ব্যারিস্টারি পাস করিয়া বিলাত হইতে দেশে ফিরিয়া তাঁহারই মত আর এক ‘সাহেবে’র বিদুষী কন্যাকে বিবাহ করেন এবং যথাক্রমে অযোধ্যা, প্রয়াগ, বোম্বাই এবং পাঞ্জাবে প্র্যাক্টিস করেন। ইতিমধ্যে স্ত্রী, পুত্র এবং কন্যা লইয়া বার-তিনেক বিলাত যাতায়াত করেন এবং আর যাহা করেন, তাহা এই গল্পের সম্বন্ধে নিষ্প্রয়োজন। ছেলেটি ত ডিফ্থিরিয়া রোগে শৈশবেই মারা যায়, এবং পত্নীও দীর্ঘকাল রোগভোগের পর বছর-তিনেক হইল নিষ্কৃতি লাভ করিয়াছেন। সেই হইতে রে সাহেবেও প্র্যাক্টিস বন্ধ করিয়াছেন। ঐ ঐ স্থানগুলায় যথেষ্ট-পরিমাণ অর্থ না থাকার জন্যই হউক বা স্ত্রীর মৃত্যুতে বৈরাগ্যোদয় হওয়াতেই হউক, এক সাহেবিআনা ব্যতীত আর সমস্তই ত্যাগ করিয়া তিনি একমাত্র মেয়েটিকে লইয়া পশ্চিমের একটা বড় শহরে নির্বিঘ্নে বাস করিতেছিলেন। এমনি সময়ে একদিন তাঁহার নিশ্চিন্ত শান্তি ও সুগভীর বৈরাগ্য দুই-ই যুগপৎ আলোড়িত করিয়া মহাত্মা গান্ধীর নন্-কোঅপারেশনের প্রচণ্ড তরঙ্গ একমুহূর্তে একেবারে অভ্রভেদী হইয়া দেখা দিল। হঠাৎ মনে হইল, এই ভয়লেশহীন শুদ্ধ শান্ত সন্ন্যাসীর সুদীর্ঘ তপস্যা হইতে যে ‘অদ্রোহ অসহযোগ’ নিমিষে বাহির হইয়া আসিল, ইহার অক্ষয় গতিবেগ প্রতিরোধ করিবার কেহ নাই। যেথায় যত দুঃখ-দৈন্য, যত উৎপাত-অত্যাচার, যত লোভ ও মোহের আবর্জনা যুগ-যুগান্ত ব্যাপিয়া সঞ্চিত হইয়া আছে, ইহার কিছুই কোথাও আর অবশিষ্ট থাকিবে না, সমস্তই এই বিপুল তরঙ্গবেগে নিশ্চিহ্ন হইয়া ভাসিয়া যাইবে।
কলিকাতার মেল ক্ষণকাল পূর্বে আসিয়াছে, বাহিরের ঢাকা বারান্দায় আরামকেদারায় বসিয়া রে-সাহেব জাতীয় কংগ্রেসের আন্দোলনের বিবরণ নিবিষ্টচিত্তে পাঠ করিতেছিলেন, এমন সময় নীচে গাড়িবারান্দায় মোটরের শব্দ শোনা গেল এবং মিনিট-দুই পরেই তাঁহার কন্যা আলেখ্য রায় বাহিরে যাইবার পোশাকে সজ্জিত হইয়া দেখা দিলেন। মেয়েটির রঙ ফরসা নয়; কারণ, বাঙালী ‘সাহেবদের’ মেয়েরা ফরসা হয় না, কেবল সাবান ও পাউডারের জোরে চামড়াটা পাঁশুটে দেখায়। তবে দেখিতে ভাল। মুখে-চোখে দিব্য একটি বুদ্ধির শ্রী আছে, স্বাস্থ্য ও যৌবনের লাবণ্য সর্বদেহে টলটল করিতেছে, বয়স বাইশ-তেইশের বেশি নয়; কহিল—বাবা, ইন্দুর বাড়িতে আজ আমাদের টেনিস টুর্নামেন্ট, আমি যাচ্ছি। ফিরতে যদি একটু দেরি হয় ত ভেবো না।
‘সাহেব’ কাগজ হইতে মুখ তুলিয়া চাহিলেন। তাঁহার চোখের দৃষ্টি উত্তেজনায় উজ্জ্বল, মুখে আবেগ ও আশঙ্কার ছায়া পড়িয়াছে, মেয়ের কথা কানেও যায় নাই। বলিয়া উঠিলেন—আলো, এই দেখ মা, কি-সব কাণ্ড! বার বার বলেছি, এ-সব হতে বাধ্য, হয়েছেও তাই।
মেয়ে বাবাকে চিনিত। তাঁহার কাছে সংসারের যাহা কিছু ঘটে, তাহাই ঘটিতে বাধ্য এবং তিনি তাহা পূর্বাহ্ণেই জানিতেন। সুতরাং এটা যে ঠিক কোন্টা, তাহা আন্দাজ করিতে না পারিয়া কহিল—কি হয়েছে বাবা?
