আর একটা কথা বলেই আমি এবার এ প্রবন্ধ শেষ কোরব। সময়ের অভাবে অনেক বিষয়ই বলা হোল না,—কিন্তু এই অবান্তর কথাটা না বলেও থাকতে পারলাম না যে, বিদ্যা এবং বিদ্যালয় এক বস্তু নয়; শিক্ষা ও শিক্ষার প্রণালী এ-দুটো আলাদা জিনিস। সুতরাং কোন একটা ত্যাগ করাই অপরটা বর্জন করা নয়। এমনও হতে পারে বিদ্যালয় ছাড়াই বিদ্যালাভের বড় পথ। আপাতদৃষ্টিতে কথাটা উলটো মনে হলেও সত্য হওয়া অসম্ভব নয়। তেলে জলে মেশে না, এ দুটো পদার্থও একেবারে উলটো, তবু তেলের সেজ জ্বালাতে যে মানুষ জল ঢালে সে কেবল তেলটাকেই নিঃশেষে পুড়িয়ে নিতে। যারা এ তত্ত্ব জানে না তাদের একটু ধৈর্য থাকা ভাল।
১.৪ স্মৃতিকথা
মনে হয়, পরাধীন দেশের সব চেয়ে বড় অভিশাপ এই যে, মুক্তিসংগ্রামে বিদেশীয়ের অপেক্ষা দেশের লোকের সঙ্গেই মানুষকে বেশি লড়াই করিতে হয়। এই লড়াইয়ের প্রয়োজন যেদিন শেষ হয়, শৃঙ্খল আপনি খসিয়া পড়ে। কিন্তু প্রয়োজন শেষ হইল না, দেশবন্ধু দেহত্যাগ করিলেন। ঘরে-বাহিরে অবিশ্রান্ত যুদ্ধ করার গুরুভার তাঁহার আহত, একান্ত পরিশ্রান্ত দেহ আর বহিতে পারিল না।
আজ চারিদিকে কান্নার রোল উঠিয়াছে, ঠিক এতবড় কান্নারই প্রয়োজন ছিল।
তাঁহার আয়ুষ্কাল যে দ্রুত শেষ হইয়া আসিতেছে, তাহা আমরাও জানিতাম, তিনি নিজেও জানিতেন। সেদিন পাটনায় যাইবার পূর্বে আমায় ডাকাইয়া পাঠাইলেন। শয্যাগত; আমি কাছে গিয়া বসিতে বলিলেন, এবার final শরৎবাবু।
বলিলাম, আপনি যে স্বরাজ চোখে দেখিয়া যাইবেন বলিয়াছিলেন?
ক্ষণকাল চুপ করিয়া থাকিয়া বলিলেন, তার আর সময় হইল না ( ১৩২৮ সালে ‘গৌড়ীয় সর্ববিদ্যায়তনে’ পঠিত )।
তিনি যখন জেলে, তখন জন-কয়েক লোক প্রাচীরের গায়ে নমস্কার করিতেছিল। জিজ্ঞাসা করায় তাহারা বলিয়াছিল, আমাদের দেশবন্ধু এই জেলের মধ্যে, তাঁহাকে চোখে দেখিবার জো নাই, আমরা তাই জেলের পাঁচিলে তাঁকে প্রণাম করিতেছি। এ কথা তিনি শুনিয়াছিলেন, আমি তাহাই স্মরণ করাইয়া দিয়া বলিলাম, এরা আপনাকে ছাড়িয়া দিবে কেন? দুই চোখ তাঁহার ছলছল করিয়া আসিল, কয়েক মুহূর্ত তিনি আপনাকে সামলাইয়া লইয়া অন্য কথা পাড়িলেন। মিনিট-কুড়ি পরে ডাক্তার দাসগুপ্ত ঘরের কোণ হইতে আমার মোটা লাঠিটা আনিয়া আমার হাতে দিলে তিনি হাসিয়া বলিলেন, ইঙ্গিতটা বুঝেছেন শরৎবাবু? এরা আমাদের একটুখানি গল্প করতেও দিতে চায় না।
এ গল্পের আর আমাদের অবসর মিলিল না।
