হঠাৎ জিজ্ঞাসা করিলেন, আপনি চরকা বিশ্বাস করেন?
বলিলাম, আপনি যে বিশ্বাসের ইঙ্গিত করছেন, সে বিশ্বাস করিনে।
কেন করেন না?
বোধ হয় অনেকদিন অনেক চরকা কেটেছি বলেই।
দেশবন্ধু ক্ষণকাল চুপ করিয়া থাকিয়া বলিলেন, এই ভারতবর্ষের ত্রিশ কোটি লোকের পাঁচ কোটি লোকও যদি সুতো কাটে ত ষাট কোটি টাকার সুতো হতে পারে।
বলিলাম, পারে। দশ লক্ষ লোক মিলে একটা বাড়ি তৈরিতে হাত লাগালে দেড় সেকেন্ডে হতে পারে। হয়, আপনি বিশ্বাস করেন?
দেশবন্ধু বলিলেন, এ দুটো একবস্তু নয়। কিন্তু আপনার কথা আমি বুঝেছি,—সেই দশ মণ তেল পোড়ার গল্প। কিন্তু, তবুও আমি, বিশ্বাস করি। আমার ভারী ইচ্ছে হয় যে, চরকা কাটা শিখি, কিন্তু কোনরকম হাতের কাজেই আমার কোন পটুতা নেই।
বলিলাম, ভগবান্ আপনাকে রক্ষা করেছেন।
দেশবন্ধু হাসিলেন; বলিলেন, আপনি হিন্দু-মুসলিম ইউনিটি বিশ্বাস করেন?
বলিলাম, না।
দেশবন্ধু বলিলেন, আপনার মুসলমানপ্রীতি অতি প্রসিদ্ধ।
ভাবিলাম, মানুষের কোন সাধু ইচ্ছাই গোপন থাকিবার জো নাই, খ্যাতি এত বড় কানে আসিয়াও পৌঁছিয়াছে! কিন্তু নিজের প্রশংসা শুনিলে চিরদিনই আমার লজ্জা করে, তাই সবিনয়ে বদন নত করিলাম।
দেশবন্ধু কহিলেন, কিন্তু এ ছাড়া আর কি উপায় আছে বলতে পারেন? এরই মধ্যে তারা সংখ্যায় পঞ্চাশ লক্ষ বেড়ে গেছে, আর দশ বছর পরে কি হবে বলুন ত?
বলিলাম, এটা যদিও ঠিক মুসলমানপ্রীতির নিদর্শন নয়, অর্থাৎ, বছর-দশেক পরের কথা কল্পনা করে আপনার মুখ যেমন সাদা হয়ে উঠেচে, তাতে আমার নিজের সঙ্গে আপনার খুব বেশি তফাত মনে হচ্চে না। তা সে যাই হোক, কেবলমাত্র সংখ্যাই আমার কাছে মস্ত জিনিস নয়। তা হলে চার কোটি ইংরাজ দেড়-শ কোটি লোকের মাথায় পা দিয়ে বেড়াতে পারত না। নমঃশূদ্র, মালো, নট, রাজবংশী, পোদ এদের টেনে নিন, দেশের মধ্যে, দশের মধ্যে এদের একটা মর্যাদার স্থান নির্দিষ্ট করে দিয়ে এদের মানুষ করে তুলুন, মেয়েদের প্রতি যে অন্যায়, নিষ্ঠুর, সামাজিক অবিচার চলে আসছে, তার প্রতিবিধান করুন, ওদিকের সংখ্যার জন্য আপনাকে ভাবতে হবে না।
নমঃশূদ্র প্রভৃতি জাতির লাঞ্ছনার কথায় তাঁহার বুকে যেন শেল বিদ্ধ হইতে থাকিত। কে নাকি একবার তাঁহাকে বলিয়াছিল, দেশবন্ধু শব্দের আর একটা অর্থ চণ্ডাল। এই কথায় তিনি আনন্দে উৎফুল্ল হইয়া উঠিয়াছিলেন। নিজে উচ্চকুলে জন্মিয়াছিলেন বলিয়াই বোধ হয়, উচ্চজাতির দেওয়া বিনা দোষে এই অপমানের গ্লানি নিপীড়িতদের সহিত সমভাবে ভোগ করিবার জন্য প্রাণ তাঁহার আকুল হইয়া উঠিত। ব্যগ্র হইয়া বলিয়া উঠিলেন, আপনারা দয়া করে আমাকে এই পলিটিক্সের বেড়াজাল থেকে উদ্ধার করে দিন, আমি ঐ ওদের মধ্যে গিয়ে থাকিগে। আমি ঢের কাজ করতে পারবো। এই বলিয়া তিনি ইহাদের প্রতি দীর্ঘকাল ধরিয়া হিন্দুসমাজ কত অত্যাচার করিতেছে, তাহাই এক একটা করিয়া বলিতে লাগিলেন।
কহিলেন, বেচারাদের ধোপা-নাপিত নেই, ঘরামীরা ঘর ছেয়ে দেয় না। অথচ এরাই মুসলমান, খ্রীস্টান হয়ে গেলে আবার তারাই এসে এদের কাজ করে। অর্থাৎ হিন্দুরাই প্রকারান্তরে বলছে, হিন্দুর চেয়ে মুসলমান, খ্রীস্টানই বড়। এরকম senseless সমাজ মরবে না ত মরবে কে? এই বলিয়া বহুক্ষণ স্থির থাকিয়া সহসা প্রশ্ন করিলেন, আপনি আমাদের অহিংস-অসহযোগ বিশ্বাস করেন ত?
