যাহা হোক, এই ষোল আনার স্বপক্ষে ঠাকুরমশায় বলিতেছেন—“ইহাদিগের উভয়ের দেবতা, উভয়ের আচার-প্রথার মধ্যে আশ্চর্য সাদৃশ্য। উভয় জাতির আচার-প্রথা উহাদিগের দেবদেবী ইত্যাদি সকল বিষয় আলোচনা করিলে স্পষ্টই বুঝা যায় যে, কানানাইট ও কানকাটা উহারা উভয়ে একজাতীয় জীব।…প্রথমে উহাদের দেবতা ও নরবলি-দানপ্রথা বিষয়ে যে কিরূপ ঐক্য, তাহাই দেখাইতেছি। ভারতের কানকাটা বা কন্দকাটারা যদিও নানা দেবদেবীর উপাসনা করে বটে, কিন্তু তাহাদের সর্বপ্রধান দেবতা—ভূমির উর্বরা-শক্তির দেবতা বা ভূ-দেবী ‘তরী বা ‘তাড়ী’। ভূমির উর্বরা-শক্তি এই দেবীর উপরেই নির্ভর করে বলিয়াই তাহাদের বিশ্বাস। এই দেবীর সন্তোষের জন্যই বিশেষ কর্মে তাহারা নরবলি বা শিশুবলি দিতে প্রবৃত্ত হয়।” এই উভয় জাতির দেবতা যে একই দেবতা, তাহা দেখাইবার জন্য ঋতেন্দ্রবাবু বলিয়াছেন, “কানানাইটদিগেরও প্রধান দেবতা—উর্বরা-শক্তির দেবী। Their chief deity Astart, the goddess of fertility”। “কন্দদিগের ভূ-দেবী তরী বা তাড়ী (Tari) ও কানানাইটদিগের দেবী Ishtar (স্টার) বা Astarte (আসটার্ট)—উহারা একই শব্দের বিভিন্ন রূপ মাত্র, কেবল দেশভেদে উচ্চারণভেদ ঘটিয়া সামান্য বৈলক্ষণ্য উৎপাদন করিয়াছে। যেমন, সংস্কৃত ‘তার’ বা ‘তারকা’ শব্দে পূর্বে ‘s’ যুক্ত হইয়া star হইতে দেখা যায়, সেইরূপ এই ‘তারী’ শব্দেরও পূর্বে ‘s’ বা ‘as’ যুক্ত হইয়া Ishtar বা Astarte-রূপে পরিণত হইয়াছে। উচ্চারণকালে ‘ট’য়ে ‘ড়’য়ে বিশেষ প্রভেদ নাই।” ইত্যাদি, ইত্যাদি, যেহেতু ‘র-ল-ড-লয়োরভেদঃ’। প্রথমে এই দেবীটির আলোচনা প্রয়োজন। ঐক্য যাহা থাকিবার, তাহা ত উনিই একরকম দেখাইয়াছেন, অনৈক্য কোথায়, তাহাই বলা আবশ্যক।
ঋতেন্দ্রবাবু যাই দেখিতে পাইলেন ‘উর্বরা-শক্তি’ অমনি দুইটাকে এক করিয়া ফেলিলেন। কিন্তু উর্বরা-শক্তি মানে কি জমিরই উর্বরা-শক্তি? নারীর সন্তান প্রসব করিবার শক্তিকে কি বলে? উহার কথাটা ঐ পর্যন্ত সত্য যে, উভয় জাতিই উর্বরা-শক্তির পূজা করিত, কিন্তু কানানাইটরা যে উর্বরা-শক্তির পূজা করিত তাহা জমির নয়, নারীর। কারণ, যে চিহ্ন (Symbol) দ্বারা আসটার্ট দেবীটিকে প্রকাশ করা হইত, এবং যে কারণে দেবীর মন্দিরে ‘temple prostitution’ প্রচলিত ছিল, এবং যেহেতু “the licentious worship of the devotees of Astarte in her temple in Tyre and Sidon rendered the names of these cities synonymous with all that was wicked” তাহা ভূমির উর্বরা-শক্তি হইতেই পারে না। পুরাতন ধর্ম-সম্বন্ধীয় ইতিহাসের যে-কোন একটা খুলিয়া দেখিলেই পাওয়া যায়, Astarte কে Venus-দেবীর সহিত তুলনা করা হইয়াছে। যথা—Astarte, the Syrian Venus। ‘ভীনস্’ ভূ-দেবী নয়। আরো একটা কথা, এই খোন্দদিগের তাড়ী দেবীর মত কানানাইটদের আসটার্ট সর্বশ্রেষ্ঠ দেবতা ছিলেন না। ইনি ‘বাল’ দেবতার পত্নীরূপেই পূজা পাইতেন। দেশে যতগুলি ‘বালিম’ ছিলেন ততগুলিই বিভিন্ন আসটার্ট ছিলেন।
