মাত্র ঘণ্টা তিন-চার পূর্বেই যে তিনি প্রায় উলটা কথা বলিয়াছিলেন, তাহা স্মরণ করাইয়া কোন লাভ নাই। আলেখ্য নিঃশব্দে চিঠিখানা তুলিয়া লইয়া আলোর সম্মুখে গিয়া এক নিঃশ্বাসে তাহা পড়িয়া ফেলিল। চিঠি তাঁহার ম্যানেজারের। তিনি দুঃখ করিয়া, বরঞ্চ কতকটা ক্রোধের সহিতই জানাইতেছেন যে, জমিদারির অবস্থা অতিশয় বিশৃঙ্খল। তিনি উপর্যুপরি কয়েকখানা পত্রে সকল বৃত্তান্ত সবিস্তারে নিবেদন করিয়াও প্রতিবিধানের কোন আদেশ পান নাই। অপিচ, প্রকারান্তরে তাহাদের প্রশ্রয় দেওয়াই হইয়াছে। দুর্বৃত্তরা ক্রমশ: এরূপ স্পর্ধিত হইয়া উঠিয়াছে যে, তাঁহাকেই অপমান করিয়াছে। এমন কি, তিনি লোকজন লইয়া স্বয়ং উপস্থিত থাকা সত্ত্বেও অমরপুরের হাটে বিলাতী বস্ত্র বিক্রয় একপ্রকার বন্ধ করিয়া দিয়াছে। তাহাতে জমিদারির আয় অত্যন্ত কমিয়া গিয়াছে। অবশেষে নিরুপায় হইয়াই তিনি সকল ঘটনা ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবের গোচর করায় ইহাদের প্ররোচনায় বিদ্রোহী প্রজারা ধর্মঘট করিয়া খাজনা আদায় বন্ধ করিয়াছে। এমন কি, লুটপাটের ভয়ও দেখাইতেছে। সরকারী খাজনা জমা দিবার সময় হইয়া আসিল, কিন্তু তহবিলে কিছুমাত্র টাকা মজুদ নাই। ইহার আশু প্রতিকার প্রয়োজন। জনরব এইরূপ যে, মালিক নিজে না আসিলে কোন উপায় হইবে না।
চিঠি পড়িয়া আলেখ্যের মুখ ফ্যাকাশে হইয়া গেল। রুদ্ধকণ্ঠে বলিল—বাবা, তুমি নিজে যাচ্ছো?
বাবা বলিলেন—নিজে না গেলে কি হয় মা? যাবো আর আসবো !—একটা দিনে সমস্ত শায়েস্তা হয়ে যাবে। ঘোষ-সাহেবকে বলে যাবো, তিনি দু’বেলা এসে দেখবেন, তোমার কোন কষ্ট হবে না।
মেয়ে সে কথায় কর্ণপাত না করিয়া কহিল—ম্যানেজারবাবু তোমাকে বারবার সতর্ক করেছেন, তবু তুমি কিছুই করোনি বাবা?
সাহেব সতেজে বলিলেন—করেছি বৈ কি, নিশ্চয় করেছি। বোধ হয়, চিঠির জবাবও দিয়েছি।
মেয়ে ক্ষণকাল বাপের মুখের পানে চাহিয়া থাকিয়া কহিল—বোধ হয় দাওনি বাবা, তুমি ভুলে গেছ।
সাহেবের গলার সুর সহসা নীচের পর্দায় নামিয়া আসিল,—কহিলেন—ভুলে যাবো কেন? এই যে সেদিন নিজের হাতে লিখে দিলাম, লোকেরা বিলিতী কাপড় যদি পরতে না চায় ত হাটে এনে কাজ নেই। তাতে লোকসান ছাড়া ত লাভ নেই কারো—
তাঁহার কথা শেষ না হইতেই আলেখ্য ভীতকণ্ঠে জিজ্ঞাসা করিয়া উঠিল—এ চিঠি আবার তুমি কাকে লিখলে বাবা? কৈ, ম্যানেজারবাবুর পত্রে ত এর কোন কথা নেই।
সাহেব চিন্তিত মুখে বলিলেন—ঐ যে সব কারা কলকাতা থেকে এসে গ্রামে গ্রামে নাইট ইস্কুল খুলেছে। চাষাভুষোদের সব মত জেনে আমার হুকুম চেয়েছিল,—তা বেশ ত, তারা যে ইচ্ছে করুক না, আমার কি? আমার খাজনা পেলেই হ’ল।
মেয়ে জিজ্ঞাসা করিল—তা হলে আমাদের গ্রামেও নাইট ইস্কুল খোলা হয়েছে?
