বিশেষতঃ তখনও কত আয়োজন, কত কাজ বাকী,—নিমন্ত্রিতগণের বাড়ি ও মোটর আসিবার মুহূর্ত আসন্ন হইয়া উঠিয়াছে—সে লইয়া মাথাব্যথা করিবার সময় ছিলই বা কৈ? এমনি করিয়াই এই মেয়েটির ছেলেবেলা হইতেই এতকাল কাটিয়াছে এবং ভবিষ্যতের দিনগুলাও এমনিভাবেই কাটিবার মত করিয়াই মা তাহার শিক্ষা-দীক্ষা সম্পূর্ণ করিয়া গিয়াছেন।
দিন-চারেক হইল, তাঁহারা এখানে আসিয়াছেন। জমিদারের বাড়ি, বড়লোকের বাড়ি,—বড়লোকের জন্যই নূতন করিয়া নির্মিত হইয়াছিল, কোথাও কোন ত্রুটি নাই, তথাপি কত অভাব, কত অসুবিধাই না আলেখ্যের চোখে পড়িতেছে। বসিবার ঘর, খাবার ঘর, শোবার ঘরগুলার আগাগোড়া পেণ্টিং নূতন করিয়া না করাইলে ত একটা দিনও আর বাস করা চলে না। দরজা-জানালার কদর্য রং বদল না করিলেই নয়। আসবাবগুলা মান্ধাতার কালের, না আছে ছাঁদ, না আছে তাহার শ্রী, ধূলায় ধূলায় বার্নিশ ত না থাকার মধ্যেই, সুতরাং এ বাটীতে থাকিতে হইলে এ সকলের প্রতি চোখ বুজিয়া থাকা অসম্ভব। যেমন করিয়া হউক, চার-পাঁচ হাজার টাকার কমে হইবে না। এই প্রস্তাব লইয়া সেদিন সকালে আলেখ্য তাহার পিতার দরবারে আসিয়া উপস্থিত হইল। বাবা একজন অল্পবয়সী অধ্যাপক ব্রাহ্মণের সহিত বসিয়া গল্প করিতেছিলেন, মেয়ের সহিত তাঁহার পরিচয় করিয়া দিতে কহিলেন,—ইনি আমাদের পুরোহিত বংশের দৌহিত্র, অমরনাথ ন্যায়রত্ন, আমাদের জমিদারির অন্তর্ভুক্ত বরাট গ্রামে এঁর পৈতৃক টোলে অধ্যাপনা শুরু করেছেন,—ইনি আমার কন্যা আলেখ্য রায়,—মা, এঁকে প্রণাম কর।
আদেশ শুনিয়া আলেখ্যের গা জ্বলিয়া গেল। একে ত একান্ত গুরুজন ব্যতীত ভূমিষ্ঠ প্রণাম করার রীতি তাহাদের সমাজে নাই বলিলেই হয়, তাহাতে আবার এই অপরিচিত লোকটি পুরোহিত-বংশের। এই সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে সে শিশুকাল হইতে সংখ্যাতীত অভিযোগ শুনিয়া আসিয়াছে; ইহাদের অন্ধতা ও অজ্ঞতা ও নিরতিশয় সঙ্কীর্ণতাই যে দেশের সকল অনিষ্টের মূল, ইহাদের প্রতিকূলতার জন্যই যে তাহারা হিন্দু-সমাজে স্থান পায় না, সেই বিশ্বাসই তাহার মনের মধ্যে বদ্ধমূল হইয়া আছে, এখন তাহাদেরই একজন অজানা ব্যক্তির পদতলে কিছুতেই তাহার মাথা হেঁট হইতে চাহিল না। সে হাত তুলিয়া ক্ষুদ্র একটি নমস্কার করিয়া কোনমতে তাহার পিতৃ-আজ্ঞা পালন করিল।
কিন্তু এতটুকু তাহার চক্ষু এড়াইল না যে, সে ব্যক্তি নমস্কার তাহার ফিরাইয়া দিল না, শুধু নীরবে একদৃষ্টে তাহার প্রতি চাহিয়া রহিল। আলেখ্য পলকমাত্র তাহার প্রতি দৃষ্টিপাত করিয়াছিল। সে পিতার সঙ্গেই কথা কহিতে আসিয়াছিল,—সুতরাং যে অপরিচিত, তাহাকে অপরিচিতের মতই সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করিয়া দিয়া তাঁহার সঙ্গেই কথা কহিতে নিরত হইল, তথাপি সকল সময়েই সে যেন অনুভব করিতে লাগিল, এই অপরিচিত অধ্যাপকের অভদ্র বিস্মিত দৃষ্টি তাহাকে পিছন হইতে যেন নিঃশব্দে আঘাত করিতেছে।
আলেখ্য কহিল—বাবা, ঘরগুলো সব কি হয়ে আছে, তুমি দেখেছ?
