আমার সকল কাঁটা ধন্য করে ফুটবে ফুল ফুটবে
আমার সকল কাঁটা ধন্য করে ফুটবে ফুল ফুটবে।
আমার সকল ব্যথা রঙিন হয়ে গোলাপ হয়ে উঠবে ॥
আমার অনেক দিনের আকাশ-চাওয়া আসবে ছুটে দখিন-হাওয়া,
হৃদয় আমার আকুল করে সুগন্ধধন লুটবে ॥
আমার লজ্জা যাবে যখন পাব দেবার মতো ধন,
যখন রূপ ধরিয়ে বিকশিবে প্রাণের আরাধন।
আমার বন্ধু যখন রাত্রিশেষে পরশ তারে করবে এসে,
ফুরিয়ে গিয়ে দলগুলি সব চরণে তার লুটবে ॥
আমার হৃদয়সমুদ্রতীরে কে তুমি দাঁড়ায়ে
আমার হৃদয়সমুদ্রতীরে কে তুমি দাঁড়ায়ে!
কাতর পরান ধায় বাহু বাড়ায়ে ॥
হৃদয়ে উথলে তরঙ্গ চরণপরশের তরে,
তারা চরণকিরণ লয়ে কাড়াকাড়ি করে।
মেতেছে হৃদয় আমার, ধৈরজ না মানে–
তোমারে ঘেরিতে চায়, নাচে সঘনে ॥
সখা, ওইখেনেতে থাকো তুমি, যেয়ো না চলে–
আজি হৃদয়সাগরের বাঁধ ভাঙি সবলে।
কোথা হতে আজি প্রেমের পবন ছুটেছে,
আমার হৃদয়ে তরঙ্গ কত নেচে উঠেছে।
তুমি দাঁড়াও, তুমি যেয়ো না–
আমার হৃদয়ে তরঙ্গ আজি নেচে উঠেছে ॥
আমার এ ঘরে আপনার করে
আমার এ ঘরে আপনার করে গৃহদীপখানি জ্বালো হে।
সব দুখশোক সার্থক হোক লভিয়া তোমারি আলো হে ॥
কোণে কোণে যত লুকানো আঁধার মিলাবে ধন্য হয়ে,
তোমারি পুণ্য আলোকে বসিয়া সবারে বাসিব ভালো হে ॥
পরশমণির প্রদীপ তোমার, অচপল তার আলো
সোনা ক’রে লবে পলকে আমার সকল কলঙ্ক কালো।
আমি যত দীপ জ্বালিয়াছি তাহে শুধু জ্বালা, শুধু কালি–
আমার ঘরের দুয়ারে শিয়রে তোমারি কিরণ ঢালো হে ॥
আমার এই পথ-চাওয়াতেই আনন্দ
আমার এই পথ-চাওয়াতেই আনন্দ।
খেলে যায় রৌদ্র ছায়া, বর্ষা আসে বসন্ত॥
কারা এই সমুখ দিয়ে আসে যায় খবর নিয়ে,
খুশি রই আপন-মনে– বাতাস বহে সুমন্দ॥
সারাদিন আঁখি মেলে দুয়ারে রব একা,
শুভখন হঠাৎ এলে তখনি পাব দেখা।
ততখন ক্ষণে ক্ষণে হাসি গাই আপন-মনে,
ততখন রহি রহি ভেসে আসে সুগন্ধ॥
আমার গোধূলিলগন এল বুঝি কাছে গোধূলিলগন রে
আমার গোধূলিলগন এল বুঝি কাছে গোধূলিলগন রে।
বিবাহের রঙে রাঙা হয়ে আসে সোনার গগন রে।
শেষ ক’রে দিল পাখি গান গাওয়া, নদীর উপরে পড়ে এল হাওয়া;
ও পারের তীর, ভাঙা মন্দির আঁধারে মগন রে।
আসিছে মধুর ঝিল্লিনূপুরে গোধূলিলগন রে ॥
আমার দিন কেটে গেছে কখনো খেলায়, কখনো কত কী কাজে।
এখন কী শুনি পুরবীর সুরে কোন্ দূরে বাঁশি বাজে।
বুঝি দেরি নাই, আসে বুঝি আসে, আলোকের আভা লেগেছে আকাশে–
বেলাশেষে মোরে কে সাজাবে, ওরে, নবমিলনের সাজে!
