কোন্ শুভখনে উদিবে নয়নে অপরূপ রূপ-ইন্দু
কোন্ শুভখনে উদিবে নয়নে অপরূপ রূপ-ইন্দু
চিত্তকুসুমে ভরিয়া উঠিবে মধুময় রসবিন্দু ॥
নব- নন্দনতানে চিরবন্দনগানে
উৎসববীণা মন্দমধুর ঝঙ্কৃত হবে প্রাণে–
নিখিলের পানে উথলি উঠিবে উতলা চেতনাসিন্ধু।
জাগিয়া রহিবে রাত্রি নিবিড়মিলনদাত্রী,
মুখরিয়া দিক চলিবে পথিক অমৃতসভার যাত্রী–
গগনে ধ্বনিবে “নাথ নাথ বন্ধু বন্ধু বন্ধু’ ॥
কোলাহল তো বারণ হল, এবার কথা কানে কানে
কোলাহল তো বারণ হল, এবার কথা কানে কানে।
এখন হবে প্রাণের আলাপ কেবলমাত্র গানে গানে॥
রাজার পথে লোক ছুটেছে, বেচাকেনার হাঁক উঠেছে,
আমার ছুটি অবেলাতেই দিনদুপুরে মধ্যখানে–
কাজের মাঝে ডাক পড়েছে কেন যে তাই কেই বা জানে॥
মোর কাননে অকালে ফুল উঠুক তবে মুঞ্জরিয়া।
মধ্যদিনে মৌমাছিরা বেড়াক মৃদু গুঞ্জরিয়া।
মন্দ-ভালোর দ্বন্দ্বে খেটে গেছে তো দিন অনেক কেটে,
অলস-বেলায় খেলার সাথি এবার আমার হৃদয় টানে–
বিনা-কাজের ডাক পড়েছে
কেন যে তাই কেই বা জানে॥
ক্লান্তি আমার ক্ষমা করো প্রভু
ক্লান্তি আমার ক্ষমা করো প্রভু,
পথে যদি পিছিয়ে পড়ি কভু॥
এই-যে হিয়া থরোথরো কাঁপে আজি এমনতরো
এই বেদনা ক্ষমা করো, ক্ষমা করো, ক্ষমা করো প্রভু॥
এই দীনতা ক্ষমা করো প্রভু,
পিছন-পানে তাকাই যদি কভু।
দিনের তাপে রৌদ্রজ্বালায় শুকায় মালা পূজার থালায়,
সেই ম্লানতা ক্ষমা করো, ক্ষমা করো, ক্ষমা করো প্রভু॥
ক্ষত যত ক্ষতি যত মিছে হতে মিছে
ক্ষত যত ক্ষতি যত মিছে হতে মিছে,
নিমেষের কুশাঙ্কুর পড়ে রবে নীচে ॥
কী হল না, কী পেলে না, কে তব শোধে নি দেনা
সে সকলই মরীচিকা মিলাইবে পিছে ॥
এই-যে হেরিলে চোখে অপরূপ ছবি
অরুণ গগনতলে প্রভাতের রবি–
এই তো পরম দান সফল করিল প্রাণ,
সত্যের আনন্দরূপ
এই তো জাগিছে ॥
খেলার ছলে সাজিয়ে আমার গানের বাণী
খেলার ছলে সাজিয়ে আমার গানের বাণী
দিনে দিনে ভাসাই দিনের তরীখানি ॥
স্রোতের লীলায় ভেসে ভেসে সুদূরে কোন্ অচিন দেশে
কোনো ঘাটে ঠেকবে কিনা নাহি জানি ॥
নাহয় ডুবে গেলই, নাহয় গেলই বা।
নাহয় তুলে লও গো, নাহয় ফেলোই বা।
হে অজানা, মরি মরি, উদ্দেশে এই খেলা করি,
এই খেলাতেই আপন-মনে ধন্য মানি ॥
গভীর রজনী নামিল হৃদয়ে, আর কোলাহল নাই
গভীর রজনী নামিল হৃদয়ে, আর কোলাহল নাই।
রহি রহি শুধু সুদূর সিন্ধুর ধ্বনি শুনিবারে পাই ॥
সকল বাসনা চিত্তে এল ফিরে, নিবিড় আঁধার ঘনালো বাহিরে–
প্রদীপ একটি নিভৃত অন্তরে জ্বলিতেছে এক ঠাঁই ॥
অসীম মঙ্গলে মিলিল মাধুরী, খেলা হল সমাধান।
চপল চঞ্চল লহরীলীলা পারাবারে অবসান।
নীরব মন্ত্রে হৃদয়মাঝে শান্তি শান্তি শান্তি বাজে,
অরূপকান্তি নিরখি অন্তরে মুদিতলোচনে চাই ॥
গরব মম হরেছ, প্রভু, দিয়েছ বহু লাজ
গরব মম হরেছ, প্রভু, দিয়েছ বহু লাজ।
কেমন মুখ সমুখে তব তুলিব আমি আজ ॥
তোমারে আমি পেয়েছি বলি মনে মনে যে মনেরে ছলি,
ধরা পড়িনু সংসারেতে করিতে তব কাজ।
কেমনে মুখ সমুখে তব তুলিব আমি আজ ॥
জানি নে, নাথ, আমার ঘরে ঠাঁই কোথা যে তোমারি তরে–
নিজেরে তব চরণ’পরে সঁপি নি রাজরাজ!
