সুরের গুরু, দাও গো সুরের দীক্ষা
সুরের গুরু, দাও গো সুরের দীক্ষা—
মোরা সুরের কাঙাল, এই আমাদের ভিক্ষা॥
মন্দাকিনীর ধারা, ঊষার শুকতারা,
কনকচাঁপা কানে কানে যে সুর পেল শিক্ষা॥
তোমার সুরে ভরিয়ে নিয়ে চিত্ত
যাব যেথায় বেসুর বাজে নিত্য।
কোলাহলের বেগে ঘূর্ণি উঠে জেগে,
নিয়ো তুমি আমার বীণার সেইখানেই পরীক্ষা।
সে দিনে আপদ আমার যাবে কেটে
সে দিনে আপদ আমার যাবে কেটে
পুলকে হৃদয় যেদিন পড়বে ফেটে ॥
তখন তোমার গন্ধ তোমার মধু আপনি বাহির হবে বঁধু হে,
তারে আমার ব’লে ছলে বলে কে বলো আর রাখবে এঁটে ॥
আমারে নিখিল ভুবন দেখছে চেয়ে রাত্রিদিবা।
আমি কি জানি নে তার অর্থ কিবা!
তারা যে জানে আমার চিত্তকোষে অমৃতরূপ আছে বসে গো–
তারেই প্রকাশ করি, আপনি মরি, তবে আমার দুঃখ মেটে ॥
সে যে মনের মানুষ, কেন তারে বসিয়ে রাখিস নয়নদ্বারে
সে যে মনের মানুষ, কেন তারে বসিয়ে রাখিস নয়নদ্বারে ?
ডাক্-না রে তোর বুকের ভিতর, নয়ন ভাসুক নয়নধারে॥
যখন নিভবে আলো, আসবে রাতি, হৃদয়ে দিস আসন পাতি–
আসবে সে যে সঙ্গোপনে বিচ্ছেদেরই অন্ধকারে॥
তার আসা-যাওয়ার গোপন পথে
সে আসবে যাবে আপন মতে।
তারে বাঁধবে ব’লে যেই করো পণ সে থাকে না, থাকে বাঁধন–
সেই বাঁধনে মনে মনে বাঁধিস কেবল আপনারে॥
সেই তো আমি চাই
সেই তো আমি চাই–
সাধনা যে শেষ হবে মোর সে ভাবনা তো নাই ॥
ফলের তরে নয় তো খোঁজা, কে বইবে সে বিষম বোঝা–
যেই ফলে ফল ধুলায় ফেলে আবার ফুল ফুটাই ॥
এমনি ক’রে মোর জীবনে অসীম ব্যাকুলতা,
নিত্য নূতন সাধনাতে নিত্যনূতন ব্যথা!
পেলেই সে তো ফুরিয়ে ফেলি, আবার আমি দু হাত মেলি–
নিত্য দেওয়া ফুরায় না যে, নিত্য নেওয়া তাই ॥
স্বপন যদি ভাঙিলে রজনীপ্রভাতে
স্বপন যদি ভাঙিলে রজনীপ্রভাতে
পূর্ণ করো হিয়া মঙ্গলকিরণে ॥
রাখো মোরে তব কাজে,
নবীন করো এ জীবন হে ॥
খুলি মোর গৃহদ্বার ডাকো তোমারি ভবনে হে ॥
মী, তুমি এসো আজ অন্ধকার হৃদয়মাঝে
স্বামী, তুমি এসো আজ অন্ধকার হৃদয়মাঝে–
পাপে ম্লান পাই লাজ, ডাকি হে তোমারে ॥
ক্রন্দন উঠিছে প্রাণে, মন শান্তি নাহি মানে,
পথ তবু নাহি জানে আপন আঁধারে ॥
ধিক ধিক জনম মম, বিফল বিষয়শ্রম–
বিফল ক্ষণিক প্রেম টুটিয়া যায় বারবার।
সন্তাপে হৃদয় দহে, নয়নে অশ্রুবারি বহে,
বাড়িছে বিষয়পিপাসা বিষম বিষবিকারে ॥
হবে জয়, হবে জয়,হবে জয় রে
হবে জয়, হবে জয়,হবে জয় রে
ওহে বীর, হে নির্ভয়।
জয়ী প্রাণ, চিরপ্রাণ, জয়ী রে আনন্দগান,
জয়ী প্রেম, জয়ী ক্ষেম, জয়ী জ্যোতির্ময় রে॥
এ আঁধার হবে ক্ষয়, হবে ক্ষয় রে,
ওহে বীর, হে নির্ভয়।
ছাড়ো ঘুম, মেলো চোখ, অবসাদ দূর হোক,
আশার অরুণালোক হোক অভ্যুদয় রে॥
