রাত্রি শেষ হইয়া আসিতেছিল, বলিলাম, শুতে যাবেন না? চলুন।
চলুন, বলিয়া তিনি উঠিয়া দাঁড়াইলেন।
আমি জিজ্ঞাসা করিলাম, আচ্ছা, এই রেভোলিউসনারীদের সম্বন্ধে আপনার যথার্থ মতামত কি?
সম্মুখের আকাশ ফরসা হইয়া আসিতেছিল, তিনি রেলিং ধরিয়া কিছুক্ষণ উপরের দিকে চাহিয়া থাকিয়া আস্তে আস্তে বলিলেন, এদের অনেককে আমি অত্যন্ত ভালবাসি, কিন্তু এদের কাজ দেশের পক্ষে একেবারে ভয়ানক মারাত্মক। এই অ্যাক্টিভিটিতে সমস্ত দেশ অন্ততঃ পঁচিশ বছর পেছিয়ে যাবে। তা ছাড়া এর মস্ত দোষ এই যে, স্বরাজ পাবার পরেও এ জিনিস যাবে না, তখন আরও স্পর্ধিত হয়ে উঠবে, সামান্য মতভেদে একেবারে ‘সিভিল ওয়ার’ বেধে যাবে। খুনোখুনি রক্তারক্তি আমি অন্তরের সঙ্গে ঘৃণা করি, শরৎবাবু।
কিন্তু এই কথাগুলি তিনি যখনই যতবার বলিয়াছেন, ইংরাজী খবরের কাগজওয়ালারা বিশ্বাস করে নাই, উপহাস করিয়াছে, বিদ্রূপ করিয়াছে। কিন্তু আমি নিশ্চয় জানি, রাত্রিশেষের আলো-অন্ধকার আকাশের নীচে, নদীবক্ষে দাঁড়াইয়া তাঁহার মুখ দিয়া সত্য ছাড়া আর কোন বাক্যই বাহির হয় নাই।
বহুদিন পরে আর একদিন রাত্রিতে তাঁহার মুখ হইতে এমনই অকপট সত্য উক্তি বাহির হইতে আমি শুনিয়াছি। তখন রাত্রি বোধ হয় আটটা বাজিয়া গিয়াছে, আচার্য রায়মহাশয়কে বাড়িতে পৌঁছাইয়া ফিরিয়া আসিয়া দেখিলাম, দেশবন্ধু সিঁড়ির উপরে চুপ করিয়া দাঁড়াইয়া আছেন। বলিলাম, একটা কথা বলব, রাগ করবেন না?
তিনি বলিলেন, না।
আমি বলিলাম, বাঙ্গালাদেশে আপনারা এই যে কয়জন সত্যকার বড়লোক আছেন, তা পরস্পরের সন্দর্শনমাত্রই আপনারা পুলকে যে রকম রোমাঞ্চিতকলেবর হয়ে ওঠেন—
দেশবন্ধু হাসিয়া বলিলেন, বেড়ালের মত?
বলিলাম, পাপমুখে ও আর আমি ব্যক্ত করব কি করে? কিন্তু কিছু একটা না হলে—
দেশবন্ধুর মুখ গম্ভীর হইয়া উঠিল। ক্ষণকাল স্থির থাকিয়া ধীরে ধীরে বলিলেন, কত যে ক্ষতি হয়, সে আমার চেয়ে বেশি আর কে জানে? কেউ যদি এর পথ করে দিতে পারে, ত আমি সকলের নীচে, সকলের তাঁবে কাজ করতে রাজী আছি। কিন্তু ফাঁকি চলবে না, শরৎবাবু।
সেদিন তাঁহার মুখের উপর অকৃত্রিম উদ্বেগের যে লেখা পড়িয়াছিলাম, সে আর ভুলিবার নহে। বাহির হইতে যাহারা তাঁহাকে যশের কাঙাল বলিয়া প্রচার করে, তাহারা না জানিয়া কত বড় অপরাধই না করে! আর ফাঁকি? বাস্তবিক যে লোক তাঁহার সর্বস্ব দিয়াছে, বিনিময়ে সে ফাঁকি সহিবে কি করিয়া?
