পরিপূর্ণ মনুষ্যত্ব সতীত্বের চেয়ে বড়, এই কথাটা একদিন আমি বলেছিলাম। কথাটাকে যৎপরোনাস্তি নোংরা করে তুলে আমার বিরুদ্ধে গালিগালাজের আর সীমা রইল না। মানুষ হঠাৎ যেন ক্ষেপে গেল। অত্যন্ত সতী নারীকে আমি চুরি, জুয়াচুরি, জাল ও মিথ্যা সাক্ষ্য দিতে দেখেছি এবং ঠিক এর উল্টোটা দেখাও আমার ভাগ্যে ঘটেছে। এ সত্য নীতি-পুস্তকে স্বীকার করার আবশ্যকতা নেই। কিন্তু বুড়ো ছেলেমেয়েকে যদি গল্পচ্ছলে এই নীতিকথা শেখানোর ভার সাহিত্যকে নিতে হয়, ত আমি বলি, সাহিত্য না থাকাই ভাল। সতীত্বের ধারণা চিরদিন এক নয়। পূর্বেও ছিল না, পরেও হয়ত একদিন থাকবে না। একনিষ্ঠ প্রেম ও সতীত্ব যে ঠিক একই বস্তু নয়, এ কথা সাহিত্যের মধ্যেও যদি স্থান না পায়, ত এ সত্য বেঁচে থাকবে কোথায়?
সাহিত্যের সুশিক্ষা, নীতি ও লাভালাভের অংশটাই এতক্ষণ ব্যক্ত করে এলাম। যেটা তার চেয়েও বড়,—এর আনন্দ, এর সৌন্দর্য, নানা কারণে তার আলোচনা করবার সময় পেলাম না। শুধু একটা কথা বলে রাখতে চাই যে, আনন্দ ও সৌন্দর্য কেবল বাহিরের বস্তুই নয়। শুধু সৃষ্টি করবার ত্রুটিই আছে, তাকে গ্রহণ করবার অক্ষমতা নাই, এ কথা কোন মতেই সত্য নয়। আজ একে হয়ত অসুন্দর আনন্দহীন মনে হতে পারে; কিন্তু ইহাই যে এর শেষ কথা নয়, আধুনিক-সাহিত্য সম্বন্ধে এ সত্য মনে রাখা প্রয়োজন।
আর একটি মাত্র কথা বলেই আমার বক্তব্য শেষ করব। ইংরাজীতে Idealistic ও Realistic বলে দু’টো বাক্য আছে। সম্প্রতি কেউ কেউ এই অভিযোগ উত্থাপিত করেছেন যে, আধুনিক বঙ্গ-সাহিত্য অতিমাত্রায় realistic হয়ে চলেছে। একটাকে বাদ দিয়ে আর একটা হয় না। অন্ততঃ উপন্যাস যাকে বলে, সে হয় না। তবে কে কতটা কোন ধার ঘেঁষে চলবে, সে নির্ভর করে সাহিত্যিকের শক্তি ও রুচির উপরে। তবে একটা নালিশ এই করা যেতে পারে যে, পূর্বের মত রাজারাজড়া, জমিদারের দুঃখ-দৈন্যদ্বন্দ্বহীন জীবনেতিহাস নিয়ে আধুনিক সাহিত্যসেবীর মন আর ভরে না! তারা নীচের স্তরে নেমে গেছে। এটা আপসোসের কথা নয়। বরঞ্চ এই অভিশপ্ত, অশেষ দুঃখের দেশে, নিজের অভিমান বিসর্জন দিয়ে রুশ-সাহিত্যের মত যে দিন সে আরও সমাজের নীচের স্তরে নেমে গিয়ে তাদের সুখ, দুঃখ, বেদনার মাঝখানে দাঁড়াতে পারবে, সে দিন এই সাহিত্য-সাধনা কেবল স্বদেশে নয়, বিশ্ব-সাহিত্যেও আপনার স্থান করে নিতে পারবে।
কিন্তু আর না। আপনাদের অনেক সময় নিয়েছি, আর নিতে পারব না। কিন্তু বসবার আগে আর একটা কথা জানাবার আছে। বাঙ্গালার ইতিহাসে এই বিক্রমপুর বিরাট গৌরবের অধিকারী। বিক্রমপুর পণ্ডিতের স্থান, বীরের লীলাক্ষেত্র, সজ্জনের জন্মভূমি। আমার পরম শ্রদ্ধাস্পদ চিত্তরঞ্জন এই দেশেরই মানুষ। মুন্সীগঞ্জে যে মর্যাদা আপনারা আমাকে দিয়েছেন, সে আমি কোনদিন বিস্মৃত হব না। আপনারা আমার সকৃতজ্ঞ নমস্কার গ্রহণ করুন।
