ইন্দুর দাদা কমলকিরণ যখন বিলাতে ব্যারিস্টারি পড়িতে যায়, তখন এই শর্তই হইয়াছিল যে, সে পাস করিয়া ফিরিলে তাহারই হাতে কন্যা সম্প্রদান করিবেন। বছর-খানেক হইল কমলকিরণ পাস করিয়া কে. কে. ঘোষ হইয়া দেশে ফিরিয়াছে, তাহার পিতা-মাতা মৃত-পত্নীর প্রতিশ্রুতিও বার-কয়েক রে সাহেবের গোচর করিয়াছেন, কিন্তু এমনি দুর্বলচিত্ত তিনি যে, হাঁ কিংবা না, কোনটাই অদ্যাবধি মনস্থির করিয়া উঠিতে পারেন নাই। ইন্দুদের বাটীতে টুর্নামেন্ট দেখিবার নিমন্ত্রণমাত্রই কেন যে তিনি অমন করিয়া আপনাকে খবরের কাগজের মধ্যে নিমগ্ন করিয়া ফেলিলেন, ইহার যথার্থ হেতু মেয়ে যাহাই বুঝুক, ইন্দুর মা শুনিলে তাহার অন্যপ্রকার অর্থ করিতেন। তথাপি আলেখ্যকে বধূ করিবার চেষ্টা হইতে তিনি এখনও বিরত হন নাই। তাহার মত মেয়ে রূপে গুণে দুর্লভ নয় তিনি জানিতেন, কিন্তু রোগগ্রস্ত পিতার মৃত্যুর পরে যে সম্পত্তি তাহার হস্তগত হইবে, তাহা যে সত্যই দুর্লভ, ইহাও তিনি ভাল করিয়াই জানিতেন। অন্যপক্ষে পাত্র হিসাবে কমলকিরণ অবহেলার সামগ্রী নহে। সে শিক্ষিত রূপবান; পিতার জুনিয়ারি করিতেছে,—ভবিষ্যৎ তাহার উজ্জ্বল। মা কথা দিয়াছিলেন, আলেখ্য তাহা জানিত। ইন্দু ও তাহার জননী যখন-তখন তাহা শুনাইতেও ত্রুটি করিতেন না। সকলেই প্রায় একপ্রকার নিশ্চিত ছিলেন যে, অল্পবুদ্ধি বৃদ্ধের মনস্থির করিতে বিলম্ব হইতে পারে, কিন্তু স্থির যখন একদিন করিতেই হইবে, তখন এদিকে আর নড়চড় হইবে না। প্রমাণস্বরূপে তিনি আলেখ্যের সুমুখেই তাঁহার স্বামীকে বলিতেন, সন্দেহ করবার আমি ত কোন কারণ দেখিনে। অমত থাকলে মিঃ রে কখনও আলোকে এমন একলা আমাদের বাড়ি পাঠাতেন না। মনে মনে তিনি খুব জানেন, তাঁর মেয়ে আপনার বাড়িতে আপনার লোকজনের কাছেই যাচ্ছে। কি বলো মা আলো? কমল উপস্থিত থাকিলে মুখ তাহার রাঙ্গা হইয়া উঠিত। পুরুষেরা না থাকিলে সে সহজেই সায় দিয়া সলজ্জকণ্ঠে কহিত—বাবা ত সত্যিই জানেন, আপনি আমার মায়ের মত।
এই একটা বছর এমনিভাবেই কাটিয়া গিয়াছিল।
টেনিস টুর্নামেন্টের অদ্যকার পালা সমাপ্ত হইলে ইন্দুদের বাটীতে চা ও সামান্য কিছু জলযোগের ব্যবস্থা ছিল। সে-সকল শেষ হইতে সন্ধ্যা বহুক্ষণ উত্তীর্ণ হইয়া গেল; কিন্তু সেদিকে আলেখ্যের আজ খেয়ালই ছিল না।
সে ভাল খেলিত, কানপুর হইতে যাঁহারা আসিয়াছিলেন, তাঁহারা হারিয়া গিয়াছিলেন, সেই জয়ের আনন্দে মন তাহার আজ অত্যন্ত প্রসন্ন ছিল। তথাপি ইন্দুর গান শেষ না হইতেই তাহাকে ঘড়ির দিকে চাহিয়া অলক্ষ্যে উঠিয়া পড়িতে হইল এবং সঙ্গীহীন পিতার কথা স্মরণ করিয়া বিদায়গ্রহণের প্রচলিত আচরণটুকু পরিহার করিয়াই তাহাকে দ্রুতপদে নীচে নামিয়া আসিতে হইল। মোটর তাহার প্রস্তুত ছিল, শোফার দ্বার খুলিয়া দিতেই গাড়িতে উঠিয়া পরিশ্রান্ত দেহলতা সে এলাইয়া দিয়া বসিল। রাত্রি অন্ধকার নহে, আকাশে চাঁদ উঠিয়াছে, অদূরে একটা বিলাতী লতার কুঞ্জ হইতে একপ্রকার উগ্র গন্ধে নিঃশ্বাসের বাতাস যেন ভারী হইয়া উঠিয়াছে। অত্যধিক খেলার পরিশ্রমে সে ক্লান্ত, কিন্তু যৌবনের উষ্ণ রক্ত তখনও খরবেগে শিরার মধ্যে বহিতেছে—এমন না বলিয়া চুপি চুপি আসাটা ভাল হইল না, সে ভাবিতেছে, এমন সময়ে ঠিক কানের কাছে শুনিল, হঠাৎ পালিয়ে এলে যে আলো?
