অমন আড়াল দিয়ে লুকিয়ে গেলে চলবে না
অমন আড়াল দিয়ে লুকিয়ে গেলে চলবে না।
এবার হৃদয়-মাঝে লুকিয়ে বোসো, কেউ জানবে না, কেউ বলবে না।
বিশ্বে তোমার লুকোচুরি, দেশ-বিদেশে কতই ঘুরি,
এবার বলো, আমার মনের কোণে দেবে ধরা, ছলবে না॥
জানি আমার কঠিন হৃদয় চরণ রাখার যোগ্য সে নয়–
সখা, তোমার হাওয়া লাগলে হিয়ায় তবু কি প্রাণ গলবে না?
নাহয় আমার নাই সাধনা– ঝরলে তোমার কৃপার কণা
তখন নিমেষে কি ফুটবে না ফুল, চকিতে ফল ফলবে না॥
অমল কমল সহজে জলের কোলে আনন্দে রহে ফুটিয়া
অমল কমল সহজে জলের কোলে আনন্দে রহে ফুটিয়া,
ফিরে না সে কভু “আলয় কোথায়’ ব’লে ধুলায় ধুলায় লুটিয়া ॥
তেমনি সহজে আনন্দে হরষিত
তোমার মাঝারে রব নিমগ্নচিত,
পূজাশতদল আপনি সে বিকশিত সব সংশয় টুটিয়া ॥
কোথা আছ তুমি পথ না খুঁজিব কভু, শুধাব না কোনো পথিকে–
তোমারি মাঝারে ভ্রমিব ফিরিব প্রভু, যখন ফিরিব যে দিকে।
চলিব যখন তোমার আকাশগেহে
তোমার অমৃতপ্রবাহ লাগিবে দেহে,
তোমার পবন সখার মতন স্নেহে বক্ষে আসিবে ছুটিয়া ॥
অমৃতের সাগরে আমি যাব যাব রে
অমৃতের সাগরে আমি যাব যাব রে,
তৃষ্ণা জ্বলিছে মোর প্রাণে ॥
কোথা পথ বলো হে বলো, ব্যথার ব্যথী হে–
কোথা হতে কলধ্বনি আসিছে কানে ॥
অরূপ বীণা রূপের আড়ালে লুকিয়ে বাজে
অরূপ বীণা রূপের আড়ালে লুকিয়ে বাজে,
সে বীণা আজি উঠিল বাজি’ হৃদয়মাঝে॥
ভুবন আমার ভরিল সুরে,
ভেদ ঘুচে যায় নিকটে দূরে,
সেই রাগিণী লেগেছে আমার সকল কাজে॥
হাতে পাওয়ার চোখে চাওয়ার সকল বাঁধন,
গেল কেটে আজ সফল হল সকল কাঁদন।
সুরের রসে হারিয়ে যাওয়া
সেই তো দেখা সেই তো পাওয়া,
বিরহ মিলন মিলে গেল আজ সমান সাজে॥
অরূপ, তোমার বাণী
অরূপ, তোমার বাণী
অঙ্গে আমার চিত্তে আমার মুক্তি দিক্ সে আনি ॥
নিত্যকালের উৎসব তব বিশ্বের দীপালিকা–
আমি শুধু তারি মাটির প্রদীপ, জ্বালাও তাহার শিখা
নির্বাণহীন আলোকদীপ্ত তোমার ইচ্ছাখানি ॥
যেমন তোমার বসন্তবায় গীতলেখা যায় লিখে
বর্ণে বর্ণে পুষ্পে পর্ণে বনে বনে দিকে দিকে
তেমনি আমার প্রাণের কেন্দ্রে নিশ্বাস দাও পুরে,
শূন্য তাহার পূর্ণ করিয়া ধন্য করুক সুরে–
বিঘ্ন তাহার পুণ্য করুক তব দক্ষিণপাণি ॥
অল্প লইয়া থাকি, তাই মোর যাহা যায় তাহা যায়
অল্প লইয়া থাকি, তাই মোর যাহা যায় তাহা যায়।
কণাটুকু যদি হারায় তা লয়ে প্রাণ করে ‘হায় হায়’॥
নদীতটসম কেবলই বৃথাই প্রবাহ আঁকড়ি রাখিবারে চাই,
একে একে বুকে আঘাত করিয়া ঢেউগুলি কোথা ধায়॥
যাহা যায় আর যাহা-কিছু থাকে সব যদি দিই সঁপিয়া তোমাকে
তবে নাহি ক্ষয়, সবই জেগে রয় তব মহা মহিমায়।
তোমাতে রয়েছে কত শশী ভানু, হারায় না কভু অণু পরমাণু,
আমারই ক্ষুদ্র হারাধনগুলি রবে না কি তব পায়॥
