গাব তোমার সুরে দাও সে বীণাযন্ত্র
গাব তোমার সুরে দাও সে বীণাযন্ত্র,
শুনব তোমার বাণী দাও সে অমর মন্ত্র।
করব তোমার সেবা দাও সে পরম শক্তি,
চাইব তোমার মুখে দাও সে অচল ভক্তি ॥
সইব তোমার আঘাত দাও সে বিপুল ধৈর্য,
বইব তোমার ধ্বজা দাও সে অটল স্থৈর্য ॥
নেব সকল বিশ্ব দাও সে প্রবল প্রাণ,
করব আমায় নিঃস্ব দাও সে প্রেমের দান ॥
যাব তোমার সাথে দাও সে দখিন হস্ত,
লড়ব তোমার রণে দাও সে তোমার অস্ত্র ॥
জাগব তোমার সত্যে দাও সেই আহ্বান।
ছাড়ব সুখের দাস্য, দাও দাও কল্যাণ ॥
গায়ে আমার পুলক লাগে, চোখে ঘনায় ঘোর
গায়ে আমার পুলক লাগে, চোখে ঘনায় ঘোর–
হৃদয় মোর কে বেঁধেছে রাঙা রাখীর ডোর?।
আজিকে এই আকাশতলে জলে স্থলে ফুলে ফলে
কেমন ক’রে মনোহরণ, ছড়ালে মন মোর?।
কেমন খেলা হল আমার আজি তোমার সনে!
পেয়েছি কি খুঁজে বেড়াই ভেবে না পাই মনে।
আনন্দ আজ কিসের ছলে কাঁদিতে চায় নয়নজলে,
বিরহ আজ মধুর হয়ে করেছে প্রাণ ভোর॥
ঘাটে বসে আছি আনমনা
ঘাটে বসে আছি আনমনা যেতেছে বহিয়া সুসময়–
সে বাতাসে তরী ভাসাব না যাহা তোমা-পানে নাহি বয় ॥
দিন যায় ওগো দিন যায়, দিনমণি যায় অস্তে–
নিশার তিমিরে দশ দিক ঘিরে জাগিয়া উঠিছে শত ভয় ॥
ঘরের ঠিকানা হল না গো, মন করে তবু যাই-যাই–
ধ্রুবতারা তুমি যেথা জাগ সে দিকের পথ চিনি নাই।
এত দিন তরী বাহিলাম যে সুদূর পথ বাহিয়া–
শত বার তরী ডুবুডুবু করি সে পথে ভরসা নাহি পাই ॥
তীর-সাথে হেরো শত ডোরে বাঁধা আছে মোর তরীখান–
রশি খুলে দেবে কবে মোরে, ভাসিতে পারিলে বাঁচে প্রাণ।
কবে অকূলের খোলা হাওয়া দিবে সব জ্বালা জুড়ায়ে,
শুনা যাবে কবে ঘনঘোর রবে মহাসাগরের কলগান ॥
ঘোর দুঃখে জাগিনু, ঘনঘোরা যামিনী
ঘোর দুঃখে জাগিনু, ঘনঘোরা যামিনী
একেলা হায় রে– তোমার আশা হারায়ে ॥
ভোর হল নিশা, জাগে দশ দিশা–
আছি দ্বারে দাঁড়ায়ে
উদয়পথপানে দুই বাহু বাড়ায়ে ॥
চরণ ধরিতে দিয়ো গো আমারে
চরণ ধরিতে দিয়ো গো আমারে, নিয়ো না, নিয়ো না সরায়ে–
জীবন মরণ সুখ দুখ দিয়ে বক্ষে ধরিব জড়ায়ে ॥
স্খলিত শিথিল কামনার ভার বহিয়া বহিয়া ফিরি কত আর–
নিজ হাতে তুমি গেঁথে নিয়ো হার, ফেলো না আমারে ছড়ায়ে ॥
চিরপিপাসিত বাসনা বেদনা বাঁচাও তাহারে মারিয়া।
শেষ জয়ে যেন হয় সে বিজয়ী তোমারি কাছেতে হারিয়া।
বিকায়ে বিকায়ে দীন আপনারে পারি না ফিরিতে দুয়ারে দুয়ারে–
তোমারি করিয়া নিয়ো গো আমারে বরণের মালা পরায়ে ॥
চরণধ্বনি শুনি তব, নাথ, জীবনতীরে
চরণধ্বনি শুনি তব, নাথ, জীবনতীরে
কত নীরব নির্জনে কত মধুসমীরে ॥
গগনে গ্রহতারাচয় অনিমেষে চাহি রয়,
ভাবনাস্রোত হৃদয়ে বয় ধীরে একান্তে ধীরে ॥
চাহিয়া রহে আঁখি মম তৃষ্ঞাতুর পাখিসম,
