জগতে তুমি রাজা, অসীম প্রতাপ
জগতে তুমি রাজা, অসীম প্রতাপ–
হৃদয়ে তুমি হৃদয়নাথ হৃদয়হরণরূপে ॥
নীলাম্বর জ্যোতিখচিত চরণপ্রান্তে প্রসারিত,
ফিরে সভয়ে নিয়মপথে অনন্তলোক ॥
নিভৃতে হৃদয়মাঝে কিবা প্রসন্ন মুখচ্ছবি
প্রেমপরিপূর্ণ মধুর ভাতি।
ভকতহৃদয়ে তব করুণারস সতত বহে,
দীনজনে সতত করো অভয় দান ॥
জগৎ জুড়ে উদার সুরে আনন্দগান বাজে
জগৎ জুড়ে উদার সুরে
আনন্দগান বাজে,
সে গান কবে গভীর রবে
বাজিবে হিয়া-মাঝে।
বাতাস জল আকাশ আলো
সবারে কবে বাসিব ভালো,
হৃদয়সভা জুড়িয়া তারা
বসিবে নানা সাজে।
নয়নদুটি মেলিলে কবে
পরান হবে খুশি,
যে পথ দিয়া চলিয়া যাব
সবারে যাব তুষি।
রয়েছ তুমি, এ কথা কবে
জীবন-মাঝে সহজ হবে,
আপনি কবে তোমারি নাম
ধ্বনিবে সব কাজে।
জননী, তোমার করুণ চরণখানি
জননী, তোমার করুণ চরণখানি
হেরিনু আজি এ অরুণকিরণ রূপে॥
জননী, তোমার মরণহরণ বাণী
নীরব গগনে ভরি উঠে চুপে চুপে।
তোমারে নমি হে সকল ভুবন-মাঝে,
তোমারে নমি হে সকল জীবন-কাজে;
তনু মন ধন করি নিবেদন আজি
ভক্তিপাবন তোমার পূজার ধূপে।
জননী, তোমার করুণ চরণখানি
হেরিনু আজি এ অরুণকিরণ রূপে॥
জরজর প্রাণে, নাথ, বরিষন করো তব প্রেমসুধা
জরজর প্রাণে, নাথ, বরিষন করো তব প্রেমসুধা–
নিবারো এ হৃদয়দহন॥
করো হে মোচন করো সব পাপমোহ,
দূর করো বিষয়বাসনা॥
জাগ জাগ রে জাগ সঙ্গীত
জাগ’ জাগ’ রে জাগ’ সঙ্গীত–চিত্ত অম্বর কর তরঙ্গিত,
নিবিড়নন্দিত প্রেমকম্পিত হৃদয়কুঞ্জবিতানে ॥
মুক্তবন্ধন সপ্তসুর তব করুক বিশ্ববিহার,
সূর্যশশিনক্ষত্রলোকে করুক হর্ষ প্রচার।
তানে তানে প্রাণে প্রাণে গাঁথ’ নন্দনহার।
পূর্ণ কর’ রে গগন-অঙ্গন তাঁর বন্দনগানে ॥
জাগিতে হবে রে
জাগিতে হবে রে–
মোহনিদ্রা কভু না রবে চিরদিন,
ত্যজিতে হইবে সুখশয়ন অশনিঘোষণে ॥
জাগে তাঁর ন্যায়দণ্ড সর্বভুবনে,
ফিরে তাঁর কালচক্র অসীম গগনে,
জ্বলে তাঁর রুদ্রনেত্র পাপতিমিরে ॥
জাগে নাথ জোছনারাতে
জাগে নাথ জোছনারাতে–
জাগো, রে অন্তর, জাগো॥
তাঁহারি পানে চাহো মুগ্ধপ্রাণে
নিমেষহারা আঁখিপাতে॥
নীরব চন্দ্রমা নীরব তারা, নীরব গীতরসে হল হারা–
জাগে বসুন্ধরা, অম্বর জাগে রে–
জাগে রে সুন্দর সাথে॥
জাগো নির্মল নেত্রে রাত্রির পরপারে
জাগো নির্মল নেত্রে রাত্রির পরপারে,
জাগো অন্তরক্ষেত্রে মুক্তির অধিকারে ॥
জাগো ভক্তির তীর্থে পূজাপুষ্পের ঘ্রাণে,
জাগো উন্মুখচিত্তে, জাগো অম্লানপ্রাণে,
জাগো নন্দননৃত্যে সুধাসিন্ধুর ধারে,
জাগো স্বার্থের প্রান্তে প্রেমমন্দিরদ্বারে ॥
