গোবিন্দলালকে রোহিণীর অকৃত্রিম এবং অকপটেই ভালবেসেছিল,—সমস্ত হৃদয়-প্রাণ দিয়েই ভালবেসেছিল, এবং এ প্রেমের প্রতিদান যে সে পায়নি তাও নয়। কিন্তু হিন্দুধর্মের সুনীতির আদর্শে এ প্রেমের সে অধিকারী নয়, এ ভালবাসা তার প্রাপ্য নয়। সে পাপিষ্ঠা, তাই পাপিষ্ঠাদের জন্য নির্দিষ্ট নীতির আইনে বিশ্বাসঘাতিনী তার হওয়া চাই এবং হলও সে। তার পরের ইতিহাস অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত। মিনিট-পাঁচেকের দেখায় নিশাকরের প্রতি আসক্তি এবং পিস্তলের গুলিতে মৃত্যু। মৃত্যুর জন্য আক্ষেপ করিনে, কিন্তু করি তার অকারণ, অহেতুক জবরদস্তির অপমৃত্যুতে। হতভাগিনীর অস্বাভাবিক মরণে পাঠক-পাঠিকার সুশিক্ষা থেকে আরম্ভ করে সমাজের বিধি ও নীতির convention সমস্তই বেঁচে গেল, সন্দেহ নেই, কিন্তু ম’ল সে, আর তার সঙ্গে সত্য, সুন্দর art। উপন্যাসের চরিত্র শুধু উপন্যাসের আইনেই মরতে পারে, নীতির চোখরাঙানিতে তার মরা চলে না।
ঠিক এই অজুহাতেই শ্রীযুক্ত যতীন্দ্রমোহন সিংহ মহাশয় আমার ‘পল্লী-সমাজের’ বিধবা রমাকে তাঁর ‘সাহিত্যের স্বাস্থ্যরক্ষা’ পুস্তকে বিদ্রূপ করে বলেছেন, “তিনি ঠাকুরানী বুদ্ধিমতী না? বুদ্ধিবলে তোমার পিতার জমিদারি শাসন করিতে পারিলে, আর তুমিই কিনা তোমার বাল্যসখা পরপুরুষ রমেশকে ভালবাসিয়া ফেলিলে? এই তোমার বুদ্ধি? ছিঃ?।” এ ধিক্কার art-এর নয়, এ ধিক্কার সমাজের, এ ধিক্কার নীতির অনুশাসন। এদের মানদণ্ড এক নয়, বর্ণে বর্ণে ছত্রে ছত্রে এক করার প্রয়াসের মধ্যেই যত গলদ, যত বিরোধের উৎপত্তি।
শ্রীযুক্ত যতীন্দ্রবাবুর সামাজিক ধিক্কার art-এর রাজ্যে কতখানি মহামারী উপস্থিত করতে পারে তার আর একটা দৃষ্টান্ত দিই। আমার পরম শ্রদ্ধাস্পদ বন্ধু একজন প্রবীণ সাহিত্যিকের একটি ছোটগল্প আছে, তার plot–টা অত্যন্ত সংক্ষেপে এইরূপ,—নায়ক একজন বড়লোক জমিদার। Hero, অতএব, হৃদয় প্রশস্ত, প্রাণ উচ্চ, নৈতিক-বুদ্ধি অতিশয় সূক্ষ্ম। কলকাতায় তাঁর একটা মস্তবড় বাড়ি আছে; ভাড়া খাটে, দাম প্রায় লাখো টাকা। এক তারিখে বাড়িটা মাস-খানেকের জন্যে একজন ভাড়া নিলে। বাড়িওয়ালা জমিদার ত পাশের বাড়িতেই থাকেন, হঠাৎ একদিন রাত্রে তিনি ওই বাড়িটার ভেতর থেকে একজন স্ত্রীলোকের কান্নার শব্দ শুনতে পেলেন। দিন-দুই পরে অনুসন্ধানে জানা গেলে, বাড়িটার মধ্যে ভ্রূণহত্যা হয়েছে। কিন্তু ভাড়াটেরা বাড়িভাড়া না দিয়েই পালিয়েছে। তাদের ঠিকানা জানা নেই; পাপের দণ্ড দেওয়া অসম্ভব, তাই তিনি হুকুম দিলেন, বাড়িটা ভেঙ্গেচুরে মাঠ করে দাও। পাঁচ-সাত দিনের মধ্যে অতবড় লাখো টাকার বাড়ি ভেঙ্গে মাঠ হয়ে গেল।
গল্প এইখানেই সমাপ্ত হল। প্রেসিডেন্সি কলেজের একজন English-এর প্রবীণ অধ্যাপক এই গল্প পাঠ করে সাশ্রুনেত্রে বারবার বলতে লাগলেন, জীবনে এমন শিক্ষাপ্রদ সুন্দর গল্প আর পড়েন নাই এবং এমন গল্প বাঙ্গালা সাহিত্যে যত বাড়ে ততই মঙ্গল।