বাবা সগর্বে বললেন—নিশ্চয় হয়েছে ! নিশ্চয় হয়েছে। আমিই ত বলে দিলাম, মন্দিরের নাটবাংলাটা পড়ে আছে, ইচ্ছে হয় তাতেই করুক। সামান্য একটু তেলের খরচা বৈ ত না।
মেয়ে কহিল—তেলের খরচও বোধ হয় কাছারি থেকেই দেওয়া হচ্ছে?
বাবা বলিলেন—হুকুম ত দিয়েছি, এখন না যদি করে, দূর থেকে আর কত দেখি বল?
মেয়ে কিছুক্ষণ চুপ করিয়া পিতার মুখের প্রতি চাহিয়া থাকিয়া শেষে ধীরে ধীরে বলিল—বাবা, তুমি ও-ঘরে গিয়ে ব’সগে, আমি নিজে সব গুছিয়ে নিচ্ছি। তোমার সঙ্গে আমিও যাবো।
পিতা সবিস্ময়ে কহিলেন—তুমি যাবে?
আলেখ্য বলিল,—হাঁ বাবা—আমার বোধ হয়, আমি না গেলে চলবে না।
জাগরণ – ০২
দুই
পিতার সঙ্গে আলেখ্য জীবনে এই প্রথম তাহার স্বর্গীয় পিতামহগণের পল্লীবাসভবনে আসিয়া উপস্থিত হইল। বয়স তাহার বেশী নয়, তথাপি এই বয়সেই সে তিনবার য়ুরোপ ঘুরিয়া আসিয়াছে। দার্জিলিং ও সিমলার পাহাড় বোধ করি কোন বৎসরেই বাদ পড়ে নাই; চা ও ডিনারের অসংখ্য নিমন্ত্রণ রক্ষা করিয়াছে এবং মা বাঁচিয়া থাকিতে নিজেদের বাটীতেও তাহার ত্রুটিহীন বহু আয়োজনে যোগ দিয়াছে। গান-বাজনার মজলিস হইতে শুরু করিয়া খেলাধূলা ও সাধারণ সভা-সমিতিতে কিভাবে চলাফেরা করিতে হয়, সোসাইটিতে কেমন করিয়া কথাবার্তা কহিতে হয়, কোথায়, কবে এবং কোন্ সময়ে কি পোশাক পরিতে হয়, কোন রং, কোন্ ফুল কখন কাহাকে মানায়, এ-সকল ব্যাপার সে নির্ভুলভাবে শিক্ষা করিয়াছে; রুচি ও ফ্যাশন সম্বন্ধে জ্ঞানলাভ করিবার বাকি কিছু আর তাহার নাই, শুধু কেবল এই খবরটাই সে এতকাল লয় নাই, এ-সকল কোথা হইতে এবং কেমন করিয়া আসে। মা ও মেয়ে এতদিন শুধু এতটুকু মাত্র জানিয়াই নিশ্চিন্ত ছিলেন যে, বাংলাদেশের কোন্ এক পাড়াগাঁয়ে তাহাদের কল্পবৃক্ষ আছে, তাহার মূলে জলসেক করিতে হয় না, খবরদারি লইতে হয় না, শুধু তাহাতে সময়ে ও অসময়ে নাড়া দিলেই সোনা ও রূপো ঝরিয়া পড়ে। জননী ত কোনদিনই গ্রাহ্য করেন নাই, কিন্তু আলেখ্য কখন কখন যেন লক্ষ্য করিয়াছে, এই বিপুল অপব্যয়ের যোগান দিতে পিতা যেন মাঝে মাঝে কেমন একপ্রকার বিরস ম্লান ও অবসন্ন হইয়া পড়িতেন। তাহাকে এমন আভাস দিতেও সে দেখিয়াছে বলিয়াই মনে পড়ে, যেন এতখানি বাড়াবাড়ি না হইলেই হয় ভাল। অথচ প্রত্যুত্তরে মায়ের মুখে কেবল এই কথাই সে শুনিয়া আসিয়াছে যে, সমাজে থাকিতে গেলে ইহা না করিলেই নয়। শুধু অসভ্যদের মত বনে-জঙ্গলে বাস করিলেই কোন খরচ করিতে হয় না।
পিতাকে প্রতিবাদ করিতে কখন দেখে নাই,—কিন্তু চুপ করিয়া এমন নির্জীবের মত বসিয়া থাকিতে দেখিয়াছে যে, ধুমধামের মাঝখানে গৃহকর্তার সে আচরণ একেবারেই বিসদৃশ। কিন্তু সে ত ক্ষণিকের ব্যাপার, ক্ষণকাল পরে সে ভাব হয়ত আর তাঁহাতে থাকিত না।