বাবা তেমনি উদ্দীপ্ত ভঙ্গীতে বলিয়া উঠিলেন—কি হয়েছে? দু’জন নন্-কো-অপারেটার ছাত্রকে ম্যাজিস্ট্রেট ধরে নিয়ে গিয়ে হাড়-ভাঙ্গা খাটুনির জেল দিয়েছে, আরো পাঁচ-সাত-দশজনকে ধরবার হুকুম দিয়েছে, কি জানি, এদেরই বা কি সাজা হয়! এই বলিয়া একমুহূর্ত চুপ করিয়া থাকিয়া নিজেই বলিলেন—আর যা হবে, তাও জানি। খাটুনির জেল ত বটেই এবং এক বছরের নীচেও যে কেউ যাবে না, তাও বেশ বোঝা যায়। এই বলিয়া তিনি একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ত্যাগ করিলেন।
আলেখ্য এ-সকল বিষয়ে মনও দিত না, এখন সময়ও ছিল না। আসন্ন টুর্নামেন্টের চিন্তাতেই সে ব্যস্ত হইয়াছিল। কিন্তু তাহার সঙ্গীহীন, শোকজীর্ণ অকালবৃদ্ধ পিতার আগ্রহ ও আশঙ্কাকেও অবহেলা করিয়া চলিয়া যাইতে পারিল না। পাশের চেয়ারটার হাতলের উপর ভর দিয়া দাঁড়াইয়া জিজ্ঞাসা করিল—ছেলে দু’টি কি করেছিল বাবা?
পিতা কহিলেন—তা করেছেও কম নয়। চারিদিকে গান্ধীর নন্-কোঅপারেশন মত প্রচার করে বেড়িয়েছে; দেশের লোককে ডেকে বলেছে, কেউ তোমরা মারামারি কাটাকাটি করো না, কোন ব্যক্তি-বিশেষ বা ইংরাজের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ পোষণ করো না, কিন্তু এই অনাচারী, ধর্মহীন, সত্যভ্রষ্ট বিদেশী গভর্নমেন্টের সঙ্গেও আর কোন সম্পর্ক রেখো না, চাকরির লোভে এর দ্বারে যেয়ো না, বিদ্যের জন্যে এর স্কুল-কলেজে ঢুকো না, বিচারের আশায় আদালতের ছায়া পর্যন্ত মাড়িও না।
আলেখ্য কহিল—তার মানে, সমস্ত দেশটাকে এরা আর একবার মগের মুল্লুক বানিয়ে তুলতে চায়।
রে বলিলেন—তা ছাড়া আর কি যে হতে পারে, আমি ত ভেবে পাইনে!
আলেখ্য কহিল—তাহলে এদের জেলে যাওয়াই উচিত। বাস্তবিক, মিছামিছি সমস্ত দেশটাকে যেন তোলপাড় করে তুলেছে।
মেয়ের কথায় পিতা পূর্ণ সম্মতি দিতে পারিলেন না। একটু দ্বিধা করিয়া বলিলেন,—না, ঠিক যে মিছামিছি করছে তাও নয়, গভর্নমেন্টেরও অন্যায় আছে।
আলেখ্য গভর্নমেন্টের স্বপক্ষে বা বিপক্ষে কিছুই প্রায় জানিত না। খবরের কাগজ পড়িতে তাহার একেবারে ভাল লাগিত না, দেশ বা বিদেশের কোথায় কি ঘটিতেছে, না ঘটিতেছে, এ লইয়া নিজেকে নিরর্থক উদ্বিগ্ন করিয়া তোলার সে কোন প্রয়োজন অনুভব করিত না। সুমুখের ঘড়ির দিকে চাহিয়া দেখিল, তখনও তাহার মিনিট-দশেক সময় আছে, বাবাকে একলা ফেলিয়া যাইবার পূর্বে কোন কিছু একটা অছিলায় এই স্বল্পকালটুকুও তাঁহাকে সঞ্জীবিত ও সচেতন করিয়া যাইবার লোভে কহিল—বাবা, মুখে তুমি যাই কেন না বল, ভেতরে ভেতরে কিন্তু তুমি এই সব লোকেদেরই ভালোবাসো। এই যে সেদিন হরতালের দিন ইন্দুদের মোটরের উইন্ডস্ক্রীনটা ইঁট মেরে ভেঙ্গে দিলে, তুমি শুনে বললে, এ-রকম একটা বড় ব্যাপারে ও-সব ছোটখাটো অত্যাচার ঘটেই থাকে। গাড়িতে ইন্দুর বাবা ছিলেন, ধর, যদি ইঁটটা তাঁর গায়েই লাগতো?