এমন কি, এই দেবীটিকে কোন কোন স্থানে ‘শেম্বাল’ পর্যন্ত বলা হইয়াছে। ‘শেম্বাল’ অর্থে বালদেবতার ছায়া। ইনি পরে পরে অনেকগুলি নামে অভিহিত হইয়াছিলেন। (2. Kings 23. 13)। বাইবেলে আল্টারথ বলা হইয়াছে। আলেন সাহেব একস্থানে বলিয়াছেন, “The Astarte given to Hellas under the alias of Aphrodite came back again as Aphrodite to Astarte’s old Sanctuaries”। কিন্তু ইহার সাবের নাম ছিল ‘আশেরা’ সুতরাং ‘তাড়ী’র সহিত যদি কাহারো সম্বন্ধ থাকা উচিত ত এই আশেরার, আসটার্টের নয়। আমার ব্যাকরণে তেমন বোধশোধ নাই, থাকিলেও যে এই ‘আশেরা’ শব্দটাকে ‘র-ল-ড’ইয়ের জোরে ‘তাড়ী’ করিয়া তুলিতে পারিতাম, সে ভরসা ত জোর করিয়া পাঠককে দিতে পারিলাম না। তারপরে নরবলির কথা। পৃথিবীর যে-সমস্ত প্রাচীন জাতি ভূ-দেবীর পূজা করিত এবং প্রসন্ন করিতে নরবলি দিত, তাহাদের মধ্যে না পাই কোথাও আসটার্ট দেবীকে, না পাই তাঁহার ভক্ত কানানাইটদিগকে। পাইলেও ত মনে হয় না, এমন কিছু প্রমাণ করিত যে, খোন্দ এবং কানানাইট একই ধর্মের আইন-কানুন মানিয়া চলিয়াছিল। দক্ষিণ-আমেরিকার আদিম অধিবাসীরা (Indians of Guayaquil) জমিতে বীজ বপন করিবার দিনে নরবলি দিত। প্রাচীন মেক্সিকোর অধিবাসীরা “Conceiving the maize as a personal being who went through the whole course of life between seed time and harvest, sacrificed new-born babes when the maize was sown, older children when it has sprouted and so on till it was fully ripe when they sacrificed old men.” পাউনিরা ভূমির উর্বরা শক্তি বৃদ্ধি করিতে প্রতি বৎসর নরবলি দিত। দক্ষিণ-আফ্রিকার প্রাচীন কঙ্গোর রানী “used to sacrifice a man and woman in March; they were killed with spades and hoes.” গিনি প্রদেশের অনেক স্থানেই “It was the custom annually to impale a young girl alive soon after the spring equinox in order to secure good crops. A similar sacrifice is still annually offered at Benin.” বেচুয়ানা জাতিরাও ভাল ফসল পাইবার জন্য নরবলি দিত। আমাদের ভারতবর্ষের গোঁড়েরাও এক সময়ে ভূমির উর্বরা-শক্তি বৃদ্ধি করিতে ব্রাহ্মণশিশু চুরি করিয়া আনিয়া ভূ-দেবীর সম্মুখে বিষাক্ত তীর দিয়া বিদ্ধ করিয়া হত্যা করিত। অস্ট্রেলিয়ার অসভ্য অধিবাসীরাও একটি কন্যাকে জীবন্ত পুঁতিয়া ফেলিয়া ভূ-দেবীকে প্রসন্ন করিত এবং সেই গোরের উপর সমস্ত গ্রামের শস্যবীজ চুপড়িতে করিয়া রাখিয়া যাইত।