এই কারণেই বোধ হয় সতের বৎসর বয়সের সময় আমি গল্প লিখতে শুরু করি। কিন্তু কিছুদিন বাদে গল্পরচনা অ-কেজোর কাজ মনে করে আমি অভ্যাস ছেড়ে দিলাম। তারপর অনেক বৎসর চলে গেল। আমি যে কোন কালে একটি লাইনও লিখেছি, সে কথা ভুলে গেলাম।
“আঠার বৎসর পরে একদিন লিখতে আরম্ভ করলাম। কারণটা দৈব দুর্ঘটনারই মত। আমার গুটিকয়েক পুরাতন বন্ধু একটি ছোট মাসিকপত্র বের করতে উদ্যোগী হলেন। কিন্তু প্রতিষ্ঠাবান্ লেখকদের কেউই এই সামান্য পত্রিকায় লেখা দিতে রাজী হলেন না। নিরুপায় হয়ে তাঁদের কেউ কেউ আমাকে স্মরণ করলেন। বিস্তর চেষ্টায় তাঁরা আমার কাছ থেকে লেখা পাঠাবার কথা আদায় করে নিলেন। এটা ১৯১৩ সনের কথা। আমি নিমরাজী হয়েছিলাম। কোন রকমে তাঁদের হাত থেকে রেহাই পাওয়ার জন্যেই আমি লেখা দিতেও স্বীকার হয়েছিলাম। উদ্দেশ্য, কোন রকমে একবার রেঙ্গুন পৌঁছতে পারলেই হয়। কিন্তু চিঠির পর চিঠি আর টেলিগ্রামের তাড়া আমাকে অবশেষে সত্য সত্যই আবার কলম ধরতে প্ররোচিত করল। আমি তাঁদের নবপ্রকাশিত ‘যমুনা’র জন্য একটি ছোটগল্প পাঠালাম। এই গল্পটি প্রকাশ হতে না হতেই বাঙ্গালার পাঠকসমাজে সমাদর লাভ করল। আমিও একদিনেই নাম করে বসলাম। তারপর আমি অদ্যাবধি নিয়মিতভাবে লিখে আসছি। বাঙ্গালাদেশে বোধ হয় আমিই একমাত্র সৌভাগ্যবান লেখক, যাকে কোনদিন বাধার দুর্ভোগ ভোগ করতে হয়নি।’’**(‘বাতায়ন’, শরৎ স্মৃতি-সংখ্যা, ১৩৪৪)
কানকাটা
গত ফাল্গুনের (১৩১৯) ‘সাহিত্যে’ শ্রীযুক্ত ঋতেন্দ্রবাবুর “কানকাটা” ঐতিহাসিক তথ্য নির্ণীত হইয়াছে। তথ্যটি সত্য কিংবা অসত্য আলোচিত হইবার পূর্বে একটা সন্দেহ স্বতঃই মনে উঠে, ঠাকুরমশাই প্রবন্ধটি হাসাইবার অভিপ্রায়ে লিখেন নাই ত? কেননা, ইহা সত্য সত্যই সত্য আবিষ্কারের চেষ্টা এবং যথার্থই সত্য, তাহা মনে করিলেও দুঃখ হয়। তবে যদি হাসাইবার অভিপ্রায়ে লিখিয়া থাকেন, তাহা হইলে প্রবন্ধটি নিশ্চয়ই সার্থক হইয়াছে। কিন্তু আর কোন উদ্দেশ্য থাকিলে বোধ করি ব্যর্থ হইয়াছে এবং হওয়াই মঙ্গল। যাহা হউক, উক্ত প্রবন্ধে ঠাকুরমশাই বলিয়াছেন, “কানকাটা, কন্দকাটা, বা উড়িষ্যার খোন্দ জাতিরা বাইবেল-কথিত কানানাইট জাতি ভিন্ন আর কিছুই নয়।” এই ‘কিছুই নয়’টি প্রমাণ করিবার জন্য তিনি এই উভয় জাতির মধ্যে অনেক সাদৃশ্য লক্ষ্য করিয়াছেন এবং জাতিতত্ত্ব আবিষ্কার করিয়াছেন। আমার এক আত্মীয় সেদিন বলিতেছিলেন, আজকাল বাঙ্গালাদেশে ইতিহাস ও প্রত্নতত্ত্বের লেখক সবাই। কেবল ঝগড়া করিতে চায়—রামের আঁতুর-ঘর পশ্চিমমুখো কিংবা পূবমুখো ছিল। কথাটা তাঁহার নিতান্ত মিথ্যা নয় দেখিতেছি।
