এই চাতুর্ব্বণ্য প্রসঙ্গে শুধু যদি ইনি লিখিতেন—এই কথা কত প্রাচীন, তাহা জানিতে হইলে বেদপাঠ তাহার অন্যতম সহায়, তাহা হইলে কোন কথা ছিল না; কারণ, উক্ত প্রবন্ধে বলিবার বিষয়ই এই। কিন্তু ঐ যে-সব আনুষঙ্গিক বক্র কটাক্ষ, তাহার সার্থকতা কোনখানে? “যে সনাতন সুপ্রথা শান্তি ও সমাজ-পরিচালনার একমাত্র সুন্দর উপায়—” জিজ্ঞাসা করি, কেন? কে বলিয়াছে? ইহা যে ‘সুপ্রথা’ তাহার প্রমাণ কোথায়? যে-কোন একটা প্রথা শুধু পুরাতন হইলেই ‘সু’ হয় না। ফিজিয়ানরা যদি জবাব দেয়, “মশাই, বুড়া বাপ-মাকে জ্যান্ত পুঁতিয়া ফ্যালার নিয়ম যে আমাদের দেশের কত প্রাচীন, সে যদি একবার জানিতে ত আর আমাদের দোষ দিতে না।”
সুতরাং এই যুক্তিতে ত ঘাড় হেঁট করিয়া আমাদিগকে বলিতে হইবে, “হাঁ বাপু, তোমার কথাটা সঙ্গত বটে! এ-প্রথা যখন এতই প্রাচীন, তখন আর ত কোন দোষ নাই। তোমাকে নিষেধ করিয়া অন্যায় করিয়াছি—বেশ করিয়া জ্যান্ত কবর দাও—এমন সুবন্দোবস্ত আর হইতেই পারে না!” অতএব শুধু প্রাচীনত্বই কোন বস্তুর ভাল-মন্দর সাফাই নয়। তবে এই যে বলা হইয়াছে যে, এই প্রথা কোন ব্যক্তিবিশেষের প্রবর্তিত নহে, ইহা সেই পরমপুরুষের একটি ‘অঙ্গবিলাস’ মাত্র, তাহা হইলে আর কথা চলে না। কিন্তু আমার কথা চলুক আর না-চলুক, তাহাতে কিছুই আসিয়া যায় না; কিন্তু যাহাতে যথার্থই আসিয়া যায়, অন্ততঃ আসিয়া গিয়াছে, তাহা এই যে, সেই সমস্ত প্রাচীন দিনের ঋষিদিগের অপরিমেয় অতুল্য বুদ্ধিরাশির ভরা-নৌকা এইখানেই ঘা খাইয়া চিরদিনের মত ডুবিয়াছে। যে-কেহ হিন্দুশাস্ত্র আলোচনা করিয়াছেন, তিনিই বোধ করি অত্যন্ত ব্যথার সহিত অনুভব করিয়াছেন, কি করিয়া ঋষিদিগের স্বাধীন চিন্তার শৃঙ্খল এই বেদেরই তীক্ষ্ণ খড়্গে ছিন্নভিন্ন হইয়া পথে-বিপথে যেখানে-সেখানে যেমন-তেমন করিয়া আজ পড়িয়া আছে। চোখ মেলিলেই দেখা যায়, যখনই সেই সমস্ত বিপুল চিন্তার ধারা সুতীক্ষ্ণ বুদ্ধির অনুসরণ করিয়া ছুটিতে গিয়াছে, তখনই বেদ তাহার দুই হাত বাড়াইয়া তাহাদের চুলের মুঠি ধরিয়া টানিয়া আর একদিকে ফিরাইয়া দিয়াছে। তাহাদিগকে ফিরাইয়াছে সত্য, কিন্তু পাশ্চাত্য পণ্ডিত বা তাঁহাদেরই পদাঙ্কানুসারী দেশীয় বিদ্বান্গণকে ঠিক তেমন করিয়া নিবৃত্ত করা শক্ত।
কিন্তু সে যাই হউক, কেন যে তাঁহারা এই প্রথমটিকে হিন্দুর ভ্রম এবং অধঃপতনের হেতু বলিয়া নির্দেশ করিয়াছেন, অধ্যাপক মহাশয় তাহার যখন কিছুমাত্র হেতুর উল্লেখ না করিয়া শুধু উক্তিটা তুলিয়া দিয়াই ক্রোধ প্রকাশ করিয়াছেন, তখন ইহা লইয়া আলোচনা করিবার আপাততঃ প্রয়োজন অনুভব করি না।