আলেখ্য চকিত হইয়া উঠিয়া বসিয়া কহিল,—এঁরা কিছু বলছেন বুঝি?
কমল হাসিয়া কহিল—না। তার কারণ, আমি ছাড়া আর কেউ জানতেই পারেন নি। কিন্তু আমার চোখকে ফাঁকি দেওয়া শক্ত। জ্যোৎস্নার আলোকে আলেখ্যের মুখের চেহারা দেখা গেল না। সে নিজেকে সামলাইয়া লইয়া কহিল—আপনি ত জানেন, বাবা একলা আছেন, একটু রাত হলেই তিনি বড় ব্যস্ত হন।
কমল ঘাড় নাড়িয়া বলিল—জানি এবং সেই জন্যে রাত করা তোমার উচিতই নয়।
শোফার গাড়িকে প্রস্তুত করিয়া উঠিয়া বসিতেই কমল চুপি চুপি বলিল—হুকুম দাও ত তোমাকে পৌঁছে দিয়ে আসি।
আলেখ্য মনে মনে লজ্জা বোধ করিল, কিন্তু না বলিতে পারিল না। শুধু জিজ্ঞাসা করিল, আপনি ফিরবেন কি করে?
কমল কহিল—চমৎকার রাত, দিব্যি বেড়াতে বেড়াতে ফিরে আসবো। তখন পর্যন্ত হয়ত এঁরা কেউ টেরও পাবেন না। এই বলিয়া সে নিজেই দরজা খুলিয়া আলেখ্যের পাশে আসিয়া উপবেশন করিল।
বেশী দূর নয়, মিনিট পাঁচ-ছয় মাত্র। অতি প্রয়োজনীয় কথার জন্য ইহাই পর্যাপ্ত। কিন্তু কোন কথাই হইল না, পাশাপাশি উভয়ে চুপ করিয়া বসিয়া। গাড়ি রে-সাহেবের ফটকে আসিয়া প্রবেশ করিল। আলেখ্যের অত্যন্ত লজ্জা করিতেছিল, মোটরের শব্দে বাবা নিশ্চয়ই বারান্দায় আসিয়া দাঁড়াইবেন, কিন্তু উপরের বারান্দা শূন্য, কোথাও কেহ নাই।
দু’জনে অবতরণ করিলে শোফার গাড়ি লইয়া প্রস্থান করিল। কমল মৃদুকণ্ঠে বিদায় লইয়া ফিরিল, হলে ঢুকিয়া আলেখ্য বেহারাকে সভয়ে প্রশ্ন করিল—সাহেব কোথায়?
সে সেলাম করিয়া জানাইল, তিনি উপরের ঘরেই আছেন।
আলেখ্য দ্রুতপদে সিঁড়ি বাহিয়া উপরে উঠিয়া তাহার পিতার ঘরে ঢুকিয়া একেবারে আশ্চর্য হইয়া গেল। আলমারি খোলা, ঘরময় জিনিসপত্র ছড়ানো, সাহেব নিজে আর একটা বেহারাকে দিয়া বড় বড় দুটো তোরঙ্গ ভর্তি করিতেছেন।
এ কি বাবা, কোথাও যাবে নাকি?
সাহেব চমকিয়া ফিরিয়া দাঁড়াইয়া বলিলেন—দেখ্ দিকি সব কাণ্ড! তখন বলেছি, গান্ধী সর্বনাশ করবে! এই সব স্বদেশী গুণ্ডারা দেশটাকে লণ্ডভণ্ড করে তবে ছাড়বে, এ যে আমি শুরুতেই দেখতে পেয়েছি! এই বলিয়া তিনি পকেট হইতে একটা চিঠি লইয়া মেয়ের পায়ের কাছে ফেলিয়া দিলেন। বলিলেন, এদের সবাইকে ধরে জেলে না পাঠালে যে সমস্ত দেশ অরাজক হতে বাধ্য।