সারা হল কাজ, মিছে কেন আজ ডাক মোরে আর কাজে ॥
আমি জানি যে আমার হয়ে গেছে গণা গোধূলিলগন রে।
ধূসর আলোকে মুদিবে নয়ন অস্তগগন রে।
তখন এ ঘরে কে খুলিবে দ্বার, কে লইবে টানি বাহুটি আমার,
আমায় কে জানে কী মন্ত্রে গানে করিবে মগন রে–
সব গান সেরে আসিবে যখন গোধূলিলগন রে ॥
আমার ঢালা গানের ধারা সেই তো তুমি পিয়েছিলে
আমার ঢালা গানের ধারা সেই তো তুমি পিয়েছিলে,
আমার গাঁথা স্বপন-মালা কখন চেয়ে নিয়েছিলে ॥
মন যবে মোর দূরে দূরে
ফিরেছিল আকাশ ঘুরে
তখন আমার ব্যথার সুরে
আভাস দিয়ে গিয়েছিলে ॥
যবে বিদায় নিয়ে যাব চলে
মিলন-পালা সাঙ্গ হলে
শরৎ-আলোয় বাদল-মেঘে
এই কথাটি রইবে লেগে–
এই শ্যামলে এই নীলিমায়
আমায় দেখা দিয়েছিলে ॥
আমার প্রাণে গভীর গোপন মহা-আপন সে কি
আমার প্রাণে গভীর গোপন মহা-আপন সে কি,
অন্ধকারে হঠাৎ তারে দেখি ॥
যবে দুর্দম ঝড়ে আগল খুলে পড়ে,
কার সে নয়ন-‘পরে নয়ন যায় গো ঠেকি ॥
যখন আসে পরম লগন তখন গগন-মাঝে
তাহার ভেরী বাজে।
বিদ্যুত-উদ্ভাসে বেদনারই দূত আসে,
আমন্ত্রণের বাণী যায় হৃদয়ে লেখি ॥
আমার বাণী আমার প্রাণে লাগে
আমার বাণী আমার প্রাণে লাগে–
যত তোমায় ডাকি, আমার আপন হৃদয় জাগে ॥
শুধু তোমায় চাওয়া সেও আমার পাওয়া,
তাই তো পরান পরানপণে হাত বাড়িয়ে মাগে ॥
হায় অশক্ত, ভয়ে থাকিস পিছে।
লাগলে সেবায় অশক্তি তোর আপনি হবে মিছে।
পথ দেখাবার তরে যাব কাহার ঘরে–
যেমনি আমি চলি, তোমার প্রদীপ চলে আগে ॥
আমার বিচার তুমি করো তব
আমার বিচার তুমি করো তব আপন করে।
দিনের কর্ম আনিনু তোমার বিচারঘরে ॥
যদি পূজা করি মিছা দেবতার, শিরে ধরি যদি মিথ্যা আচার,
যদি পাপমনে করি অবিচার কাহারো ‘পরে,
আমার বিচার তুমি করো তব আপন করে ॥
লোভে যদি কারে দিয়ে থাকি দুখ, ভয়ে হয়ে থাকি ধর্মবিমুখ,
পরের পীড়ায় পেয়ে থাকি সুখ ক্ষণেক-তরে–
তুমি যে জীবন দিয়েছ আমায় কলঙ্ক যদি দিয়ে থাকি তায়,
আপনি বিনাশ করি আপনায় মোহের ভরে,
আমার বিচার তুমি করো তব আপন করে ॥
আমার বেলা যে যায় সাঁঝ-বেলাতে
আমার বেলা যে যায় সাঁঝ-বেলাতে
তোমার সুরে সুরে সুর মেলাতে॥
একতারাটির একটি তারে গানের বেদন বইতে নারে,
তোমার সাথে বারে বারে হার মেনেছি এই খেলাতে
তোমার সুরে সুরে সুর মেলাতে॥
এ তার বাঁধা কাছের সুরে,
ঐ বাঁশি যে বাজে দূরে।
গানের লীলার সেই কিনারে যোগ দিতে কি সবাই পারে
বিশ্বহৃদয়্পারাবারে রাগরাগিণীর জাল ফেলাতে—
তোমার সুরে সুরে সুর মেলাতে?।
আমার মাঝে তোমারি মায়া জাগালে তুমি কবি
আমার মাঝে তোমারি মায়া জাগালে তুমি কবি।
আপন-মনে আমারি পটে আঁকো মানস ছবি ॥
তাপস তুমি ধেয়ানে তব কী দেখ মোরে কেমনে কব,
আপন-মনে মেঘস্বপন আপনি রচ রবি।
তোমার জটে আমি তোমারি ভাবের জাহ্নবী ॥
তোমারি সোনা বোঝাই হল, আমি তো তার ভেলা–
নিজেরে তুমি ভোলাবে ব’লে আমারে নিয়ে খেলা।
কণ্ঠে মম কী কথা শোন অর্থ আমি বুঝি না কোনো,
বীণাতে মোর কাঁদিয়া ওঠে তোমারি ভৈরবী।
মুকুল মম সুবাসে তব গোপনে সৌরভী ॥