তাহারা বিশ্বাস করিত, মেয়েটি দেব্তা হইয়া ঐ সমস্ত বীজের মধ্যে প্রবেশ করিবে এবং শস্য ভাল হইবে। প্রাচীন মিশরেও “sacrificed red-haired men to satisfy corn-god.” সাইবেরিয়াতেও এই রকম বলির প্রথা ছিল। ইহারা কেহ আমেরিকার, কেহ আফ্রিকার, কেহ এশিয়ার, কেহ অস্ট্রেলিয়ার বাসিন্দা।
একই রকমের ভূ-দেবী পূজা। ঐক্য দেখিয়া মনে হয়, ইহারা সকলেই এক-একবার কানকাটার দেশে আসিয়া শিখিয়া গিয়াছিল। কিন্তু, কবে কেমন করিয়া আসিয়াছিল, সে কথা ইতিহাসে লেখে না, অতএব বলিতে পারিলাম না। ঠাকুরমশায় Encyclopaedia Britannica হইতে উদ্ধৃত করিয়া বলিয়াছেন “কানানাইটের দেশে numerous jars with the skeletons of infants পাওয়া গিয়াছে, এবং we cannot doubt that the sacrificing of children was practised on a large scale among the Cananites.” এ ঠিক কথা। কানানাইটরা শিশু বলি দিয়া কটাহের মধ্যে আশেরা দেবীকে নিবেদন করিত; কিন্তু তিনি কোথায় পাইলেন—খোন্দেরাও শিশু বলি দিয়া ভূ-দেবীকে নিবেদন করিত? তাহারাও শিশুহত্যা করিত সত্য, কিন্তু সে হত্যা দেবতার নৈবেদ্যের জন্য নয়। অনেকটা দারিদ্র্যের ভয়ে, অনেকটা ভূত-প্রেতের দৃষ্টি লাগিয়াছে এই কুসংস্কারে। হত্যা করা মানেই বলি দেওয়া নয়। তবে, কানানাইটের কটাহের (jars) সঙ্গে এইটুকু মাত্র ঐক্য আছে যে, কন্দকাটারাও বড় বড় জালা জলপূর্ণ করিয়া তাহাতে শিশুটিকে ডুবাইয়া মারিত। কারণ, আর কোনরূপে হত্যা করা তাহারা বিধিসঙ্গত মনে করিত না। কথাটা কোথায় পড়িয়াছি, মনে করিতে পারিতেছি না, কিন্তু কোথায় যেন পড়িয়াছি, কে একজন এক বৃদ্ধ খোন্দকে প্রশ্ন করিয়াছিল, “বাপু, তোমরা এমন যন্ত্রণা দিয়া শিশুবধ কর কেন, আর কোন সহজ উপায় অবলম্বন কর না কেন?” সে জবাব দিয়াছিল, “এ ছাড়া আর কোন উপায়ে মারা ভয়ঙ্কর ‘পাপম্’। কটাহের ঐক্য এই যা। সে দশ আনাই হউক আর ষোল আনাই হউক।
ঋতেন্দ্রবাবু বাইবেলের উক্তি উদ্ধৃত করিয়া বলিয়াছেন, “শিশুঘাতক কানানাইটরা যে সকলকে কিরূপ বিপন্ন করিয়া তুলিয়াছিল” ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু কলিঙ্গের খোন্দেরা কবে কাহাকে এমন করিয়া বিপন্ন করিয়া তুলিয়াছিল, এবং কোন্ দিন কাহার ছেলেমেয়ে চুরি করিয়া আনিয়া দেবতার পূজা দিয়াছিল, তাহা আমার জানা নাই। তাহারা যাহাকে ভূ-দেবীর নিকটে বলি দিত, তাহাকে ‘মিরিয়া’ বলিত, এবং এই ‘মিরিয়া’, তা সে নর-নারী যেই হউক, যৌবনপ্রাপ্ত না হইলে কিছুতেই দেবতাকে উৎসর্গ করা হইত না। তাহারা কানানাইটদের মত ছেলে চুরি করিয়া আনিয়া যে বলি দিত না, তাহার একটা বড় প্রমাণ এই যে, তাহারা মরণাপন্ন ‘মিরিয়া’র কর্ণমূলে এই কথা উচ্চৈঃস্বরে আবৃত্তি করিতে থাকিত, “তোমাকে দাম দিয়া কিনিয়াছি—আমাদের কোন পাপ নাই—কোন পাপ নাই—আমরা নির্দোষ।” কিন্তু কানানাইটদের সম্বন্ধে এরূপ কিছু আবৃত্তি করিবার নিয়ম ছিল কি? ছিল না। ঋতেন্দ্রবাবু নিজেও প্রবন্ধের এক স্থলে ম্যাকফার্সন সাহেবের উক্তি উদ্ধৃত করিয়া দেখাইয়াছেন, খোন্দেরা আর যাহাই হউক, চোর-ডাকাত ছিল না। তা ছাড়া, কানানাইটদের দেবমন্দিরে শিশুর পঞ্জর দেখিতে পাওয়াটা ঠাকুরমশায়ের স্বপক্ষে সাক্ষ্য দেয় না, বরং বিপক্ষে দেয়।
