দুঃখ দিয়ে মেটাব দুঃখ তোমার
দুঃখ দিয়ে মেটাব দুঃখ তোমার।
স্নান করাব অতল জলে বিপুল বেদনার॥
মোর সংসার দিব যে জ্বালি, শোধন হবে এ মোহের কালি,
মরণব্যথা দিব তোমার চরণে উপহার॥
দুঃখের যজ্ঞ-অনল-জ্বলনে জন্মে যে প্রেম
দুঃখের যজ্ঞ-অনল-জ্বলনে জন্মে যে প্রেম
দীপ্ত সে হেম,
নিত্য সে নিঃসংশয়,
গৌরব তার অক্ষয়॥
দুরাকাঙক্ষার পরপারে বিরহতীর্থে করে বাস
যেথা জ্বলে ক্ষুব্ধ হোমাগ্নিশিখায় চিরনৈরাশ–
তৃষ্ণাদাহনমুক্ত অনুদিন অমলিন রয়।
গৌরব তার অক্ষয়॥
অশ্রু-উৎস-জল-স্নানে তাপস জ্যোতির্ময়
আপনারে আহুতি-দানে হল সে মৃত্যুঞ্জয়।
গৌরব তার অক্ষয়॥
দূরের বন্ধু সুরের দূতীরে পাঠালো
দূরের বন্ধু সুরের দূতীরে পাঠালো তোমার ঘরে।
মিলনবীণা যে হৃদয়ের মাঝে বাজে তব অগোচরে॥
মনের কথাটি গোপনে গোপনে বাতাসে বাতাসে ভেসে আসে মনে,
বনে উপবনে, বকুলশাখার চঞ্চলতায় মর্মরে মর্মরে॥
পুষ্পমালার পরশপুলক পেয়েছ বক্ষতলে,
রাখো তুমি তারে সিক্ত করিয়া সুখের অশ্রুজলে।
ধরো সাহানাতে মিলনের পালা, সাজাও যতনে বরণের ডালা–
মালতীর মালা, অঞ্চলে ঢেকে কনকপ্রদীপ আনো আনো তার পথ-‘পরে॥
দে তোরা আমায় নূতন ক’রে
দে তোরা আমায় নূতন ক’রে দে নূতন আভরণে॥
হেমন্তের অভিসম্পাতে রিক্ত অকিঞ্চন কাননভূমি,
বসন্তে হোক দৈন্যবিমোচন নব লাবণ্যধনে।
শূন্য শাখা লজ্জা ভুলে যাক পল্লব-আবরণে॥
বাজুক প্রেমের মায়ামন্ত্রে
পুলকিত প্রাণের বীণাযন্ত্রে
চিরসুন্দরের অভিবন্দনা।
আনন্দচঞ্চল নৃত্য অঙ্গে অঙ্গে বহে যাক হিল্লোলে হিল্লোলে,
যৌবন পাক সম্মান বাঞ্ছিতসম্মিলনে॥
দে পড়ে দে আমায় তোরা কী কথা আজ লিখেছে সে
দে পড়ে দে আমায় তোরা কী কথা আজ লিখেছে সে।
তার দূরের বাণীর পরশমানিক লাগুক আমার প্রাণে এসে॥
শস্যখেতের গন্ধখানি একলা ঘরে দিক সে আনি,
ক্লান্তগমন পান্থহাওয়া লাগুক আমার মুক্ত কেশে॥
নীল আকাশের সুরটি নিয়ে বাজাক আমার বিজন মনে,
ধূসর পথের উদাস বরন মেলুক আমার বাতায়নে।
সূর্য ডোবার রাঙা বেলায় ছড়াব প্রাণ রঙের খেলায়,
আপন-মনে চোখের কোণে আশ্রু-আভাস উঠবে ভেসে॥
দেখে যা দেখে যা দেখে যা লো তোরা
দেখে যা, দেখে যা দেখে যা লো তোরা সাধের কাননে মোর
আমার সাধের কুসুম উঠেছে ফুটিয়া, মলয় বহিছে সুরভি লুটিয়া রে–
হেথায় জোছনা ফুটে, তটিনী ছুটে, প্রমোদে কানন ভোর॥
আয় আয় সখী, আয় লো হেথা, দুজনে কহিব মনের কথা।
তুলিব কুসুম দুজনে মিলি রে–
সুখে গাঁথিব মালা, গণিব তারা, করিব রজনী ভোর॥
এ কাননে বসি গাহিব গান, সুখের স্বপনে কাটাব প্রাণ,
খেলিব দুজনে মনের খেলা রে–
