তুমি আমায় ডেকেছিলে ছুটির নিমন্ত্রণে
তুমি আমায় ডেকেছিলে ছুটির নিমন্ত্রণে,
তখন ছিলেম বহু দূরে কিসের অন্বেষণে॥
কূলে যখন এলেম ফিরে তখন অস্তশিখরশিরে
চাইল রবি শেষ চাওয়া তার কনকচাঁপার বনে।
আমার ছুটি ফুরিয়ে গেছে কখন অন্যমনে॥
লিখন তোমার বিনিসুতোর শিউলিফুলের মালা,
বাণী সে তার সোনায়-ছোঁওয়া অরুণ-আলোয়-ঢালা–
এল আমার ক্লান্ত হাতে ফুল-ঝরানো শীতের রাতে
কুহেলিকায় মন্থর কোন্ মৌন সমীরণে।
তখন ছুটি ফুরিয়ে গেছে কখন অন্যমনে॥
তুমি মোর পাও নাই পরিচয়
তুমি মোর পাও নাই পরিচয়।
তুমি যারে জান সে যে কেহ নয়, কেহ নয়॥
মালা দাও তারি গলে, শুকায় তা পলে পলে,
আলো তার ভয়ে ভয়ে রয়–
বায়ুপরশন নাহি সয়॥
এসো এসো দুঃখ, জ্বালো শিখা,
দাও ভালে অগ্নিময়ী টিকা।
মরণ আসুক চুপে পরমপ্রকাশরূপে,
সব আবরণ হোক লয়–
ঘুচুক সকল পরাজয়॥
তুমি রবে নীরবে হৃদয়ে মম
তুমি রবে নীরবে হৃদয়ে মম
নিবিড় নিভৃত পূর্ণিমানিশীথিনী-সম॥
মম জীবন যৌবন মম অখিল ভুবন
তুমি ভরিবে গৌরবে নিশীথিনী-সম॥
জাগিবে একাকী তব করুণ আঁখি,
তব অঞ্চলছায়া মোরে রহিবে ঢাকি।
মম দুঃখবেদন মম সফল স্বপন
তুমি ভরিবে সৌরভে নিশীথিনী-সম॥
তুমি সন্ধ্যার মেঘমালা
তুমি সন্ধ্যার মেঘমালা, তুমি আমার সাধের সাধনা,
মম শূন্যগগনবিহারী।
আমি আপন মনের মাধুরী মিশায়ে তোমারে করেছি রচনা–
তুমি আমারি, তুমি আমারি,
মম অসীমগগনবিহারী॥
মম হৃদয়রক্তরাগে তব চরণ দিয়েছি রাঙিয়া,
অয়ি সন্ধ্যাস্বপনবিহারী।
তব অধর এঁকেছি সুধাবিষে মিশে মম সুখদুখ ভাঙিয়া–
তুমি আমারি, তুমি আমারি,
মম বিজনজীবনবিহারী॥
মম মোহের স্বপন-অঞ্জন তব নয়নে দিয়েছি পরায়ে,
অয়ি মুগ্ধনয়নবিহারী
মম সঙ্গীত তব অঙ্গে অঙ্গে দিয়েছি জড়ায়ে জড়ায়ে–
তুমি আমারি, তুমি আমারি,
মম জীবনমরণবিহারী॥
তোমার বৈশাখে ছিল প্রখর রৌদ্রের জ্বালা
তোমার বৈশাখে ছিল প্রখর রৌদ্রের জ্বালা,
কখন বাদল আনে আষাঢ়ের পালা, হায় হায় হায়।
কঠিন পাষাণে কেমনে গোপনে ছিল,
সহসা ঝরনা নামিল অশ্রুঢালা, হায় হায় হায়।
মৃগয়া করিতে বাহির হল যে বনে
মৃগী হয়ে শেষে এল কি অবলা বালা, হায় হায় হায়।
যে ছিল আপন শক্তির অভিমানে
কার পায়ে আনে হার মানিবার ডালা, হায় হায় হায়॥
তোমার মনের একটি কথা আমায় বলো বলো
তোমার মনের একটি কথা আমায় বলো বলো
তোমার নয়ন কেন এমন ছলোছলো ॥
বনের’ পরে বৃষ্টি ঝরে ঝরো ঝরো রবে।
সন্ধ্যা মুখরিত ঝিল্লিস্বরে নীপকুঞ্জতলে।
শালের বীথিকায় বারি বহে যায় কলোকলো ॥
আজি দিগন্তসীমা
বৃষ্টি-আড়ালে হারানো নীলিমা হারালো–
ছায়া পড়ে তোমার মুখের ‘পরে
