কন্যার অভিযোগে পিতা একটু অপ্রতিভ হইয়া বলিলেন—না না, আমাকে তুমি ভুল বুঝেছ আলো। এই সব দুরন্তপনা আমি মোটেই পছন্দ করিনে এবং যারা করে তাদের শাস্তি দিতেই বলি। কিন্তু তাও বলি, মিস্টার ঘোষের সেদিন গাড়িতে না বার হওয়াই উচিত ছিল। দেশে এতগুলো লোকের সনির্বন্ধ অনুরোধ উপেক্ষা করাই কি ভাল মা?
আলেখ্য রাগ করিয়া কহিল—অনুরোধ করলেই হল বাবা? বরঞ্চ, আমি ত বলি, অন্যায় অনুরোধ যেদিক থেকেই আসুক, তাকে অগ্রাহ্য করাই যথার্থ সাহস। এ সাহস তাঁর ছিল বলে তাঁকে বরঞ্চ ধন্যবাদ দেওয়াই উচিত।
রে-সাহেব সামান্য একটুখানি উত্তেজনার সহিত প্রশ্ন করিলেন—এ অনুরোধ অন্যায়, এ তুমি কি করে বুঝলে আলো?
আলেখ্য কহিল—তাঁর নিজের গাড়িতে চড়বার তাঁর সম্পূর্ণ অধিকার আছে। নিষেধ করাই অন্যায়।
তাহার পিতা বলিলেন—এটা অত্যন্ত মোটা কথা মা।
কন্যা কহিল—মোটা কথাই বাবা, এবং এই মোটা কথা মেনে চলবার বুদ্ধি এবং সাহসই যেন সংসারে বেশী লোকের থাকে।
সেদিন গাড়ির এই কাঁচভাঙ্গা লইয়া ইন্দুদের বাটীতে যে-সকল তীক্ষ্ণ ও কঠিন আলোচনা হইয়াছিল, সে-সকল আলেখ্যের মনে ছিল, তাহারই সূত্র ধরিয়া কণ্ঠস্বর তাহার উত্তপ্ত হইয়া উঠিল; কহিল, তিনি কিছুই অন্যায় করেন নি, বরঞ্চ যে-সব ভীতু লোক ভয়ে ভয়ে এই-সব স্বদেশী গুণ্ডাদের প্রশ্রয় দিয়েছিল, তারাই ঢের বেশী অন্যায় করেছিল বাবা, এ তোমাকে আমি নিশ্চয় বলছি।
সাহেবের মুখ মলিন হইল। কিন্তু আলেখ্যেরও চক্ষের পলকে মনে পড়িল, তাঁহার পিতা অসুস্থ শরীরেও সেদিন সকালে পায়ে হাঁটিয়া ডাক্তারখানায় গিয়েছিলেন এবং ডাক্তারের বারংবার আহ্বান সত্ত্বেও তেমনি হাঁটিয়াই বাটী ফিরিয়াছিলেন। পাছে তাহার তীক্ষ্ণ মন্তব্য ঘুণাগ্রেও পিতার কার্যের সমালোচনার মত শুনাইয়া থাকে, এই লজ্জায় সে একেবারে সঙ্কুচিত হইয়া উঠিল। তাহার ভগ্নস্বাস্থ্য দুর্বলচিত্ত পিতাকে সে ভাল করিয়াই জানিত। দেহের ও মনের কোনদিন কোন তেজ ছিল না বলিয়া তিনি সংসারে সকল সুবিধা পাইয়াও কখনও উন্নতি করিতে পারেন নাই। শত্রু-মিত্র অনেকের কাছে, বিশেষ করিয়া নিজের স্ত্রীর কাছে অনেকদিন অনেক কথাই এই লইয়া তাঁহাকে শুনিতে হইয়াছে, ফলোদয় কিছুই হয় নাই। এমনি ভাবেই সারা জীবন কাটিয়াছে,—কিন্তু সেই জীবনের আজ অপর প্রান্তে পৌঁছিয়া মেয়ের মুখ হইতে সেই সকল পুরানো তিরস্কারের পুনরাবৃত্তি শুনিলে দুঃখের আর বাকি কিছু থাকে না।
আলেখ্য তাড়াতাড়ি পিতার কাছে আসিয়া তাঁহার কাঁধের উপর একটা হাত রাখিয়া আদর করিয়া কহিল—কিন্তু তাই বলে তুমি যেন ভেবো না বাবা, তোমার কোন কাজকে আমি অন্যায় মনে করি।
পিতা একটু আশ্চর্য হইয়া জিজ্ঞাসা করিলেন—আমার কোন্ কাজ মা? সেদিনকার নিজের কথা তাঁহার মনেও ছিল না।
মেয়ে বাপের মুখের কাছে ঝুঁকিয়া পড়িয়া বলিল—কোন কাজই নয় বাবা, কোন কাজই নয়। অন্যায় তুমি যে কিছু করতেই পারো না। তবুও তোমাকে যারা সেদিন অসুখ শরীরে ডাক্তারখানায় হেঁটে যেতে-আসতে বাধ্য করলে, বল ত বাবা, তারা কতখানি অন্যায় অত্যাচার করেছিল।
সাহেবের ঘটনাটা মনে পড়িল। তিনি সস্নেহে মেয়ের মাথার উপর ধীরে ধীরে হাত চাপড়াইতে চাপড়াইতে বলিলেন—ওঃ, তাই বুঝি তাদের ওপর তোর রাগ আলো?
