্যৎ গড়তে আমরা সকলেই ব্যগ্র!”
শুধু প্রতিভার জোরে ভবিষ্যৎ গড়বে? সাধ্য কি! আমরা পাকা চুল এবং ন্যাড়া মাথা বলচি সে হবে না! বাধা আমরা দেবই দেব!
“আজকাল প্রতীচ্যের অনেক বিজাতীয় সঙ্গীতের স্রোত এমনি ভাবে আমাদের মনের মধ্যে ঢুকে পড়েচে যে, আমরা যখনই আমাদের প্রাচ্য সঙ্গীতের চাল বা প্রকাশ-ভঙ্গীকে এতটুকু বিচিত্র করতে যাই তখনই তা একটা জগাখিচুড়ি হয়ে ওঠে।”