বলিলাম, না। অহিং সহিংস কোন অসহযোগেই আমার বিশ্বাস নেই।
দেশবন্ধু সহাস্যে কহিলেন, অর্থাৎ আমাদের মধ্যে দেখছি, কোথাও লেশমাত্র মতভেদ নেই।
আমি প্রত্যুত্তরে কহিলাম, একদিন কিন্তু যথার্থই লেশমাত্র মতভেদ থাকবে না, আমি এই আশাতেই আছি। ইতিমধ্যে যতটুকু শক্তি, আপনার কাজ করে দিই। আর শুধু মত নিয়েই বা হবে কি, বসন্ত মজুমদার, শ্রীশ চট্টোপাধ্যায় এঁরা ত দেশের বড় কর্মী, কিন্তু ইংরাজের প্রতি বসন্তর বিঘূর্ণিত রক্তচক্ষুর অহিংস দৃষ্টিপাত এবং শ্রীশের প্রেমসিক্ত বিদ্বেষবিহীন মেঘগর্জন,—এই দুটি বস্তু দেখলে এবং শুনলে আপনারও সন্দেহ থাকবে না যে, মহাত্মাজীর পরে অহিংস অসহযোগ যদি কোথাও স্থিতি লাভ করে থাকে, ত এই দুটি বন্ধুর চিত্তে। অথচ, এত বেশী কাজই বা কয় জনে করেছে? অসহযোগ আন্দোলনের সার্থকতা ত গণসাধারণ, অর্থাৎ mass-এর জন্য? কিন্তু এই mass পদার্থটির প্রতি আমার অতিরিক্ত শ্রদ্ধা নেই। একদিনের উত্তেজনায় এরা হঠাৎ কিছু একটা করে ফেলতেও পারে, কিন্তু দীর্ঘদিনের সহিষ্ণুতা এদের নেই। সেবার দলে দলে এরা জেলে গিয়েছিল, কিন্তু দলে দলে ক্ষমা চেয়ে ফিরেও এসেছিল। যারা আসেনি, তারা শিক্ষিত মধ্যবিত্ত গৃহস্থের ছেলেরা। তাই আমার সমস্ত আবেদন নিবেদন এদের কাছে। ত্যাগের দ্বারা কেউ কোন দিন যদি দেশ স্বাধীন করতে পারে, ত শুধু এরাই পারবে।
এইখানে দেশবন্ধুর বোধ করি, একটা গোপন ব্যথা ছিল, তিনি চুপ করিয়া রহিলেন। কিন্তু জেলের কথায় তাঁহার আর একটা প্রকাণ্ড ক্ষোভের কথা মনে পড়িয়া গেল। বলিলেন, এ দুরাশা আমার কোনদিন নেই যে, দেশ একেবারে এক লাফে পুরো স্বাধীন হয়ে যাবে। কিন্তু আমি চাই স্বরাজের একটা সত্যকার ভিত্তি স্থাপন করতে। আমি তখন জেলের মধ্যে, বাইরে বড়লাট প্রভৃতি এঁরা, ওদিকে সবরমতি আশ্রমে মহাত্মাজী,— তাঁর কিছুতেই মত হল না, অতবড় সুযোগ আমাদের নষ্ট হয়ে গেল। আমি বাইরে থাকলে কোনমতেই এতবড় ভুল করতে দিতাম না। অদৃষ্ট! তাঁর লীলা!