মেয়ে ঘাড় নাড়িয়া বলিল—না বাবা, সে হয় না। এই বলিয়া সে তাহার হাতের একখানা ইংরাজি উপন্যাসের পাতার ভিতর হইতে খুঁজিয়া একখানা টেলিগ্রাম পিতার হাতে তুলিয়া দিল। তিনি পকেট হইতে চশমা বাহির করিয়া কাগজখানি আদ্যোপান্ত বার দুই-তিন পাঠ করিয়া, কন্যাকে ফিরাইয়া দিয়া ছোট্ট একটা নিশ্বাস ফেলিয়া বলিলেন—তাই ত ! কমলকিরণ তাঁর মা ও ভগিনীকে নিয়ে কলকাতায় আসছেন, সম্ভবত: ঘোষ-সাহেবও আসতে পারেন। কি নাগাত তাঁরা এ বাড়িতে আসবেন, কিছু জানিয়েছেন?
মেয়ে কহিল—কলকাতায় এসে বোধ হয় জানাবেন।
রে-সাহেব চশমা খুলিয়া খাপে পুরিয়া পকেটে রাখিলেন, সমস্ত মাথাজোড়া টাকের উপর ধীরে ধীরে হাত বুলাইতে বুলাইতে শুধু বলিলেন—তাই ত—
তাহার অকালবৃদ্ধ পিতার অসচ্ছলতার পরিমাণ ঠিক না জানিলেও আলেখ্য কিছুদিন হইতে তাহা সন্দেহ করিতেছিল; এবং হয়ত, এখনই এ লইয়া আলোচনাও করিত না, কিন্তু তিনি নিজেই জিজ্ঞাসা করিলেন—কত টাকা তোমার আবশ্যক বলে মনে হয়, আলো? নিতান্তই যা না হলে নয়, এমনি—
আলেখ্য মনে মনে হিসাব করিয়া কহিল—দাম ঠিক বলতে পারব না বাবা, কিন্তু গোটা-চারেক শোবার ঘর অন্তত: চাই-ই। গোটা-চারেক ড্রেসিং টেবল্, গোটা-দশেক ইজিচেয়ার—
সাহেব সভয়ে বলিয়া উঠিলেন—গোটা-দশেক! একটুখানি থামিয়া অধ্যাপকের প্রতি মুখ তুলিয়া কহিলেন, অমরনাথ, তোমার বিদেশী ছাত্রদের সম্বন্ধে—দেখ, আমি বিশেষ দুঃখিত হয়ে জানাচ্ছি, সাহায্য যে কিছু করে উঠতে পারবো, তা আমার মনে হয় না।
অধ্যাপক শুধু একটু মুচকি হাসিয়া কহিলেন—সে আমারও মনে হয় না, রায়-মশায়।
ক্রোধে আলেখ্যের সর্বাঙ্গ জ্বলিয়া গেল। তাহাদের পারিবারিক আলোচনার সূত্রপাতেই যে অপরিচিত অভদ্র লোকটার সরিয়া যাওয়া উচিত ছিল, সে শুধু কেবল বসিয়াই রহিল তাহা নয়, প্রকারান্তরে তাহাতে যোগ দিল, সে-ও আবার বিদ্রূপের ভঙ্গীতে। বিশেষ করিয়া পিতার প্রতি তাহার সম্বোধনের ভাষাটা মেয়ের কানে যেন সূঁচ বিঁধিল। ইহা সত্ত্বেও কিন্তু আলেখ্যের চিরদিনের শিক্ষা তাহাকে অসংযত হইতে দিল না, সে বাহিরের এই ভিক্ষুকটাকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করিয়া দিয়া মৃদু হাসিয়া বলিল—না হলে হবে কেন বাবা? তা ছাড়া খাটের গদিগুলো সব মেরামত করানো চাই; ঘরে কার্পেট নেই, তাও কিনতে হবে, চা এবং ডিনার সেট সব আনিয়ে দিতে হবে, হয়ত তিন-চার হাজারেও কুলোবে না, আরও বেশী টাকার দরকার হয়ে পড়বে।
বৃদ্ধ দীর্ঘনিশ্বাস মোচন করিয়া কহিলেন—সেইরকমই মনে হচ্ছে বটে।
এত বড় নিশ্বাসের পরে মেয়ের পক্ষে হাসা কঠিন, তবুও সে জোর করিয়াই হাসিয়া বলিল—যে সমাজের যে-রকম রীতি। তাঁরা এলে তুমি ত আর রাইট রয়েল ইন্ডিয়ান স্টাইলে ভাঁড় এবং কলাপাত দিয়ে তাঁদের অভ্যর্থনা করতে পারবে না, ইজিচেয়ারের বদলে কুশাসন পেতেও অতিথি-সৎকার চলবে না,—উপায় কি?