অশ্রুনদীর সুদূর পারে ঘাট দেখা যায় তোমার দ্বারে
অশ্রুনদীর সুদূর পারে ঘাট দেখা যায় তোমার দ্বারে॥
নিজের হাতে নিজে বাঁধা ঘরে আধা বাইরে আধা–
এবার ভাসাই সন্ধ্যাহাওয়ায় আপনারে॥
কাটল বেলা হাটের দিনে
লোকের কথার বোঝা কিনে।
কথার সে ভার নামা রে মন, নীরব হয়ে শোন্ দেখি শোন্
পারের হাওয়ায় গান বাজে কোন্ বীণার তারে॥
অসীম আকাশে অগণ্য কিরণ, কত গ্রহ উপগ্রহ
অসীম আকাশে অগণ্য কিরণ, কত গ্রহ উপগ্রহ
কত চন্দ্র তপন ফিরিছে বিচিত্র আলোক জ্বালায়ে–
তুমি কোথায়, তুমি কোথায়?।
হায় সকলই অন্ধকার– চন্দ্র, সূর্য, সকল কিরণ,
আঁধার নিখিল বিশ্বজগত।
তোমার প্রকাশ হৃদয়মাঝে সুন্দর মোর নাথ–
মধুর প্রেম-আলোকে তোমারি মাধুরী তোমারে প্রকাশে ॥
অসীম কালসাগরে ভুবন ভেসে চলেছে
অসীম কালসাগরে ভুবন ভেসে চলেছে।
অমৃতভবন কোথা আছে তাহা কে জানে ॥
হেরো আপন হৃদয়মাঝে ডুবিয়ে, একি শোভা!
অমৃতময় দেবতা সতত
বিরাজে এই মন্দিরে, এই সুধানিকেতনে ॥
অসীম ধন তো আছে তোমার, তাহে সাধ না মেটে
অসীম ধন তো আছে তোমার, তাহে সাধ না মেটে।
নিতে চাও তা আমার হাতে কণায় কণায় বেঁটে ॥
দিয়ে তোমার রতনমণি আমায় করলে ধনী–
এখন দ্বারে এসে ডাকো, রয়েছি দ্বার এঁটে ॥
আমায় তুমি করবে দাতা, আপনি ভিক্ষু হবে–
বিশ্বভুবন মাতল যে তাই হাসির কলরবে।
তুমি রইবে না ওই রথে, তুমি নামবে ধুলাপথে
যুগ-যুগান্ত আমার সাথে চলবে হেঁটে হেঁটে ॥
আঁখিজল মুছাইলে জননী
আঁখিজল মুছাইলে জননী–
অসীম স্নেহ তব, ধন্য তুমি গো,
ধন্য ধন্য তব করুণা ॥
অনাথ যে তারে তুমি মুখ তুলে চাহিলে,
মলিন যে তারে বসাইলে পাশে–
তোমার দুয়ার হতে কেহ না ফিরে
যে আসে অমৃতপিয়াসে ॥
দেখেছি আজি তব প্রেমমুখহাসি,
পেয়েছি চরণচ্ছায়া।
চাহি না আর-কিছু– পুরেছে কামনা,
ঘুচেছে হৃদয়বেদনা ॥
আঁধার এল ব’লে
আঁধার এল ব’লে
তাই তো ঘরে উঠল আলো জ্বলে॥
ভুলেছিলেম দিনে, রাতে নিলেম চিনে–
জেনেছি কার লীলা আমার বক্ষোদোলার দোলে॥
ঘুমহারা মোর বনে
বিহঙ্গগান জাগল ক্ষণে ক্ষণে।
যখন সকল শব্দ হয়েছে নিস্তব্ধ
বসন্তবায় মোরে জাগায় পল্লবকল্লোলে॥
আঁধার রজনী পোহালো, জগত পূরিল পুলকে
আঁধার রজনী পোহালো, জগত পূরিল পুলকে।
বিমল প্রভাতকিরণে মিলিল দ্যুলোকে ভূলোকে ॥
জগত নয়ন তুলিয়া হৃদয়দুয়ার খুলিয়া
হেরিছে হৃদয়নাথেরে আপন হৃদয়-আলোকে ॥
প্রেমমুখহাসি তাঁহারি পড়িছে ধরার আননে–
কুসুম বিকশি উঠিছে, সমীর বহিছে কাননে।
সুধীরে আঁধার টুটিছে, দশ দিক ফুটে উঠিছে–
জননীর কোলে যেন রে জাগিছে বালিকা বালকে ॥
জগত যে দিকে চাহিছে সে দিকে দেখিনু চাহিয়া,
হেরি সে অসীম মাধুরী হৃদয় উঠিছে গাহিয়া।
নবীন আলোকে ভাতিছে, নবীন আশায় মাতিছে,
নবীন জীবন লভিয়া জয় জয় উঠে ত্রিলোকে ॥