কিন্তু, জাতিতত্ত্ব জিনিসটি শুধু যদি খেলনার জিনিস হইত, কিংবা শখ করিয়া খান-দুই এ-ও-তা বই নাড়াচাড়া করিলেই ইহাতে ব্যুৎপত্তি জন্মিত, তাহা হইলে, আমার এ প্রতিবাদের আবশ্যকতা ছিল না। কিন্তু তাহা নহে। ইহা সত্য-উদ্ঘাটন—চুট্কি গল্প লেখা নহে। অতএব, জাতিতত্ত্ববিৎ বলিয়া প্রবন্ধ লিখিয়া খ্যাতি অর্জন করিবার পূর্বে কিছু ‘সলিড’ পরিশ্রমের আবশ্যক। সুতরাং যে দুর্ভাগারা অনেকদিন ধরিয়া গায়ের অনেক রক্ত জল করিয়া নীরস বইগুলি ঘাঁটিয়া মরিয়াছে, এ ভার তাহাদের উপর দিয়া নিশ্চিন্ত মনে সরস কবিতা এবং রসাল সাহিত্যিক প্রবন্ধে বা গল্পে মনোনিবেশ করাই বুদ্ধির কাজ। খান-দুই বই ভাসা ভাসা রকম দেখিয়া লইয়া এবং গোটা-দুই সাদৃশ্য উপরে উপরে মিলাইয়া দিয়া একটা অভিনব সত্য প্রচার করিতে পারা সাহসের পরিচয় সন্দেহ নাই; কিন্তু এ সাহসে কাজ হয় না, শুধু অকাজ বাড়ে। যেমন, তাঁহার দেখাদেখি আমার অকাজ বাড়িয়া গিয়াছে এবং যে হতভাগ্যেরা এগুলো পড়িবে, তাহাদের ত কথাই নাই। অবশ্য, পুরুষমানুষের সাহস থাকা ভাল, কিন্তু একটু কম থাকাও আবার ভাল। যা হউক কথাটা এই। ঠাকুরমশাই উড়িষ্যার (কলিঙ্গ) খোন্দ এবং বাইবেলের কানানাইটের মধ্যে গুটি পাঁচ-ছয় মিল দেখিয়াই উভয়কে সহোদর ভাই বলিয়া স্থির করিয়াছেন, কিন্তু গরমিলের ধার দিয়াও যান নাই। অবশ্য গরমিল দেখিতে যাইবার অসুবিধা আছে বটে, এবং এই অসুবিধা ভোগ না করিয়াও যা হউক একটা কিছু লেখা যায় সত্য, কিন্তু তাহাকে সত্য আবিষ্কার বলে না। যাহা বলে তাহা পিক্উইক পেপারের আরম্ভটা। তা ছাড়া, শুধু সাদৃশ্য দেখিয়াই সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যে কত বিপজ্জনক, তাহার একটা সামান্য দৃষ্টান্ত দিতেছি। এই সেদিন চন্দ্রগ্রহণ উপলক্ষে বাড়ির ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা থালায় জল লইয়া হাঁ করিয়া বসিয়াছিল।
গ্রহণ লাগিলে তাহারা দেখিবে। হঠাৎ শাশুড়ী ঠাকরুন বলিলেন, “হাঁ বৌমা, কালীচরণ যে পাঁজি দেখে বলে গেল সাতটার পূর্বেই গেরণ লাগবে, সাতটা ত বেজে গেল, কৈ একবার ভাল করে পাঁজিটা দেখ দেখি গা!” দেখিলাম, পাঁজিতে লেখা আছে, ‘দর্শনাভাব’। বলিলাম, “গেরণ হয়ত লাগবে, কিন্তু দেখা যাবে না।” ঠাকরুন বিশ্বাস করিলেন না, বলিলেন, “সে