তিনি লিখিয়াছেন, “কানানাইটদের দেবমন্দিরাদি খনন করিতে করিতে পুরাতত্বানুসন্ধানীরা এমন সব বৃহদাকার পাত্র আবিষ্কার করিয়াছেন, যাহার মধ্য হইতে শিশুর সমগ্র পঞ্জর প্রাপ্ত হওয়া গিয়াছে। এ-সকলই দেবোদ্দেশে শিশু-বলিদানের নিদর্শন বলিয়া পণ্ডিতেরা স্বীকার করেন।”
আমিও করি। কিন্তু, তিনি একটু নিরীক্ষণ করিয়া দেখিলেই দেখিতে পাইতেন, ইহাদের বলির শিশুগুলি ভূমির উর্বরা-শক্তি বৃদ্ধিকল্পে ভূ-দেবীকে উৎসর্গ করা হইলে তাহাদের সমগ্র অস্থিপঞ্জর পাওয়া ত ঢের দূরের কথা, এক টুকরা হাড়ও মিলিত না। কারণ, পূর্বেই দেখিয়াছি, যাহারাই ভূ-দেবীর প্রীত্যর্থে নরবলি দিয়াছে, তাহারাই মৃতদেহটাকে কোন-না-কোন রকমে ভূমির সঙ্গেই মিশাইয়া দিয়াছে। প্রত্নতত্ত্বানুসন্ধানীর জন্য কটাহে করিয়া তুলিয়া রাখিয়া যায় নাই। উড়িষ্যার কন্দকাটারাও রাখে নাই। তাহারা মৃতদেহটাকে খণ্ড খণ্ড করিয়া গ্রামের সকলে মিলিয়া ভাগ করিয়া লইয়া যে যাহার নিজের ক্ষেতে পুঁতিত। এমন কি, অবশিষ্ট নাড়িভুঁড়ি হাড়গোড়গুলোকেও ছাড়িত না। দগ্ধ করিয়া জলে গুলিয়া জমিতে ছিটাইয়া তাহার উর্বরা-শক্তি বৃদ্ধি করিয়া তবে ক্ষান্ত হইত। এত দূর ত দেবীমাহাত্ম্যে এবং তাঁহার পূজার নৈবদ্যে কাটিল। ইহাতে ঐক্য এবং অনৈক্য যাহা আছে, তাহা বিচার করিবার ভার পাঠকের উপরে।
ঋতেন্দ্রবাবু এইবার দ্বিতীয় ঐক্যের অবতারণা করিয়াছেন। বলিতেছেন, “যে যেখানে থাকে, তাহার সেই আবাসস্থানের তুল্য প্রিয় আর কি হইতে পারে? তালগাছ কানাকাটাদের আবাসবৃক্ষ; এই কারণে তালগাছ ত উহাদের প্রিয় হইবেই। আবার এই তালগাছপ্রিয়তা কানানাইটের মধ্যেও বড় অল্প লক্ষিত হয় না। কানানাইটরাও বড় তালগাছভক্ত জাতি। তালজাতীয় বৃক্ষ উহাদের এতই প্রিয় যে, কানানাইটদের অন্যতম শাখার নাম ফিনীসিয়। (শব্দের উৎপত্তি তালজাতীয় গাছের নাম হইতে আসিয়াছে। ফিনীসিয় শব্দের উৎপত্তি ‘ফইনিক’ শব্দ হইতে, উহার অর্থ ‘তালের দেশ’—Phoenike signify the land of palms)”—যদিও ‘ফইনস’ অর্থাৎ লাল রং (scarlet) হইতেও ফিনীসিয়া হওয়া অসম্ভব নয়। যা হউক, ঋতেন্দ্রবাবুর এ যুক্তিটা ঠিক বোঝা গেল না। কারণ, দেশের ভাল গাছটিকে ভালবাসার মধ্যে লওয়াতে আশ্চর্য হইবার বিষয় ত কিছুই দেখিতে পাই না। কন্দকাটাদের দেশে বিস্তর তালগাছ। তাহারা তালের কড়ি বরগা করে, পাতায় ঘর ছায়, চাটাই বুনিয়া শয্যা রচনা করে। বাইবেলের কানানাইটরাও পাম (palm) বড় ভালবাসে। কারণ, ‘পাম’ তাহাদের দেশের একটি অতি উপকারী বৃক্ষ এবং দেশে আছেও বিস্তর। কিন্তু ইহাতে কি প্রমাণ করে? আমাদের হুগলি জেলার আমগাছ, তা ফলও ভাল, কাঠও ভাল, আছেও অনেক। আমরা আমগাছ ভালবাসি। বর্ধমান জেলায় কাঁঠালগাছ বিস্তর। তারা ওটা খায়ও বেশি, গাছটাকেও স্নেহ করে—ইহাতে আশ্চর্য হইবার কি আছে? কিন্তু ঋতেন্দ্রবাবু বলিতেছেন, “কারণ কি?