জাগো উজ্জ্বল পুণ্যে, জাগো নিশ্চল আশে,
জাগো নিঃসীম শূন্যে পূর্ণের বাহুপাশে।
জাগো নির্ভয়ধামে, জাগো সংগ্রামসাজে,
জাগো ব্রহ্মের নামে, জাগো কল্যাণকাজে,
জাগো দুর্গমযাত্রী দুঃখের অভিসারে,
জাগো স্বার্থের প্রান্তে প্রেমমন্দিরদ্বারে ॥
জাগো হে রুদ্র, জাগো
জাগো হে রুদ্র, জাগো–
সুপ্তিজড়িত তিমিরজাল সহে না, সহে না গো ॥
এসো নিরুদ্ধ দ্বারে, বিমুক্ত করো তারে,
তনুমনপ্রাণ ধনজনমান, হে মহাভিক্ষু, মাগো ॥
জাগ্রত বিশ্বকোলাহল-মাঝে
জাগ্রত বিশ্বকোলাহল-মাঝে
তুমি গম্ভীর, স্তব্ধ, শান্ত, নির্বিকার,
পরিপূর্ণ মহাজ্ঞান ॥
তোমা-পানে ধায় প্রাণ সব কোলাহল ছাড়ি,
চঞ্চল নদী যেমন ধায় সাগরে ॥
জানি গো, দিন যাবে এ দিন যাবে
জানি গো, দিন যাবে এ দিন যাবে।
একদা কোন্ বেলাশেষে মলিন রবি করুণ হেসে
শেষ বিদায়ের চাওয়া আমার মুখের পানে চাবে॥
পথের ধারে বাজবে বেণু, নদীর কূলে চরবে ধেনু,
আঙিনাতে খেলবে শিশু, পাখিরা গান গাবে–
তবুও দিন যাবে এ দিন যাবে॥
তোমার কাছে আমার এ মিনতি
যাবার আগে জানি যেন আমায় ডেকেছিল কেন
আকাশ-পানে নয়ন তুলে শ্যামল বসুমতী
কেন নিশার নীরবতা শুনিয়েছিল তারার কথা,
পরানে ঢেউ তুলেছিল কেন দিনের জ্যোতি–
তোমার কাছে আমার এই মিনতি॥
সাঙ্গ যবে হবে ধরার পালা
যেন আমার গানের শেষে থামতে পারি সমে এসে,
ছয়টি ঋতুর ফুলে ফলে ভরতে পারি ডালা।
এই জীবনের আলোকেতে পারি তোমায় দেখে যেতে,
পরিয়ে যেতে পারি তোমায় আমার গলার মালা–
সাঙ্গ যবে হবে ধরার পালা॥
জানি জানি তোমার প্রেমে সকল প্রেমের বাণী মেশে
জানি জানি তোমার প্রেমে সকল প্রেমের বাণী মেশে,
আমি সেইখানেতেই মুক্তি খুঁজি দিনের শেষে॥
সেথায় প্রেমের চরম সাধন, যায় খসে তার সকল বাঁধন–
মোর হৃদয়পাখির গগন তোমার হৃদয়দেশে॥
ওগো, জানি আমার শ্রান্ত দিনের সকল ধারা
তোমার গভীর রাতের শান্তিমাঝে ক্লান্তিহারা।
আমার দেহে ধরার পরশ তোমার সুধায় হল সরস–
আমার ধুলারই ধন তোমার মাঝে নূতন বেশে॥
জানি জানি কোন্ আদি কাল হতে
জানি জানি কোন্ আদি কাল হতে
ভাসালে আমারে জীবনের স্রোতে,
সহসা হে প্রিয়, কত গৃহে পথে
রেখে গেছ প্রাণে কত হরষন।
কতবার তুমি মেঘের আড়ালে
এমনি মধুর হাসিয়া দাঁড়ালে,
অরুণ-কিরণে চরণ বাড়ালে,
ললাটে রাখিলে শুভ পরশন॥
সঞ্চিত হয়ে আছে এই চোখে
কত কালে কালে কত লোকে লোকে
কত নব নব আলোকে আলোকে
অরূপের কত রূপদরশন।
কত যুগে যুগে কেহ নাহি জানে
ভরিয়া ভরিয়া উঠেছে পরানে
কত সুখে দুখে কত প্রেমে গানে
অমৃতের কত রসবরষন॥