শ্রবণ রয়েছি মেলি চিত্তগভীরে–
কোন্ শুভপ্রাতে দাঁড়াবে হৃদিমাঝে,
ভুলিব সব দুঃখ সুখ ডুবিয়া আনন্দনীরে ॥
চলি গো, চলি গো, যাই গো চলে
চলি গো, চলি গো, যাই গো চলে।
পথের প্রদীপ জ্বলে গো গগনতলে॥
বাজিয়ে চলি পথের বাঁশি, ছড়িয়ে চলি চলার হাসি,
রঙিন বসন উড়িয়ে চলি জলে স্থলে॥
পথিক ভুবন ভালোবাসে পথিকজনে রে।
এমন সুরে তাই সে ডাকে ক্ষণে ক্ষণে রে।
চলার পথের আগে আগে ঋতুর ঋতুর সোহাগ জাগে,
চরণ-ঘায়ে মরণ মরে পলে পলে॥
চিরদিবস নব মাধুরী, নব শোভা তব বিশ্বে
চিরদিবস নব মাধুরী, নব শোভা তব বিশ্বে–
নব কুসুমপল্লব, নব গীত, নব আনন্দ॥
নব জ্যোতি বিভাসিত, নব প্রাণ বিকাশিত
নবপ্রীতিপ্রবাহহিল্লোলে॥
চারিদিকে চিরদিন নবীন লাবণ্য,
তব প্রেমনয়নছটা।
হৃদয়স্বামী, তুমি চিরপ্রবীণ,
তুমি চিরনবীন, চিরমঙ্গল, চিরসুন্দর॥
চিরবন্ধু চিরনির্ভর চিরশান্তি
চিরবন্ধু চিরনির্ভর চিরশান্তি
তুমি হে প্রভু–
তুমি চিরমঙ্গল সখা হে তোমার জগতে,
চিরসঙ্গী চিরজীবনে ॥
চিরপ্রীতিসুধানির্ঝর তুমি হে হৃদয়েশ–
তব জয়সঙ্গীত ধ্বনিছে তোমার জগতে
চিরদিবা চিররজনী ॥
চিরসখা, ছেড়ো না মোরে ছেড়ো না
চিরসখা, ছেড়ো না মোরে ছেড়ো না।
সংসারগহনে নির্ভয়নির্ভর, নির্জনসজনে সঙ্গে রহো ॥
অধনের হও ধন, অনাথের নাথ হও হে, অবলের বল।
জরাভারাতুরে নবীন করো ওহো সুধাসাগর ॥
চোখের আলোয় দেখেছিলেম চোখের বাহিরে
চোখের আলোয় দেখেছিলেম চোখের বাহিরে।
অন্তরে আজ দেখব, যখন আলোক নাহি রে॥
ধরায় যখন দাও না ধরা হৃদয় তখন তোমায় ভরা,
এখন তোমার আপন আলোয় তোমায় চাহি রে॥
তোমায় নিয়ে খেলেছিলেম খেলার ঘরেতে।
খেলার পুতুল ভেঙে গেছে প্রলয় ঝড়েতে।
থাক্ তবে সেই কেবল খেলা, হোক-না এখন প্রাণের মেলা–
তারের বীণা ভাঙল, হৃদয়-বীণায় গাহি রে॥
ছিন্ন পাতার সাজাই তরণী, একা একা করি খেলা
ছিন্ন পাতার সাজাই তরণী, একা একা করি খেলা–
আন্মনা যেন দিক্বালিকার ভাসানো মেঘের ভেলা॥
যেমন হেলায় অলস ছন্দে কোন্ খেয়ালির কোন্ আনন্দে
সকালে-ধরানো আমের মুকুল ঝরানো বিকালবেলা॥
যে বাতাস নেয় ফুলের গন্ধ, ভুলে যায় দিনশেষে,
তার হাতে দিই আমার ছন্দ–কোথা যায় কে জানে সে।
লক্ষ্যবিহীন স্রোতের ধারায় জেনো জেনো মোর সকলই হারায়,
চিরদিন আমি পথের নেশায় পাথেয় করেছি হেলা॥
জগতে আনন্দযজ্ঞে আমার নিমন্ত্রণ
জগতে আনন্দযজ্ঞে আমার নিমন্ত্রণ।
ধন্য হল ধন্য হল মানবজীবন॥
নয়ন আমার রূপের পুরে সাধ মিটায়ে বেড়ায় ঘুরে,
শ্রবণ আমার গভীর সুরে হয়েছে মগন॥
তোমার যজ্ঞে দিয়েছ ভার, বাজাই আমি বাঁশি–
গানে গানে গেঁথে বেড়াই প্রাণের কান্নাহাসি।
এখন সময় হয়েছে কি? সভায় গিয়ে তোমায় দেখি
জয়ধ্বনি শুনিয়ে যাব এ মোর নিবেদন॥