অতঃপর এই সকল উক্তি সপ্রমাণ করিতে নানাবিধ শ্লোক ও তাহার মন্তব্য লিখিয়া দিয়া বোধ করি অসংশয়ে প্রমাণ করিয়া দিয়াছেন, এই সকল আচার-ব্যবহার বৈদিক কালে প্রচলিত ছিলই। ভালই।
কিন্তু এই যে বলিয়াছেন—বহু সহস্র বর্ষ পূর্বের বিবাহপদ্ধতি যেমনটি ছিল, আজও এই বৈদেশিক সভ্যতার সংঘর্ষেও ঠিক তেমনটি আছে, ‘অণুমাত্র’ পরিবর্তিত হয় নাই—ইহার অর্থ হৃদয়ঙ্গম করিতে পারিলাম না। কারণ, পরিবর্তিত না হওয়ায় বলিতেই হইবে, আজকাল প্রচলিত বিবাহপদ্ধতিটিও ঠিক তেমনি নির্দোষ এবং ইহাই বোধ করি বলার তাৎপর্য। কিন্তু এই তাৎপর্যটির সামঞ্জস্য রক্ষিত হইয়াছে বলিয়া মনে হইতেছে না। বলিতেছেন,—“কন্যা-সম্প্রদানের ব্যবস্থা ছিল। কিন্তু কন্যার বয়সের কোন পরিমাণ নির্দিষ্ট নাই।”
অর্থাৎ বুঝা যাইতেছে, আজকাল যেমন মেয়ের বয়স বারো উত্তীর্ণ হইয়া তেরোয় পড়িলেই ভয়ে এবং ভাবনায় মেয়ের বাপ-মায়ের জীবন দুর্ভর হইয়া উঠে এবং পাছে চৌদ্দ পুরুষ নরকস্থ এবং সমাজে ‘একঘরে’ হইয়া থাকিতে হয়, সেই ভয় ও ভাবনায় বাড়িসুদ্ধ লোকের পেটের ভাত চাল হইতে থাকে, তখনকার বৈদিক কালে এমনটি হইতে পারিত না। ইচ্ছামত বা সুবিধামত মেয়েকে ১২। ১৪। ১৮। ২০ যে-কোন বয়সেই হউক, পাত্রস্থ করা যাইতে পারিত। আর এমন না হইলে কন্যা শ্বশুরবাড়ি গিয়াই যে শ্বশুর-শাশুড়ি, ননদ-দেবরের উপর প্রভু হইয়া বসিয়া যাইত, সে নেহাত কচি খুকীটির কর্ম নয় ত।
রাগ দ্বেষ অভিমান গৃহিণীপনার ইচ্ছা প্রভৃতি যে সেকালে ছিল না—বউ বাড়ি ঢুকিবামাত্রই তাঁহার হাতে লোহার সিন্দুকের চাবিটি শাশুড়ী ননদে তুলিয়া দিত, সেও ত মনে করা যায় না।
যাই হউক, ভববিভূতিবাবুর নিজের কথা মত বয়সের কড়াকড়ি তখন ছিল না। কিন্তু এখন কড়াকড়িটা যে কি ব্যাপার, তাহা আর কোন ব্যক্তিকেই বুঝাইয়া বলিবার আবশ্যকতা নাই বোধ করি।
দ্বিতীয়ঃ, ইনি বলিয়াছেন যে, “এই সকল উপঢৌকন কেহ যেন বর্তমানকালে প্রচলিত কদর্য পণপ্রথার প্রমাণরূপে গ্রহণ না করেন। এগুলি কন্যার পিতার স্বেচ্ছাকৃত, সামর্থ্যানুরূপ দান বুঝিতে হইবে।”
কিন্তু এখনকার উপঢৌকন যোগাইতে অনেক পিতাকে বাস্তুভিটাটি পর্যন্ত বেচিতে হয়। সে সময় কিন্তু অপৌরুষেয় ঋক্মন্ত্র মেয়ের বাপেরও এক তিল কাজে আসে না, বরের বাপকেও বিন্দুমাত্র ভয় দেখাইতে, তাঁহার কর্তব্যনিষ্ঠা হইতে বিন্দুমাত্র বিচলিত করিতে সমর্থ হয় না।
তৃতীয়তঃ, রাশীকৃত শাস্ত্রীয় বিচার করিয়া প্রতিপন্ন করিতেছেন যে, যে-মেয়ের ভাই ছিল না, সে মেয়ের সহিত তখনকার দিনে বিবাহ নিষিদ্ধ ছিল। এবং বলিতেছেন, অথচ, আজকাল এই বিবাহই সর্বাপেক্ষা সন্তোষজনক। কারণ, বিষয়-আশয় পাওয়া যায়। যদিচ, এতগুলি শাস্ত্রীয় শ্লোক ও তাহার অর্থাদি দেওয়া সত্ত্বেও মোটাবুদ্ধিতে আসিল না, ভাই না হওয়ায় বোনের অপরাধ কি এবং কেনই বা সে ত্যাজ্যা হইয়াছিল; কিন্তু এখন যখন ইহাই সর্বাপেক্ষা বাঞ্ছনীয়, তখন ইহাকেও একটা পরিবর্তন বলিয়াই গণ্য করিতে হইবে। তবেই দেখা যাইতেছে,
(১) তখন মেয়ের বিবাহের বয়স নির্দিষ্ট ছিল না, এখন ইহাই হইয়াছে বাপ-মায়ের মৃত্যুবাণ।
(২) স্বেচ্ছাকৃত উপঢৌকন দাঁড়াইয়াছে বাস্তুভিটা বেচা এবং
(৩) নিষিদ্ধ কন্যা হইয়াছেন সবচেয়ে সুসিদ্ধ মেয়ে।
ভববিভূতিবাবু বলিবেন, তা হোক না, কিন্তু এখনও ত বরকে সেই মেয়ের বাড়িতে গিয়াই বিবাহ করিতে হয় এবং শোভাযাত্রা করিয়া ঘরে ফিরিতে হয়। এ ত আর বৈদেশিক সভ্যতার সংঘর্ষ একতিল পরিবর্তিত করিতে পারে নাই? তা পারে নাই সত্য, তবুও মনে পড়ে, সেই যে কে একজন খুব খুশী হইয়া বলিয়াছিল,—“অন্নবস্ত্রের দুঃখ ছাড়া আর দুঃখ আমার সংসারে নেই!”