অতঃপর অধ্যাপক মহাশয় বলেন বৈদেশিক পণ্ডিতেরা পরমপুরুষের এই চাতুর্ব্বণ্য অঙ্গবিলাসটি মানিতে চাহেন না এবং বলেন, ঋক্বেদের সময়ে চাতুর্বর্ণ্য ছিল না। কারণ, এই বেদের আদ্য কতিপয় মণ্ডলে ভারতবাসিগণের কেবল দ্বিবিধ ভেদের উল্লেখ আছে। আর যদিই বা কোনস্থানে চাতুর্বর্ণ্যের উল্লেখ থাকে, তবে তাহা প্রক্ষিপ্ত।
এই কথায় অধ্যাপক মহাশয় ইহাদিগকে অন্ধ বলিয়া ক্রোধে ইহাদের চোখে আঙুল দিয়া দিবেন বলিয়া শাসাইয়াছেন। কারণ, আর্যগণের মধ্যে ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, শূদ্র, চতুর্বিধ ভেদের স্পষ্ট উল্লেখ থাকিতেও তাহা তাঁহাদের দৃষ্টিগোচর হয় নাই।
তার পর ‘আর্য্যং বর্ণং’ শব্দটার অর্থ লইয়া উভয় পক্ষের যৎকিঞ্চিৎ বচসা আছে। কিন্তু আমরা ত বেদ জানি না, সুতরাং এই ‘আর্য্যং বর্ণং’ শেষে কি মানে হইল, ঠিক বুঝিতে পারিলাম না।
তবে মোটামুটি বুঝা গেল যে, এই ‘ব্রাহ্মণ’ শব্দটা লইয়া একটু গোল আছে। কারণ, ‘ব্রহ্ম’ শব্দটির ‘মন্ত্র’ অর্থও নাকি হয়!
অধ্যাপক মহাশয় বলিতেছেন, ম্যাক্সমুলারের এত সাহস হয় নাই যে বলেন, ‘ছিলই না’, কিন্তু প্রতিপন্ন করিতে চাহেন যে, হিন্দু চাতুর্বর্ণ্য বৈদিক যুগে ‘স্পষ্টতঃ বিদ্যমান ছিল না’; অর্থাৎ ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, শূদ্রের যে বিভিন্ন বৃত্তির কথা শুনা যায়—তাহার তত বাঁধাবাঁধি বর্ণচতুষ্টয়ের মধ্যে তৎকালে আবির্ভূত হয় নাই—অর্থাৎ যোগ্যতা-অনুসারে যে-কোন লোক যে-কোন বৃত্তি অবলম্বন করিতে পারিত।
আমার ত মনে হয়, পণ্ডিত ম্যাক্সমুলার জোর করিয়া ‘ছিলই না’ না বলিয়া নিজের যে পরিচয় দিয়াছেন, তাহা দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতাতেই শুধু অর্জিত হয়। কিন্তু প্রত্যুত্তরে ভববিভূতিবাবু বলিতেছেন,—“সায়ণ চতুর্দশ শতাব্দীর লোক বলিয়া না হয় তাঁহার ব্যাখ্যা উড়াইয়া দিতে প্রবৃত্ত হইতে পার, কিন্তু সেই অপৌরুষেয় বেদেরই অন্তর্গত ঐতরেয় ব্রাহ্মণ যখন ‘ব্রহ্মণস্পতি’ অর্থে ব্রাহ্মণপুরোহিত। [ ঐ. ব্রা. ৮। ৫। ২৪, ২৬ ] করিলেন, তখন তাহা কি বলিয়া উড়াইয়া দিবে? ব্রহ্মণ্যশক্তি যে সমাজ ও রাজশক্তির নিয়ন্ত্রী ছিল, তাহা আমরা ঋগ্বেদেই দেখিতে পাই!”
পাওয়াই ত উচিত। কিন্তু কে উড়াইয়া দিতেছে এবং দিবার প্রয়োজনই বা কি হইয়াছে, তাহা ত বুঝা গেল না! ব্রাহ্মণ পুরোহিত—বেশ ত! পুরোহিতের কাজ যিনি করিতেন, তাঁহাকেই ব্রাহ্মণ বলা হইত। যজন-যাজন করিলে ব্রাহ্মণ বলিত; যুদ্ধ, রাজ্য-পালন করিলে ক্ষত্রিয় বলিত—এ কথা ত তাঁহারা কোথাও অস্বীকার করেন নাই। আদালতে বসিয়া যাঁহারা বিচার করেন, তাঁহাদিগকে জজ বলে, উকিল বলে না। শ্রীযুক্ত গুরুদাসবাবু যখন ওকালতি করিতেন, তাঁহাকে লোকে উকিল বলিত, জজ হইলে জজ বলিত।