(১৩৩১ সালের চৈত্র মাসে মুন্সীগঞ্জে সাহিত্য-সভার সভাপতির অভিভাষণ।)
২.০৫ ভারতীয় উচ্চ-সঙ্গীত
বিগত আষাঢ় মাসের ‘ভারতবর্ষে’ শ্রীযুক্ত দিলীপকুমার রায় লিখিত ‘সঙ্গীতের সংস্কার’ শীর্ষক একটি প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়। ইহার একটি প্রতিবাদমূলক প্রবন্ধ শ্রীযুক্ত প্রমথনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় মহাশয় ভারতবর্ষে ছাপিবার জন্য পাঠান। কিন্তু লেখক কি কারণে জানেন না, তাঁহার দুর্ভাগ্যক্রমে উক্ত প্রতিবাদ-প্রবন্ধ ফেরত আসায় “বাধ্য হয়ে গরম গরম প্রবন্ধটি একেবারে জুড়িয়ে যাবার আগে তাকে ‘বঙ্গবাণীর’ উদার অঙ্কে ন্যাস্ত” করেছেন। প্রবন্ধটি ‘বঙ্গবাণীর’ মাঘের সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছে।
শ্রীযুক্ত প্রমথবাবু তাঁহার প্রবন্ধের একস্থানে লিখিয়াছেন—“আমি সেই প্রত্নতত্ত্ববিৎকে বেশি তারিফ করি যে একখানি তাম্রশাসন খুঁড়ে বের করেছে ও পড়েচে—কিন্তু সে কবিকেও তারিফ করি না যে নতুনের গান না গেয়ে কেবল ‘নতুন কিছু করো’র গান গেয়েছে।” প্রবন্ধটি কেন যে ফেরত আসিয়াছে বুঝা কঠিন নয়। খুব সম্ভব ভারতবর্ষের বুড়া সম্পাদক দিলীপকুমারের প্রবন্ধের প্রতিবাদে তাঁহার স্বর্গগত বন্ধু, দিলীপের পিতার প্রতি এই অহেতুক কটাক্ষ হজম করিতে পারেন নাই। এবং সেই কবি নূতন গান না গেয়ে “শুধু কেবল ‘নতুন কিছু করোর’ গানই গেয়েছেন”—প্রমথবাবুর এই উক্তিটিকে অসত্য জ্ঞান করে তাঁহার প্রেরিত এই উচ্চাঙ্গের প্রবন্ধটিকে ত্যাগ করে থাকেন ত তাঁহাকে দোষ দেওয়া যায় না।
সে যা হউক, না ছাপিবার কি কারণ তা তিনিই জানেন কিন্তু দিলীপকুমারের বিরুদ্ধে অধিকাংশ বিষয়েই প্রমথবাবুর সহিত আমি যে একমত তাহাতে লেশমাত্র সন্দেহ নাই। এমন কি ষোল আনা বলিলেও অত্যুক্তি হইবে না। প্রমথবাবু হিন্দুস্থানী সঙ্গীত লইয়া চুল পাকাইয়াছেন, তথাপি দিলীপের বক্তব্যের অর্থগ্রহণ করা শক্তিতে তাঁহার কুলায় নাই। প্রমথবাবু বলিতেছেন তিনি কথার কারবারী নহেন, সুতরাং ‘বিনাইয়া নানা ছাঁদে’ কথা বলিতে পারিবেন না–তবে মোদ্দা কথায় গালিগালাজ যা করিবেন তাহাতে ঝাপসা কিছুই থাকিবে না।
প্রমথবাবুর চুল পাকিয়াছে, আমার আবার তাহা পাকিয়া ঝরিয়া গেছে। দিলীপ বলিতেছেন, “আমাদের সঙ্গীতে ‘একটা নূতন কিছু’ করার সময় এসেছে, তা আমাদের সঙ্গীত যতই বড় হোক–কেন না প্রাণধর্মের চিহ্নই গতিশীলতা।” কিন্তু বলিলে কি হইবে? দিলীপের যখন একগাছিও চুল পাকে নাই, তখন এ–সকল কথা আমরা গ্রাহ্যই করিব না।