কি কথা বৌমা? কালী যে বেশ করে দেখে বলে গেল, ‘দশানা ভাব’ দেখা যাবে, আর তুমি বলছ একেবারেই দেখা যাবে না? এ কি হয়? দশানা না হউক আটানা, আটানা না হউক চার আনাও ত দেখতে পাওয়া চাই!” কালীচরণকে ডাকানো হইলে আমি আড়ালে থাকিয়া বলিলাম, “সরকারমশায়, পাঁজিতে দর্শনাভাব লেখা আছে—গেরণ ত দেখতে পাওয়া যাবে না।” কালীচরণ হাসিয়া বলিল, “বৌমা, কর্তা স্বর্গে গেছেন—তিনি বলতেন, গাঁয়ের মধ্যে পাঁজি দেখতে যদি কেউ থাকে ত সে কালী। ঐ যার নাম দর্শনাভাব, তারই নাম দশানাভাব। শুদ্ধ করে লিখতে গেলে ঐ রকম লিখতে হয়। এ বড় শক্ত বিদ্যে বৌমা, পাঁজি দেখে দেওয়া যে-সে লোকের কাজ নয়!” আমি অবাক্ হইয়া গিয়া ‘রেফের’ উল্লেখ করিয়া বলিলাম, “শ’য়ের মাথায় ঐ খোঁচাটার মত তবে কি রয়েচে? ‘আ’-কার এদিকে না থেকে ওদিকে কেন?” কিন্তু আমার কোন কথাই খাটিল না। কালীচরণ সাদৃশ্য দেখিতে পাইয়াছে—সে হটিল না। বরং আরো হাসিয়া বলিল, “বৌমা, ওগুলো শুধু দেখবার বাহার। ছাপাড়েরা মনে করেছে, ঐগুলো দিলে বেশ দেখতে হবে। শোননি, লোকে কথায় বলে—যেন ছাপাড়ের বিদ্যে! ওগুলো কিছুই নয়।” এই বলিয়া সে ‘দর্শনাভাব’কে’ ‘দশানা ভাবে’ সুপ্রতিষ্ঠিত করিয়া জয়োল্লাসে হাসিতে হাসিতে বাহির হইয়া গেল। তবু, সে বাড়ির গোমস্তা—ব্যাকরণ পড়ে নাই। সে-রাত্রে যদি সে ঠাকুরমশায়ের মত ‘র-ল-ড-লয়োরভেদঃ’ শুনাইয়া দিতে পারিত, তাহা হইলে আমার আর মুখ দেখাইবার পথ থাকিত না। যাই হউক, এ-সব ঘরের কথা,—না বলিলেও চলিত এবং কালীচরণ শুনিলে হয়ত দুঃখ করিবে, কিন্তু সামান্য ‘রেফ’টাকে তুচ্ছ করিয়া, ‘দর্শনাভাব’টাও যে দশানাভাবে দাঁড়ায়, এমন কি সাদৃশ্যের জোরে এবং ‘র-ল-ড’য়ের সাহায্যে এশিয়া মাইনরের কানানাইটও যে কলিঙ্গের কানকাটায় ষোল আনা রূপান্তরিত হয়, এই তুচ্ছ কথাটাই আজ ঠাকুরমশায়কে সবিনয় নিবেদন করিবার বাসনা করিয়াছি। এখন কোন পাঠক যদি ধরিয়া বসে, দশানাটা বুঝি, ষোল আনাটা কি? তাহা এই। উক্ত প্রবন্ধে ঠাকুরমশায় শুরুতেই বলিতেছেন—“পাঠক শুনিয়া বিস্মিত হইবেন যে, এই কানানাইটদিগের সহিত [উড়িষ্যার] কানকাটার ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধ আছে’ (দশানাভাব)। পরেই বলিতেছেন—“কানানাইটরা ইস্রেল-প্রবাসী কানকাটা ছাড়া আর কিছুই নয়” (ষোল আনা ভাব)। পাঠকেরা যে রীতিমত বিস্মিত হইবে, তাহা তিনি ঠিক ধরিয়াছেন। এমন কি, চন্দ্রগ্রহণের রাত্রের অপেক্ষাও।