আর একটা কথা বলিবার আছে। কথাটা অপ্রীতিকর। সতর্কতা ও অতি-বিজ্ঞতার দিক দিয়া একবার ভাবিয়াছিলাম বলিয়া কাজ নাই, কিন্তু পরে মনে হইয়াছে, তাঁহার স্মৃতির মর্যাদা ও সত্যের জন্য বলাই ভাল। এবার ফরিদপুরে ‘কন্ফারেন্সে’ আমি যাই নাই, তথাকার সমস্ত খুঁটিনাটি আমি জানি না, কিন্তু ফিরিয়া আসিয়া অনেকে আমার কাছে এমন সকল মন্তব্য প্রকাশ করিয়াছে,—যাহা প্রিয় নহে, সাধুও নহে। অধিকাংশই ক্ষোভের ব্যাপার এবং দেশবন্ধুর সম্বন্ধে তাহা একেবারেই অসত্য।
দেশের মধ্যে রেভোলিউসনারী ও গুপ্তসমিতির অস্তিত্বের জন্য কিছুকাল হইতে তিনি নানা দিক দিয়া নিজেকে বিপন্ন জ্ঞান করিতেছিলেন। তাঁহার মুশকিল হইয়াছিল এই যে, স্বাধীনতার জন্য যাঁহারা বলি স্বরূপে নিজেদের প্রাণ উৎসর্গ করিয়াছেন, তাঁহাদের একান্তভাবে না ভালবাসাও তাঁহার পক্ষে যেমন অসম্ভব ছিল, তাঁহাদের প্রশ্রয় দেওয়াও তাঁহার পক্ষে তেমনই অসম্ভব ছিল। তাঁহাদের চেষ্টাকে দেশের পক্ষে নিরতিশয় অকল্যাণের হেতু জ্ঞান করিয়া তিনি অত্যন্ত ভয় করিতে আরম্ভ করিয়াছিলেন। এই সমিতিকে উদ্দেশ করিয়া আমাকে একদিন বাঙ্গালায় একটা appeal লিখিয়া দিতে বলিয়াছিলেন। আমি লিখিয়া আনিলাম, ”যদি তোমরা কোথাও কেহ থাকো, যদি তোমাদের মতবাদ সম্পূর্ণ বর্জন করিতেও না পারো, ত অন্ততঃ পাঁচ-সাত বৎসরের জন্যও তোমাদের কার্যপদ্ধতি স্থগিত রাখিয়া আমাদের প্রকাশ্যে সুস্থচিত্তে কাজ করিতে দাও। ইত্যাদি ইত্যাদি।” কিন্তু আমার ‘যদি’ কথাটায় তিনি ঘোরতর আপত্তি করিয়া বলিলেন, ‘যদি’তে কাজ নেই। সাতাশ বৎসর ধরে ‘assuming but not admitting’ করে এসেছি, কিন্তু আর ফাঁকি নয়। আমি জানি, তারা আছে, ‘যদি’ বাদ দিন।
আমি আপত্তি করিয়া বলিলাম, আপনার স্বীকারোক্তির ফল দেশের উপরে অত্যন্ত ক্ষতিকর হবে।
দেশবন্ধু জোর করিয়া বলিলেন, না। সত্য কথা বলার ফল কখনও মন্দ হয় না।
বলা বাহুল্য, আমি রাজী হইতে পারি নাই এবং আবেদনও প্রকাশিত হইতে পারে নাই। আমাকে বলিয়াছিলেন, এ-সকল যারা করে, তারা জেনেশুনেই করে, কিন্তু যারা করে না কিছুই, গভর্নমেন্টের হাতে তারাই বেশি করে দুঃখ পায়। সুভাষ, অনিলবরণ, সত্যেন প্রভৃতির জন্য তাঁহার মনস্তাপের অবধি ছিল না। সুভাষকে করপোরেশনে কাজ দিবার পরে একদিন আমাকে বলিয়াছিলেন, I have sacrificed my best man for this corporation. এবং সেই সুভাষকেই যখন পুলিশ ধরিয়া লইয়া গেল, তখন তাঁহার দৃঢ়বিশ্বাস জন্মিয়াছিল, তাঁহাকে সর্বদিক দিয়া অক্ষম ও অকর্মণ্য করিয়া দিবার জন্যই গভর্নমেণ্ট তাঁহার হাত-পা কাটিয়া তাঁহাকে পঙ্গু করিয়া আনিতেছে।
তাঁহার ফরিদপুর অভিভাষণের পরে মডারেটদলের লোক উৎফুল্ল হইয়া বলিতে লাগিল, আর ত কোনও প্রভেদ নাই, আইস, এখন কোলাকুলি করিয়া মিলিয়া যাই। ইংরাজী খবরওয়ালার দল তাঁহার ‘জেস্চারের’ অর্থ এবং অনর্থ করিয়া গালি দিল কি সুখ্যাতি করিল, ঠিক বুঝাই গেল না। তাঁহার নিজের দলের বহুলোক মুখ ভারী করিয়াই রহিল, কিন্তু এ সম্বন্ধে আমার একটা কথা বলিবার আছে।