আবার ইহাই সব নয়। “বিবাহিতা পত্নী যে গৃহের প্রধান অঙ্গ,—গৃহিণীর অভাবে যে গৃহ জীর্ণারণ্যের তুল্য”, তাহা ভট্টাচার্য্য মহাশয় “গৃহিণী গৃহমুচ্যতে”—এই প্রসিদ্ধ প্রবাদবাক্য হইতে সম্প্রতি অবগত হইয়াছেন। আবার ঋগ্বেদ পাঠেও এই প্রবাদটির সুপুরাতনত্বই সূচিত হইয়াছে। যথা—[৩ ম, ৫৩ সূ, ৪ ঋক্]
“জায়েদস্তং মঘবন্ত্ সেদু যোনিঃ”
অর্থাৎ হে মঘবন্—জায়াই গৃহ, জায়াই যোনি। সুতরাং বহু প্রাচীনকাল হইতেই হিন্দুগণ রমণীগণের প্রতি আদর ও সম্মান প্রদর্শন করিয়া আসিতেছেন। আবার তাঁহাদের পত্নী কিরূপ মঙ্গলময়ী, তাহা “কল্যাণীর্জায়া … গৃহে তে” [৩ ম, ৫৩ সূ, ৬ ঋক্] হইতে স্পষ্টই প্রতীত হয়। সুতরাং—
“কিন্তু তথাপি বৈদেশিকগণ কেন যে হিন্দুগণের উপর রমণীগণের প্রতি কঠোর ব্যবহারের জন্য দোষারোপ করেন, তাহা তাঁহারাই জানেন।”
এই সকল প্রবন্ধ ও মতামতের যে প্রতিবাদ করা আবশ্যক, সে কথা অবশ্য কেহই বলিবেন না। আমিও একেবারেই করিতাম না, যদি না ইহা আমার প্রবন্ধের ভূমিকা হিসাবেও কাজে লাগিত। তথাপি প্রতিবাদ করিতে আমি চাহি না — কিন্তু ইহারই মত ‘বড় কাতরকণ্ঠে’ ডাকিতে চাহি—ভগবন্! এই সমস্ত শ্লোক আওড়ানোর হাত হইতে এই হতভাগ্য দেশকে রেহাই দাও। ঢের প্রায়শ্চিত্ত করাইয়া লইয়াছ, এইবার একটু নিষ্কৃতি দাও। -শ্রীমতী অনিলা দেবী ( ভারতবর্ষ, জ্যৈষ্ঠ ১৩২৩)
সাম্প্রদায়িক বাঁটোয়ারা (এক)
বাঙলার হিন্দু জনগণের আজকের এই সম্মিলনী যাঁরা আহ্বান করেছেন, আমি তাঁদের একজন। এই বিশাল সভা কেবলমাত্র এই নগরের নাগরিকগণের নয়। আজ যাঁরা সমবেত হয়েছেন, তাঁরা বাঙলার বিভিন্ন জেলার অধিবাসী। সকলের বর্ণ হয়ত এক নয়, কিন্তু ভাষা এক, সাহিত্য এক, ধর্ম এক, জীবনযাত্রার গোড়ার কথাটা এক,—যে বিশ্বাস যে নিষ্ঠা আমাদের ইহলোক পরলোক নিয়ন্ত্রিত করে, সেখানেও আমরা কেউ কারও পর নয়। পর করে দেবার নানা উপায়, নানা কৌশল সত্ত্বেও বলব, আমরা আজও এক। যুগ-যুগান্ত থেকে যে বন্ধন আমাদের এক করে রেখেছে, সত্যিই আজও তা বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়নি।