এই পিতাটিকে ভুলাইতে আলেখ্যের কষ্ট পাইতে হইত না। সে কৃত্রিম ক্রোধের স্বরে কহিল—রাগ হয় না বাবা?
বাবা হাসিয়া বলিলেন—না মা, রাগ হওয়া উচিত নয়, বরঞ্চ সে আমার বেশ ভালই লেগেছিল। ছোট-বড় উঁচু-নিচু নেই, সবাই পায়ে হেঁটে চলেছে, পা যে ভগবান দিয়েছেন, তার ব্যবহারে যে লজ্জা নেই, এ কথা সেদিন যেমন অনুভব করেছিলাম মা, এমন আর কোনদিন নয়। বহুকাল এ কথা আমার মনে থাকবে আলো।
ইহা যে কোন যুক্তি নয়, আলেখ্য তাহা মনে মনে বুঝিল, তথাপি এই লইয়া আর নূতন তর্কের সৃষ্টি করিল না। ঘড়িতে পাঁচটা বাজিতেই কহিল—চল না বাবা, আজ আমাদের টুর্নামেন্ট দেখতে যাবে। ইন্দুর মা যে কত খুশী হবেন, তা আর বলতে পারিনে।
পিতাকে কোনকালেই সহজে বাটীর বাহির করা যাইত না, বিশেষ করিয়া তাহার মায়ের মৃত্যুর পর। ঘর এবং এই ঢাকা বারান্দাটি ধীরে ধীরে তাঁহার কাছে সমস্ত পৃথিবীতে পরিণত হইতেছিল। জড়তায় দেহ ক্রমশ: ভাঙ্গিয়া আসিতেছিল, কিন্তু কোথাও বাহির হইবার প্রস্তাবেই তাঁহার মাথায় যেন বজ্রাঘাত হইত। মেয়ের কথায় ভয় পাইয়া তাড়াতাড়ি বলিলেন—এখন? এই অসময়ে?
মেয়ে হাসিয়া বলিল—এই ত বেড়াতে যাবার সময় বাবা।
কিন্তু আমার যে বিস্তর চিঠি লেখবার রয়েছে আলো! তুমি বরঞ্চ একটু শীঘ্র শীঘ্র ফিরো, যেন অধিক রাত না হয়, আমি ততক্ষণ হাতের কাজগুলো সেরে ফেলি। এই বলিয়া তিনি তৎক্ষণাৎ সংবাদপত্রে মনঃসংযোগ করিলেন।
এই মেয়েটির ক্ষুদ্র জীবনের একটু সংক্ষিপ্ত ইতিহাস এইখানে দেওয়া প্রয়োজন। আলেখ্য নামটি মা রাখিয়াছিলেন বোধ করি নূতনত্বের প্রলোভনে। হয়ত এমন অভিসন্ধিও তাঁহার মনে গোপনে ছিল, হিন্দুদের কোন দেবদেবীর সহিতই না ইহার লেশমাত্র সাদৃশ্য কেহ খুঁজিয়া পায়; কিন্তু পিতা প্রথম হইতেই নামটা পছন্দ করেন নাই, সহজে উচ্চারণ করিতেও একটু বাধিত, তাই মেয়েকে তিনি ছোট করিয়া আলো বলিয়াই ডাকিতেন। এই সোজা নামটাই তাহার ক্রমশ: চারিদিকে প্রচলিত হইয়া গিয়াছিল। ইন্দুদের সহিত তাহার পরিচয় ছেলেবেলার। ইন্দুর মা ও তাহার মা স্কুলে একত্রে পড়িয়াছিলেন, কিছুকাল এক বোর্ডিঙে বাস করিয়াছিলেন এবং আমরণ অতিশয় বন্ধু ছিলেন।