হরষে জাগো আজি, জাগো রে তাঁহার সাথে
হরষে জাগো আজি, জাগো রে তাঁহার সাথে,
প্রীতিযোগে তাঁর সাথে একাকী ॥
গগনে গগনে হেরো দিব্য নয়নে
কোন্ মহাপুরুষ জাগে মহাযোগাসনে–
নিখিল কালে জড়ে জীবে জগতে
দেহে প্রাণে হৃদয়ে ॥
হাওয়া লাগে গানের পালে
হাওয়া লাগে গানের পালে–
মাঝি আমার, বোসো হালে॥
এবার ছাড়া পেলে বাঁচে,
জীবনতরী ঢেউয়ে নাচে
এই বাতাসের তালে তালে॥
দিন গিয়েছে, এল রাতি,
নাই কেহ মোর ঘাটের সাথি।
কাটো বাঁধন, দাও গো ছাড়ি–
তারার আলোয় দেব পাড়ি,
সুর জেগেছে যাবার কালে॥
হার মানালে গো, ভাঙিলে অভিমান হায় হায়
হার মানালে গো, ভাঙিলে অভিমান হায় হায়।
ক্ষীণ হাতে জ্বালা ম্লান দীপের থালা
হল খান্ খান্ হায় হায়॥
এবার তবে জ্বালো আপন তারার আলো,
রঙিন ছায়ার এই গোধূলি হোক অবসান হায় হায়॥
এসো পারের সাথি–
বইল পথের হাওয়া, নিবল ঘরের বাতি।
আজি বিজন বাটে, অন্ধকারের ঘাটে
সব-হারানো নাটে এনেছি এই গান হায় হায়॥
হার-মানা হার পরাব তোমার গলে
হার-মানা হার পরাব তোমার গলে।
দূরে রব কত আপন বলের ছলে।
জানি আমি জানি ভেসে যাবে অভিমান,
নিবিড় ব্যথায় ফাটিয়া পড়িবে প্রাণ,
শূন্য হিয়ার বাঁশিতে বাজিবে গান,
পাষান তখন গলিবে নয়নজলে।
শতদল-দল খুলে যাবে থরে থরে
লুকানো রবে না মধু চিরদিনতরে।
আকাশ জুড়িয়া চাহিবে কাহার আঁখি,
ঘরের বাহিরে নীরবে লইবে ডাকি,
কিছুই সেদিন কিছুই রবে না বাকি
পরম মরণ লভিব চরণতলে।
হায় কে দিবে আর সান্ত্বনা
হায় কে দিবে আর সান্ত্বনা।
সকলে গিয়েছে হে, তুমি যেয়ো না–
চাহো প্রসন্ন নয়নে, প্রভু, দীন অধীন জনে ॥
চারি দিকে চাই, হেরি না কাহারে।
কেন গেলে ফেলে একেলা আঁধারে–
হেরো হে শূন্য ভুবন মম ॥
হিংসায় উন্মত্ত পৃথ্বী, নিত্য নিঠুর দ্বন্দ্ব
হিংসায় উন্মত্ত পৃথ্বী, নিত্য নিঠুর দ্বন্দ্ব;
ঘোর কুটিল পন্থ তার, লোভজটিল বন্ধ ॥
নূতন তব জন্ম লাগি কাতর যত প্রাণী–
কর’ ত্রাণ মহাপ্রাণ, আন’ অমৃতবাণী,
বিকশিত কর’ প্রেমপদ্ম চিরমধুনিষ্যন্দ।
শান্ত হে, মুক্ত হে, হে অনন্তপুণ্য,
করুণাঘন, ধরণীতল কর’ কলঙ্কশূন্য।
এস’ দানবীর, দাও ত্যাগকঠিন দীক্ষা।
মহাভিক্ষু, লও সবার অহঙ্কারভিক্ষা।
লোক লোক ভুলুক শোক, খণ্ডন কর’ মোহ,
উজ্জ্বল হোক জ্ঞানসূর্য-উদয়সমারোহ–
প্রাণ লভুক সকল ভুবন, নয়ন লভুক অন্ধ।
শান্ত হে, মুক্ত হে, হে অনন্তপুণ্য,
করুণাঘন, ধরণীতল কর’ কলঙ্কশূন্য।
ক্রন্দনময় নিখিলহৃদয় তাপদহনদীপ্ত
বিষয়বিষবিকারজীর্ণ খিন্ন অপরিতৃপ্ত।
দেশ দেশ পরিল তিলক রক্তকলুষগ্লানি,
তব মঙ্গলশঙ্খ আন’ তব দক্ষিণপাণি–
তব শুভসঙ্গীতরাগ, তব সুন্দর ছন্দ।
শান্ত হে, মুক্ত হে, হে অনন্তপুণ্য,
করুণাঘন, ধরণীতল কর’ কলঙ্কশূন্য ॥