রে-সাহেব ক্ষণকাল মৌন থাকিয়া শেষে আস্তে আস্তে বলিলেন,—বেশ তাই হবে।
বাস্তবিক না হলেই যখন নয়, তখন ভাবনা বৃথা। তা হলে তুমি একটা ফর্দ তৈয়ারি করে ফেল।
আলেখ্য ঘাড় নাড়িয়া কহিল—আমি সমস্ত ঠিক করে নেব বাবা, তুমি কিছু ভেবো না।—একমুহূর্ত চুপ করিয়া থাকিয়া বলিল, তোমার ভাবনার ত কিছুই ছিল না বাবা, শুধু যদি একটুখানি চোখ রাখতে।
পিতা কথা কহিলেন না। বোধ করি, মনে মনে এই কথাই ভাবিতে লাগিলেন যে, দুই চক্ষু ত এখন বিস্ফারিত হইয়াই খুলিয়াছে, কিন্তু দুশ্চিন্তার পরিমাণ তাহাতে কমিতেছে কৈ? মেয়ে কহিল—তোমাকে কিন্তু আমি আর সত্যিই কিছু করতে দেব না বাবা, যা-কিছু করবার, আমিই করব। কত অপব্যয়ই না এই দীর্ঘকাল ধরে নির্বিঘ্নে চলে আসছে। কিসের জন্য এত লোকজন? চোখে দেখতে পায় না, কানে শুনতে পায় না, এমন বোধ হয় বিশ-পঁচিশজন কাছারি জুড়ে বসে আছে। আমরণ তারা কি ফাঁকি দিয়েই কাটাবে? আমি সমস্ত বিদায় দিয়ে ইয়ং মেন বহাল করব। ঠিক অর্ধেক লোকে ডবল কাজ পাব। কতগুলো ঠাকুরবাড়িই রয়েছে বল ত? কত টাকাই না তাতে বৃথা ব্যয় হয়। একা এর থেকেই ত বোধ হয় আমি বছরে দশ-বারো হাজার টাকা বাঁচাতে পারবো।
বৃদ্ধ বোধ করি এতক্ষণ তাঁহার আগচ্ছমান সম্মানিত অতিথিবর্গের কথাই চিন্তা করিতেছিলেন, এদিকে তেমন মন ছিল না, কিন্তু কন্যার শেষ কথাটা কানে যাইবামাত্র একেবারে চমকিয়া উঠিলেন। কহিলেন—কার থেকে বাঁচাবে বলছ মা, দেবসেবা থেকে? কিন্তু সে-সমস্ত যে কর্তাদের আমল থেকে চলে আসছে, তাতে হাত দেবে কি করে?
মেয়ে কহিল—কর্তারা নয় ত কি তোমাকে দোষ দিচ্ছি বাবা, তুমি নিজে কতগুলো পুতুলপূজো বসিয়েছ? অপব্যয়ের সূত্রপাত তাঁরাই করে গেছেন জানি, কিন্তু অন্যায় বা ভুল যাঁরাই কেন না করে থাকুন, তার সংশোধন করা ত প্রয়োজন? তোমার ত মনে আছে বাবা, মা তোমাকে কতদিন এই-সব বন্ধ করে দিতে বলেছেন।
পিতা চুপ করিয়া শুধু একদৃষ্টে কন্যার মুখের প্রতি চাহিয়া রহিলেন। সেই বিস্ময়ক্ষুব্ধ চোখের সম্মুখে আলেখ্য কেবলমাত্র যেন নিজের লজ্জা বাঁচাইবার জন্যই সহসা বলিয়া উঠিল—বাবা, তুমি কি এই-সব পুতুলপূজো বিশ্বাস কর?
পিতা কহিলেন, আমার বিশ্বাস-অবিশ্বাসের উপর ত এঁদের প্রতিষ্ঠা হয়নি মা !
কন্যা কহিল—তবে তুমি কেন এর ব্যয় বহন করবে, বাবা?
পিতা বলিলেন—আমি ত করিনে, আলো। যাঁরা মাথায় করে এনে স্থাপিত করেছিলেন, আমার সেই পিতৃপিতামহেরাই এখনো তাঁদের ভার বয়ে বেড়াচ্ছেন। যে-সব পুতুল-দেবতাদের তুমি বিশ্বাস করতে পার না মা, তাঁদেরও বঞ্চিত করতে তোমাকে আমি দিতে পারব না।