ছায়া ঘনায় তব মনে মনে ক্ষণে ক্ষণে,
অশ্রুমন্থর বাতাসে বাতাসে তোমার হৃদয় টলোটলো ॥
তোমার রঙিন পাতায় লিখব প্রাণের কোন্ বারতা
তোমার রঙিন পাতায় লিখব প্রাণের কোন্ বারতা।
রঙের তুলি পাব কোথা॥
সে রঙ তো নেই চোখের জলে, আছে কেবল হৃদয় তলে,
প্রকাশ করি কিসের ছলে মনের কথা।
কইতে গেলে রইবে কি তার সরলতা॥
বন্ধু, তুমি বুঝবে কি মোর সহজ বলা– নাই যে আমার ছলা-কলা।
সুর যা ছিল বাহির ত্যেজে অন্তরেতে উঠল বেজে,
একলা কেবল জানে সে যে মোর দেবতা।
কেমন করে করব বাহির মনের কথা॥
তোমার গীতি জাগালো স্মৃতি
তোমার গীতি জাগালো স্মৃতি নয়ন ছলছলিয়া,
বাদলশেষে করুণ হেসে যেন চামেলি-কলিয়া ॥
সজল ঘন মেঘের ছায়ে মৃদু সুবাস দিল বিছায়ে,
না-দেখা কোন্ পরশঘায়ে পড়িছে টলটলিয়া ॥
তোমার বাণী-স্মরণখানি আজি বাদলপবনে
নিশীথে বারিপতন-সম ধ্বনিছে মম শ্রবণে।
সে বাণী যেন গানেতে লেখা দিতেছে আঁকি সুরের রেখা
যে পথ দিয়ে তোমারি, প্রিয়ে, চরণ গেল চলিয়া ॥
তোমার গোপন কথাটি সখী রেখো না মনে
তোমার গোপন কথাটি, সখী, রেখো না মনে।
শুধু আমায়, বোলো আমায় গোপনে॥
ওগো ধীরমধুরহাসিনী, বোলো ধীরমধুর ভাষে–
আমি কানে না শুনিব গো, শুনিব প্রাণের শ্রবণে॥
যবে গভীর যামিনী, যবে নীরব মেদিনী,
যবে সুপ্তিমগন বিহগনীড় কুসুমকাননে,
বোলো অশ্রুজড়িত কণ্ঠে, বোলো কম্পিত স্মিত হাসে–
বোলো মধুরবেদনবিধুর হৃদয়ে শরমনমিত নয়নে॥
তোমার পায়ের তলায় যেন গো রঙ লাগে
তোমার পায়ের তলায় যেন গো রঙ লাগে,
আমার মনের বনের ফুলের রাঙা রাগে।
যেন আমার গানের তানে
তোমায় ভূষণ পরাই কানে,
যেন রক্তমণির হার গেঁথে দিই প্রাণের অনুরাগে॥
তোমার বীণায় গান ছিল
তোমার বীণায় গান ছিল আর আমার ডালায় ফুল ছিল গো।
একই দখিন হাওয়ায় সে দিন দোঁহায় মোদের দুল দিল গো ॥
সে দিন সে তো জানে না কেউ আকাশ ভরে কিসের সে ঢেউ,
তোমার সুরের তরী আমার রঙিন ফুলে কূল নিল গো ॥
সে দিন আমার মনে হল, তোমার গানের তাল ধ’রে
আমার প্রাণে ফুল-ফোটানো রইবে চিরকাল ধ’রে।
গান তবু তো গেল ভেসে, ফুল ফুরালো দিনের শেষে,
ফাগুনবেলার মধুর খেলায় কোন্খানে হায় ভুল ছিল গো ॥
তোমার শেষের গানের রেশ নিয়ে কানে চলে এসেছি
তোমার শেষের গানের রেশ নিয়ে কানে চলে এসেছি।
কেউ কি তা জানে॥
তোমার আছে গানে গানে গাওয়া,
আমার কেবল চোখে চোখে চাওয়া–
মনে মনে মনের কথাখানি বলে এসেছি কেউ কি তা জানে॥
ওদের নেশা তখন ধরে নাই,
রঙিন রসে প্যালা ভরে নাই।
তখনো তো কতই আনাগোনা,
নতুন লোকের নতুন চেনাশোনা–
ফিরে ফিরে ফিরে-আসার আশা দ’লে এসেছি কেউ কি তা জানে॥