জানি নাই গো সাধন তোমার বলে কারে
জানি নাই গো সাধন তোমার বলে কারে।
আমি ধুলায় বসে খেলেছি এই
তোমার দ্বারে ॥
অবোধ আমি ছিলেম বলে যেমন খুশি এলেম চলে,
ভয় করি নি তোমায় আমি অন্ধকারে ॥
তোমার জ্ঞানী আমায় বলে কঠিন তিরস্কারে,
“পথ দিয়ে তুই আসিস নি যে, ফিরে যা রে।’
ফেরার পন্থা বন্ধ করে আপনি বাঁধো বাহুর ডোরে,
ওরা আমায় মিথ্যা ডাকে বারে বারে ॥
জানি হে যবে প্রভাত হবে তোমার কৃপা-তরণী
জানি হে যবে প্রভাত হবে তোমার কৃপা-তরণী
লইবে মোরে ভবসাগর-কিনারে হে প্রভু।
করি না ভয়, তোমারি জয় গাহিয়া যাব চলিয়া,
দাঁড়াব আসি তব অমৃতদুয়ারে হে প্রভু ॥
জানি হে তুমি যুগে যুগে তোমার বাহু ঘেরিয়া
রেখেছ মোরে তব অসীম ভুবনে হে–
জনম মোরে দিয়েছ তুমি আলোক হতে আলোকে,
জীবন হতে নিয়েছ নব জীবনে হে প্রভু ॥
জানি হে নাথ, পুণ্যপাপে হৃদয় মোর সতত
শয়ান আছে তব নয়নমুখে হে প্রভু।
আমার হাতে তোমার হাত রয়েছে দিনরজনী,
সকল পথে-বিপথে সুখে-অসুখে হে প্রভু।
জানি হে জানি জীবন মম বিফল কভু হবে না,
দিবে না ফেলি বিনাশভয়পাথারে হে–
এমন দিনে আসিবে যবে করুণাভরে আপনি
ফুলের মতো তুলিয়া লবে তাহারে হে প্রভু ॥
জীবন যখন ছিল ফুলের মতো
জীবন যখন ছিল ফুলের মতো
পাপড়ি তাহার ছিল শত শত ॥
বসন্তে সে হ’ত যখন দাতা
ঝরিয়ে দিত দু-চারটি তার পাতা,
তবুও যে তার বাকি রইত কত ॥
আজ বুঝি তার ফল ধরেছে, তাই
হাতে তাহার অধিক কিছু নাই।
হেমন্তে তার সময় হল এবে
পূর্ণ করে আপনাকে সে দেবে,
রসের ভারে তাই সে অবনত ॥
জীবন যখন শুকায়ে যায় করুণাধারায় এসো
জীবন যখন শুকায়ে যায় করুণাধারায় এসো।
সকল মাধুরী লুকায়ে যায়, গীতসুধারসে এসো॥
কর্ম যখন প্রবল-আকার গরজি উঠিয়া ঢাকে চারি ধার
হৃদয়প্রান্তে, হে জীবননাথ, শান্ত চরণে এসো॥
আপনারে যবে করিয়া কৃপণ কোণে পড়ে থাকে দীনহীন মন
দুয়ার খুলিয়া, হে উদার নাথ, রাজসমারোহে এসো।
বাসনা যখন বিপুল ধুলায় অন্ধ করিয়া অবোধে ভুলায়,
ওহে পবিত্র, ওহে অনিদ্র, রুদ্র আলোকে এসো॥
জীবনমরণের সীমানা ছাড়ায়ে
জীবনমরণের সীমানা ছাড়ায়ে,
বন্ধু হে আমার, রয়েছ দাঁড়ায়ে॥
এ মোর হৃদয়ের বিজন আকাশে
তোমার মহাসন আলোতে ঢাকা সে,
গভীর কী আশায় নিবিড় পুলকে
তাহার পানে চাই দু বাহু বাড়ায়ে॥
নীরব নিশি তব চরণ নিছায়ে
আঁধার-কেশভার দিয়েছে বিছায়ে।
আজি এ কোন্ গান নিখিল প্লাবিয়া
তোমার বীণা হতে আসিল নাবিয়া!