পিতা কিছু আশ্চর্য হইয়া বলিলেন—কেন মা, বেশ ভালই ত আছে।
কন্যা ওষ্ঠ কুঞ্চিত করিল। কহিল—ওকে তুমি ভাল বল বাবা? বিশেষ করে বসবার আর খাবার ঘর দুটো? আমার ত মনে হয়, তাড়াতাড়ি একবার পেণ্ট করিয়ে না দিলে ওতে না-বসা, না-খাওয়া কোনটাই চলবে না। আচ্ছা, লোকগুলো তোমার এতদিন করছিল কি? আমার মতে এদের সব জবাব দেওয়া দরকার। পুরানো লোক দিয়ে হয় না,—তারা শুধু ফাঁকিই দেয়।
পিতা মাথা নাড়িয়া সায় দিলেন, কিন্তু আস্তে আস্তে বলিলেন—সে ঠিক কথাই বটে, কিন্তু হলোও ত অনেকদিন মা,—বাস না করলেও ঘরদোরের শ্রী থাকে না।
আলেখ্য কহিল—সে শ্রী অন্যরকমের, নইলে এ কেবল তাদের অযত্নে অবহেলায় নষ্ট হয়েছে। আমি ম্যানেজার থেকে চাকর মালী পর্যন্ত সকলের কৈফিয়ত নেবো। দোষ পেলেই শাস্তি দেবো, বাবা, তুমি কিন্তু তাতে বাধা দিতে পারবে না।
পিতা হাসিয়া কহিলেন—বাধা দিতে যাব কেন মা, সমস্তই ত তোমার। তোমার ভৃত্যদের তুমি শাসন করবে, আমি কেন নিষেধ করব? বেশ জানি, অন্যায় তুমি কারও ‘পরেই করবে না।
কন্যা মনে মনে খুশী হইল। কহিল—ফার্নিচারগুলোর দশা এমন হয়েছে যে, সেগুলো ফেলে দিলেই হয়। চার-পাঁচ হাজার টাকার কমে বোধ করি কিছুই করতে পারা যাবে না।
—এত টাকা? বৃদ্ধ শঙ্কিত হইয়া কহিলেন—কিন্তু এ জঙ্গলে তুমি ত থাকতে পারবে না আলো, দু’দিনের জন্যে খরচ করে সমস্তই আবার এমনি ধারা নষ্ট হয়ে যাবে।
আলেখ্য মাথা নাড়িল। কহিল—আমি স্থির করেছি বাবা, এবার আমরা থাকবো। যদি যেতেও হয়, বছরে অন্তত: দু’বার করে আমরা বাড়িতে আসবই। চোখ না রাখলে সমস্তই নষ্ট হয়ে যাবে, এ আমি নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছি।
পিতা প্রফুল্লমুখে বারবার মাথা নাড়িয়া বলিলেন—এতকাল পরে এ কথা যদি বুঝে থাক আলো, তার চেয়ে সুখের কথা আর কি আছে?—এই বলিয়া অধ্যাপকটিকে সম্বোধন করিয়া কহিলেন—কি বল অমরনাথ, এতদিনে মেয়ে যদি এ কথা বুঝে থাকেন, তার চেয়ে আনন্দের কথা কি আছে?
অধ্যাপক হাঁ না কোন মন্তব্যই প্রকাশ করিলেন না, কিন্তু কন্যা হাসিয়া কহিল—আমার বুঝতে ত খুব বেশীদিন লাগেনি বাবা, লাগলো তোমার। বছর দশ-পনর আগেও যদি বুঝতে, আজ আমাকে আবার সমস্ত নূতন করে করতে হ’ত না।
কন্যার ইচ্ছাকে বাধা দিবার শক্তি বৃদ্ধের ছিল না। কিন্তু তাঁর মুখ দেখিয়া স্পষ্ট বুঝা গেল, তিনি অত্যন্ত উদ্বিগ্ন হইয়া উঠিয়াছেন। কহিলেন—যদি করতেও হয়, তার তাড়াতাড়ি কি? ধীরেসুস্থে করলেও ত চলবে।