এমন গল্প আমিও যে বেশি পড়িনি সে কথা অস্বীকার করিনে, এবং বাড়ি যখন আমারও নয়, অধ্যাপকেরও নয়, গ্রন্থকারেরও নয়, তখন যত ইচ্ছে ভেঙ্গেচুরে মাঠ করে দিলেও আপত্তি নেই, কিন্তু art ও সাহিত্যের যিনি অধিষ্ঠাত্রী দেবতা, তাঁর মনে যে কি ভাবের উদয় হয়েছে সে শুধু তিনিই জানেন।
ভাল-মন্দ সংসারে চিরদিনই আছে,—ভালকে ভাল, মন্দকে মন্দ বলায় কোন art-ই কোন দিন আপত্তি করে না। কিন্তু দুনিয়ায় যা কিছু সত্যই ঘটে নির্বিচারে তাকেই সাহিত্যের উপকরণ করলে সত্য হতে পারে, কিন্তু সত্য-সাহিত্য হয় না।
অর্থাৎ, যা কিছু ঘটে তার নিখুঁত ছবিকেও আমি যেমন সাহিত্য-বস্তু বলিনে, তেমনি যা ঘটে না, অথচ, সমাজ বা প্রচলিত নীতির দিক দিয়ে ঘটলে ভাল হয়, কল্পনার মধ্য দিয়ে তার উচ্ছৃঙ্খল গতিতেও সাহিত্যের ঢের বেশি বিড়ম্বনা ঘটে।
আমার অবসর অল্প, বক্তব্য বস্তুকে আমি পরিস্ফুট করতে পারিনি, এ আমি জানি, কিন্তু আধুনিক-সাহিত্য-রচনায় সমাজের একশ্রেণীর শুভাকাঙ্ক্ষীদের মনের মধ্যে কোথায় অত্যন্ত ক্ষোভ ও ক্রোধের উদয় হয়েছে, বিরোধের আরম্ভ যে কোন্খানে, সেদিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করাটুকু বোধ করি আমার সম্পূর্ণ হয়েছে। কিন্তু আলোচনা ঘোরতর করে তোলবার আমার প্রবৃত্তি নেই, সময় নেই, শক্তিও নেই, শুধু অশেষ শ্রদ্ধাভাজন আমাদের পূর্ববর্তী সাহিত্যাচার্যদের পদাঙ্ক অনুসরণ করবার পথে কোথায় বাধা পেয়ে আমরা যে অন্য পথে চলতে বাধ্য হয়ে পড়েছি, সেই আভাসটুকু মাত্র আপনাদের কাছে সবিনয়ে নিবেদন করলাম।
পরিশেষে যে গৌরব আজ আমাকে আপনারা দিলেন, তার জন্যে আর একবার অন্তরের ধন্যবাদ জানিয়ে এই ক্ষুদ্র ও অক্ষম প্রবন্ধ আমি শেষ করলাম।
( ১৩৩১ সালের ১০ই আশ্বিন বঙ্গীয়-সাহিত্য-পরিষৎ নদীয়া শাখার বার্ষিক অধিবেশনে সভাপতির অভিভাষণ। )
২.০৪ সাহিত্যে আর্ট ও দুর্নীতি
আমি জানি, সাহিত্য-শাখার সভাপতি হবার যোগ্য আমি নই, এবং আমারই মত যাঁরা প্রাচীন, আমারই মত যাঁদের মাথার চুল এবং বুদ্ধি দুই-ই পেকে সাদা হয়ে উঠেছে তাঁদেরও এ বিষয়ে লেশমাত্র সংশয় নেই। কারো মনে ব্যথা দেবার আমার ইচ্ছা ছিল না, তবুও যে এই পদ গ্রহণে সম্মত হয়েছিলাম, তার একটি মাত্র কারণ এই যে, নিজের অযোগ্যতা ও ভক্তিভাজনগণের মনঃপীড়া, এত বড় বড় দু’টো ব্যপারকে ছাপিয়েও তখন বারংবার এই কথাটাই আমার মনে হয়েছিল যে, এই অপ্রত্যাশিত মনোনয়নের দ্বারা নবীনের দল আজ জয়যুক্ত হয়েছেন। তাঁদের সবুজ-পতাকার আহ্বান আমাকে মানতেই হবে, ফল তার যাই কেন না হউক। আর এ প্রার্থনাও সর্বান্তঃকরণে করি, আজ থেকে যাত্রা-পথ যেন তাঁদের উত্তরোত্তর সুগম এবং সাফল্যমণ্ডিত হয়।