তোমারে চেয়ে দিবসযামী আমারি পানে তাকাই আমি–
তোমারে চোখে দেখি নে, স্বামী, তব মহিমামাঝ।
কেমনে মুখ সমুখে তব তুলিব আমি আজ ॥
গাও বীণা– বীণা, গাও রে
গাও বীণা– বীণা, গাও রে।
অমৃতমধুর তাঁর প্রেমগান মানব-সবে শুনাও রে।
মধুর তানে নীরস প্রাণে মধুর প্রেম জাগাও রে ॥
ব্যথা দিয়ো না কাহারে, ব্যথিতের তরে পাষাণ প্রাণ কাঁদাও রে ॥
নিরাশেরে কহো আশার কাহিনী, প্রাণে নব বল দাও রে।
আনন্দময়ের আনন্দ-আলয় নব নব তানে ছাও রে।
পড়ে থাকো সদা বিভুর চরণে, আপনারে ভুলে যাও রে ॥
গানে গানে তব বন্ধন যাক টুটে
গানে গানে তব বন্ধন যাক টুটে
রুদ্ধবাণীর অন্ধকারে কাঁদন জেগে উঠে ॥
বিশ্বকবির চিত্তমাঝে ভুবনবীণা যেথায় বাজে
জীবন তোমার সুরের ধারায় পড়ুক সেথায় লুটে ॥
ছন্দ তোমার ভেঙে গিয়ে দ্বন্দ্ব বাধায় প্রাণে,
অন্তরে আর বাহিরে তাই তান মেলে না তানে।
সুরহারা প্রাণ বিষম বাধা– সেই তো আঁধি, সেই তো ধাঁধা–
গান-ভোলা তুই গান ফিরে নে, যাক সে আপদ ছুটে ॥
গানের ঝরনাতলায় তুমি সাঁঝের বেলায় এলে
গানের ঝরনাতলায় তুমি সাঁঝের বেলায় এলে।
দাও আমারে সোনার-বরন সুরের ধারা ঢেলে ॥
যে সুর গোপন গুহা হতে ছুটে আসে আকুল স্রোতে,
কান্নাসাগর-পানে যে যায় বুকের পাথর ঠেলে ॥
যে সুর উষার বাণী বয়ে আকাশে যায় ভেসে,
রাতের কোলে যায় গো চলে সোনার হাসি হেসে।
যে সুর চাঁপার পেয়ালা ভ’রে দেয় আপনায় উজাড় ক’রে,
যায় চলে যায় চৈত্রদিনের মধুর খেলা খেলে ॥
গানের ভিতর দিয়ে যখন দেখি ভুবনখানি
গানের ভিতর দিয়ে যখন দেখি ভুবনখানি
তখন তারে চিনি আমি, তখন তারে জানি।
তখন তারি আলোর ভাষায় আকাশ ভরে ভালোবাসায়,
তখন তারি ধুলায় ধুলায় জাগে পরম বাণী ॥
তখন সে যে বাহির ছেড়ে অন্তরে মোর আসে,
তখন আমার হৃদয় কাঁপে তারি ঘাসে ঘাসে।
রূপের রেখা রসের ধারায় আপন সীমা কোথায় হারায়,
তখন দেখি আমার সাথে সবার কানাকানি ॥
গানের সুরের আসনখানি পাতি পথের ধারে
গানের সুরের আসনখানি পাতি পথের ধারে।
ওগো পথিক, তুমি এসে বসবে বারে বারে ॥
ঐ যে তোমার ভোরের পাখি নিত্য করে ডাকাডাকি,
অরুণ-আলোর খেয়ায় যখন এস ঘাটের পারে,
মোর প্রভাতীর গানখানিতে দাঁড়াও আমার দ্বারে ॥
আজ সকালে মেঘের ছায়া লুটিয়ে পড়ে বনে,
জল ভরেছে ঐ গগনের নীল নয়নের কোণে।
আজকে এলে নতুন বেশে তালের বনে মাঠের শেষে,
অমনি চলে যেয়ো নাকো গোপনসঞ্চারে।
দাঁড়িয়ো আমার মেঘলা গানের বাদল-অন্ধকারে ॥