ভুবন মিলে যায় সুরের রণনে,
গানের বেদনায় যাই যে হারায়ে॥
জীবনে আমার যত আনন্দ পেয়েছি দিবস-রাত
জীবনে আমার যত আনন্দ পেয়েছি দিবস-রাত
সবার মাঝারে আজিকে তোমারে স্মরিব জীবননাথ ॥
যে দিন তোমার জগত নিরখি হরষে পরান উঠেছে পুলকি
সে দিন আমার নয়নে হয়েছে তোমার নয়নপাত ॥
বারে বারে তুমি আপনার হাতে স্বাদে সৌরভে গানে
বাহির হইতে পরশ করেছ অন্তরমাঝখানে।
পিতা মাতা ভ্রাতা সব পরিবার, মিত্র আমার, পুত্র আমার,
সকলের সাথে প্রবেশি হৃদয়ে
তুমি আছ মোর সাথ ॥
জীবনে যত পূজা হল না সারা
জীবনে যত পূজা হল না সারা,
জানি হে জানি তাও হয় নি হারা।
যে ফুল না ফুটিতে ঝরেছে ধরণীতে
যে নদী মরুপথে হারালো ধারা
জানি হে জানি তাও হয় নি হারা॥
জীবনে আজো যাহা রয়েছে পিছে,
জানি হে জানি তাও হয় নি মিছে।
আমার অনাগত আমার অনাহত
তোমার বীণা-তারে বাজিছে তারা–
জানি হে জানি তাও হয় নি হারা॥
জড়ায়ে আছে বাধা, ছাড়ায়ে যেতে চাই
জড়ায়ে আছে বাধা, ছাড়ায়ে যেতে চাই,
ছাড়াতে গেলে ব্যথা বাজে।
মুক্তি চাহিবারে তোমার কাছে যাই
চাহিতে গেলে মরি লাজে।
জানি হে তুমি মম জীবনে শ্রেয়তম,
এমন ধন আর নাহি যে তোমা-সম,
তবু যা ভাঙাচোরা ঘরেতে আছে পোরা
ফেলিয়া দিতে পারি না যে॥
তোমারে আবরিয়া ধুলাতে ঢাকে হিয়া
মরণ আনে রাশি রাশি,
আমি যে প্রাণ ভরি তাদের ঘৃণা করি
তবুও তাই ভালোবাসি।
এতই আছে বাকি, জমেছে এত ফাঁকি,
কত যে বিফলতা, কত যে ঢাকাঢাকি,
আমার ভালো তাই চাহিতে যবে যাই
ভয় যে আসে মনোমাঝে॥
জয় জয় পরমা নিষ্কৃতি হে, নমি নমি
জয় জয় পরমা নিষ্কৃতি হে, নমি নমি।
জয় জয় পরমা নির্বৃতি হে, নমি নমি॥
নমি নমি তোমারে হে অকস্মাৎ,
গ্রন্থিচ্ছেদন খরসংঘাত–
লুপ্তি, সুপ্তি, বিস্মৃতি হে, নমি নমি॥
অশ্রুশ্রাবণপ্লাবন হে, নমি নমি।
পাপক্ষালন পাবন হে, নমি নমি॥
সব ভয় ভ্রম ভাবনার
চরমা আবৃতি হে, নমি নমি॥
জয় তব বিচিত্র আনন্দ, হে কবি
জয় তব বিচিত্র আনন্দ, হে কবি,
জয় তোমার করুণা।
জয় তব ভীষণ সব-কলুষ-নাশন রুদ্রতা।
জয় অমৃত তব, জয় মৃত্যু তব,
জয় শোক তব, জয় সান্ত্বনা ॥
জয় পূর্ণজাগ্রত জ্যোতি তব,
জয় তিমিরনিবিড় নিশীথিনী ভয়দায়িনী।
জয় প্রেমমধুময় মিলন তব জয় অসহ বিচ্ছেদবেদনা ॥
জয় ভৈরব, জয় শঙ্কর
জয় ভৈরব, জয় শঙ্কর !
জয় জয় জয় প্রলয়ঙ্কর, শঙ্কর শঙ্কর॥
জয় সংশয়ভেদন, জয় বন্ধনছেদন,
জয় সঙ্কটসংহর শঙ্কর শঙ্কর॥
তিমিরহৃদ্বিদারণ জ্বলদগ্নিনিদারুণ,
মরুশ্মশানসঞ্চর শঙ্কর শঙ্কর !
বজ্রঘোষবাণী, রুদ্র, শূলপাণি,
মৃত্যুসিন্ধুসন্তর শঙ্কর শঙ্কর॥
জয় হোক, জয় হোক নব অরুণোদয়
জয় হোক, জয় হোক নব অরুণোদয়।
পূর্বদিগঞ্চল হোক জ্যোতির্ময়॥
এসো অপরাজিত বাণী, অসত্য হানি–
অপহত শঙ্কা, অপগত সংশয় ॥
এসো নবজাগ্রত প্রাণ, চিরযৌবনজয়গান।
এসো মৃত্যুঞ্জয় আশা জড়ত্বনাশা–
ক্রন্দন দূর হোক, বন্ধন হোক ক্ষয় ॥