লোক বলিতেছে, এত বড় দাতা, এত বড় ত্যাগী দেখি নাই। দান হাত পাতিয়া লওয়া যায়, ত্যাগ চোখে দেখা যায়, ইহা সহজে কাহারও দৃষ্টি এড়ায় না। কিন্তু হৃদয়ের নিগূঢ় বৈরাগ্য? বাস্তবিক, সর্বপ্রকার কর্মের মধ্যেও এতবড় বৈরাগী আর আমি দেখি নাই। ঐশ্বর্যে যাহার প্রয়োজন ছিল না, ধন-সম্পদের মূল্য যে কোনমতেই উপলব্ধি করিতে পারিল না, সে টাকাকড়ি দুই হাতে ছড়াইয়া ফেলিবে না ত ফেলিবে কে? একদিন আমাকে বলিয়াছিলেন, লোক ভাবে, আমি ব্যক্তিবিশেষের প্রভাবে পড়িয়া ঝোঁকের মাথায় প্র্যাকটিস্ ছাড়িয়াছি। তাহারা জানে না যে, এ আমার বহুদিনের একান্ত বাসনা, শুধু ত্যাগের ছল করিয়াই ত্যাগ করিয়াছি। ইচ্ছা ছিল, সামান্য কিছু টাকা হাতে রাখিব, কিন্তু এ যখন ভগবানের ইচ্ছা নহে, তখন এই আমার ভাল।
কিন্তু এই বিরাট ত্যাগের নিভৃত অন্তরালে আর একজন আছেন—তিনি বাসন্তী দেবী। একদিন ঊর্মিলা দেবী আমাকে বলিয়াছিলেন, দাদার এতবড় কাজের মধ্যে আর একজনের হাত নিঃশব্দে কাজ করে; সে আমাদের বৌ। নইলে দাদা কতখানি কি করতে পারতেন, আমার ভারী সন্দেহ হয়। বাস্তবিক, নন-কো-অপারেশনের প্রথম হইতে ত অনেকই দেখিলাম, কিন্তু সমস্ত কিছুর অগোচরে এমন আড়ম্বরহীন শান্ত দৃঢ়তা, এমন ধৈর্য, এমন সদাপ্রসন্ন স্নিগ্ধ মাধুর্য আর আমার চোখে পড়ে নাই। একান্ত পীড়িত স্বামীকে সেদিন শেষবারের মত কাউন্সিল ঘরে তিনিই পাঠাইয়াছিলেন। ডাক্তারদের ডাকিয়া বলিলেন, গাড়ি হউক, স্ট্রেচার হউক, যা হউক একটা তোমরা বন্দোবস্ত করিয়া দাও। উনি যখন মন স্থির করিয়াছেন, তখন পৃথিবীতে কোন শক্তি নাই ওঁকে আটকায়। হাঁটিয়া যাইবার চেষ্টা করিবেন, তার ফলে তোমরা রাস্তার মাঝখানেই ওঁকে হারাইবে।
অথচ নিজে সঙ্গে যাইতে পারেন নাই, পথের দিকে চাহিয়া সারাদিন চুপ করিয়া বসিয়া ছিলেন। ইংরেজীতে যাহাকে বলে scene create করা, এই ছিল তাঁহার সবচেয়ে বড় ভয়। সর্বলোকের চক্ষু তাঁহাতে আকৃষ্ট হওয়ার কল্পনামাত্রেই তিনি সঙ্কুচিত হইয়া উঠেন। আজ এইটিই হইতেছে ভারতের সবচেয়ে বড় প্রয়োজন। গৃহে গৃহে যত দিন না এমনই সাধ্বী, এমনই লক্ষ্মী জন্মগ্রহণ করিবে, ততদিন দেশের মুক্তির আশা সুদূরপরাহত।
আজ চিত্তরঞ্জনের দীপ্তিতে বাঙ্গালার আকাশ ভাস্কর হইয়া উঠিয়াছে। কিন্তু দীপের যে অংশটা শিখা হইয়া লোকের চোখে পড়ে, তাহার জ্বলার ব্যাপারে কেবল সেইটুকুই তাহার সমস্ত ইতিহাস নহে। তাই মনে হয়, সন্ন্যাসী চিত্তরঞ্জনকে রিক্ত করিয়া লইতেও ভগবান যেমন দ্বিধা করেন নাই, যখন দিয়াছিলেন, তখন কৃপণতাও তেমনই করেন নাই।
অল ইন্ডিয়া কংগ্রেস কমিটির মিটিং উপলক্ষে কোথাও দূর-পাল্লায় যাইবার প্রয়োজন হইলেই আমার কেমন দুর্ভাগ্য, ঠিক পূর্বক্ষণেই আমার কিছু-না-কিছু একটা মস্ত অসুখ করিত। সেবার দিল্লী যাইবার আগের দিন দেশবন্ধু আমাকে ডাকিয়া কহিলেন, কাল আপনার সঙ্গে ঊর্মিলা যাবেন।