প্রাণে রহিবে মিশি দিবসনিশি আধো-আধো ঘুমঘোর॥
দৈবে তুমি কখন নেশায় পেয়ে
দৈবে তুমি কখন নেশায় পেয়ে
আপন মনে যাও তুমি গান গেয়ে গেয়ে।
যে আকাশে সুরের লেখা লেখো
তার পানে রই চেয়ে চেয়ে॥
হৃদয় আমার অদৃশ্যে যায় চলে, চেনা দিনের ঠিক-ঠিকানা ভোলে,
মৌমাছিরা আপনা হারায় যেন গন্ধের পথ বেয়ে বেয়ে॥
গানের টানা-জালে
নিমেষ-ঘেরা গহন থেকে তোলে অসীমকালে।
মাটির আড়াল করি ভেদন সুরলোকের আনে বেদন,
মর্তলোকের বীণার তারে রাগিণী দেয় ছেয়ে॥
দোষী করিব না করিব না তোমারে
দোষী করিব না, করিব না তোমারে
আমি নিজেরে নিজে করি ছলনা।
মনে মনে ভাবি ভালোবাসো,
মনে মনে বুঝি তুমি হাসো,
জান এ আমার খেলা–
এ আমার মোহের রচনা ॥
সন্ধ্যামেঘের রাগে অকারণে ছবি জাগে,
সেইমতো মায়ার আভাসে মনের আকাশে
হাওয়ায় হাওয়ায় ভাসে
শূন্যে শূন্যে ছিন্নলিপি মোর
বিরহমিলনকল্পনা ॥
দ্বারে কেন দিলে নাড়া ওগো মালিনী
দ্বারে কেন দিলে নাড়া ওগো মালিনী!
কার কাছে পাবে সাড়া ওগো মালিনী॥
তুমি তো তুলেছ ফুল, গেঁথেছ মালা, আমার আঁধার ঘরে লেগেছে তালা।
খুঁজে তো পাই নি পথ, দীপ জ্বালি নি॥
ওই দেখো গোধূলির ক্ষীণ আলোতে
দিনের শেষের সোনা ডোবে কালোতে।
আঁধার নিবিড় হলে আসিয়ো পাশে, যখন দূরের আলো জ্বালে আকাশে
অসীম পথের রাতি দীপশালিনী॥
ধরা দিয়েছি গো আমি আকাশের পাখি
ধরা দিয়েছি গো আমি আকাশের পাখি,
নয়নে দেখেছি তব নূতন আকাশ॥
দুখানি আঁখির পাতে কী রেখেছ ঢাকি,
হাসিলে ফুটিয়া পড়ে উষার আভাস॥
হৃদয় উড়িতে চায় হোথায় একাকী–
আঁখিতারকার দেশে করিবারে বাস।
ওই গগনেতে চেয়ে উঠিয়াছে ডাকি–
হোথায় হারাতে চায় এ গীত-উচ্ছ্বাস॥
ধরা সে যে দেয় নাই
ধরা সে যে দেয় নাই, দেয় নাই,
যারে আমি আপনারে সঁপিতে চাই।
কোথা সে যে আছে সঙ্গোপনে
প্রতিদিন শত তুচ্ছের আড়ালে আড়ালে॥
এসো মম সার্থক স্বপ্ন,
করো মোর যৌবন সুন্দর,
দক্ষিণবায়ু আনো পুষ্পবনে।
ঘুচাও বিষাদের কুহেলিকা,
নব প্রাণমন্ত্রের আনো বাণী।
পিপাসিত জীবনের ক্ষুব্ধ আশা
আঁধারে আঁধারে খোঁজে ভাষা
শূন্যে পথহারা পবনের ছন্দে,
ঝরে-পড়া বকুলের গন্ধে॥
ধূসর জীবনের গোধূলিতে
ধূসর জীবনের গোধূলিতে ক্লান্ত মলিন যেই স্মৃতি
মুছে-আসা সেই ছবিটিতে রঙ এঁকে দেয় মোর গীতি॥
বসন্তের ফুলের পরাগে যেই রঙ জাগে,
ঘুম-ভাঙা পিককাকলিতে যেই রঙ লাগে,
যেই রঙ পিয়ালছায়ায় ঢালে শুক্লসপ্তমীর তিথি॥
সেই ছবি দোলা খায় রক্তের হিল্লোলে,
সেই ছবি মিশে যায় নির্ঝরকল্লোলে,
দক্ষিণসমীরণে ভাসে, পূর্ণিমাজ্যোৎস্নায় হাসে–
সে আমারি স্বপ্নের অতিথি॥