কান্নাহাসির-দোল-দোলানো পৌষ-ফাগুনের পালা
কান্নাহাসির-দোল-দোলানো পৌষ-ফাগুনের পালা,
তারি মধ্যে চিরজীবন বইব গানের ডালা—
এই কি তোমার খুশি, আমায় তাই পরালে মালা
সুরের-গন্ধ-ঢালা?।
তাই কি আমার ঘুম ছুটেছে, বাঁধ টুটেছে মনে,
খ্যাপা হাওয়ার ঢেউ উঠেছে চিরব্যথার বনে,
কাঁপে আমার দিবানিশার সকল আঁধার আলা!
এই কি তোমার খুশি, আমায় তাই পরালে মালা
সুরের-গন্ধ-ঢালা?।
রাতের বাসা হয়্নি বাঁধা দিনের কাজে ত্রুটি,
বিনা কাজের সেবার মাঝে পাই নে আমি ছুটি।
শান্তি কোথায় মোর তরে হায় বিশ্বভুবন-মাঝে,
অশান্তি যে আঘাত করে তাই তো বীণা বাজে।
নিত্য রবে প্রাণ-পোড়ানো গানের আগুন জ্বালা—
এই কি তোমার খুশি, আমায় তাই পরালে মালা
সুরের-গন্ধ-ঢালা?।
কামনা করি একান্তে
কামনা করি একান্তে
হউক বরষিত নিখিল বিশ্বে সুখ শান্তি ॥
পাপতাপ হিংসা শোক পাসরে সকল লোক,
সকল প্রাণী পায় কূল
সেইসব তব তাপিতশরণ অভয়চরণপ্রান্তে ॥
কার মিলন চাও বিরহী
কার মিলন চাও বিরহী–
তাঁহারে কোথা খুঁজিছ ভব-অরণ্যে
কুটিল জটিল গহনে শান্তিসুখহীন ওরে মন ॥
দেখো দেখো রে চিত্তকমলে চরণপদ্ম বাজে– হায়!
অমৃতজ্যোতি কিবা সুন্দর ওরে মন ॥
কার হাতে এই মালা তোমার পাঠালে
কার হাতে এই মালা তোমার পাঠালে
আজ ফাগুন দিনের সকালে।
তার বর্ণে তোমার নামের রেখা,
গন্ধে তোমার ছন্দ লেখা,
সেই মালাটি বেঁধেছি মোর কপালে
আজ ফাগুন দিনের সকালে
গানটি তোমার চলে এল আকাশে
আজ ফাগুন দিনের বাতাসে।
ওগো আমার নামটি তোমার সুরে
কেমন করে দিলে জুড়ে
লুকিয়ে তুমি ওই গানেরি আড়ালে,
আজ ফাগুন দিনের সকালে।
কী গাব আমি, কী শুনাব, আজি আনন্দধামে
কী গাব আমি, কী শুনাব, আজি আনন্দধামে।
পুরবাসী জনে এনেছি ডেকে তোমার অমৃতনামে ॥
কেমনে বর্ণিব তোমার রচনা, কেমনে রটিব তোমার করুণা,
কেমনে গলাব হৃদয় প্রাণ তোমার মধুর প্রেমে ॥
তব নাম লয়ে চন্দ্র তারা অসীম শূন্যে ধাইছে–
রবি হতে গ্রহে ঝরিছে প্রেম, গ্রহ হতে গ্রহে ছাইছে।
অসীম আকাশ নীলশতদল তোমার কিরণে সদা ঢলঢল,
তোমার অমৃতসাগর-মাঝারে ভাসিছে অবিরামে ॥
কী ভয় অভয়ধামে, তুমি মহারাজা– ভয় যায় তব নামে
কী ভয় অভয়ধামে, তুমি মহারাজা– ভয় যায় তব নামে ॥
নির্ভয়ে অযুত সহস্র লোক ধায় হে,
গগনে গগনে সেই অভয়নাম গায় হে ॥
তব বলে কর বলী যারে, কৃপাময়,
লোকভয় বিপদ মৃত্যুভয় দূর হয় তার।
আশা বিকাশে, সব বন্ধন ঘুচে, নিত্য অমৃতরস পায় হে ॥
কূল থেকে মোর গানের তরী
কূল থেকে মোর গানের তরী দিলেম খুলে,
সাগর-মাঝে ভাসিয়ে দিলেম পালটি তুলে ॥
যেখানে ঐ কোকিল ডাকে ছায়াতলে
সেখানে নয়,
যেখানে ঐ গ্রামের বধূ আসে জলে
সেখানে নয়,
যেখানে নীল মরণলীলা উঠছে দুলে
সেখানে মোর গানের তরী দিলেম খুলে ॥
এবার, বীণা, তোমায় আমায় আমরা একা–
অন্ধকারে নাইবা কারে গেল দেখা॥
কুঞ্জবনের শাখা হতে যে ফুল তোলে
সে ফুল এ নয়,
বাতায়নের লতা হতে যে ফুল দোলে
সে ফুল এ নয়–
দিশাহারা আকাশ-ভরা সুরের ফুলে
সেই দিকে মোর গানের তরী দিলেম খুলে ॥
কে গো অন্তরতর সে
কে গো অন্তরতর সে !
আমার চেতনা আমার বেদনা তারি সুগভীর পরশে॥
আঁখিতে আমার বুলায় মন্ত্র, বাজায় হৃদয়বীণার তন্ত্র,
কত আনন্দে জাগায় ছন্দ কত সুখে দুখে হরষে॥
সোনালি রুপালি সবুজে সুনীলে সে এমন মায়া কেমনে গাঁথিলে–
তারি সে আড়ালে চরণ বাড়ালে, ডুবালে সে সুধাসরসে।
কত দিন আসে, কত যুগ যায়, গোপনে গোপনে পরান ভুলায়,
নানা পরিচয়ে নানা নাম ল’য়ে নিতি নিতি রস বরষে॥
কে জানিত তুমি ডাকিবে আমারে, ছিলাম নিদ্রামগন
কে জানিত তুমি ডাকিবে আমারে, ছিলাম নিদ্রামগন।
সংসার মোরে মহামোহঘোরে ছিল সদা ঘিরে সঘন ॥
আপনার হাতে দিবে যে বেদনা, ভাসাবে নয়নজলে,
কে জানিত হবে আমার এমন শুভদিন শুভলগন ॥
জানি না কখন করুণা-অরুণ উঠিল উদয়াচলে,
দেখিতে দেখিতে কিরণে পুরিল আমার হৃদয়গগন ॥
তোমার অমৃতসাগর হইতে বন্যা আসিল কবে,
হৃদয়ে বাহিরে যত বাঁধ ছিল কখন হইল ভগন ॥
সুবাতাস তুমি আপনি দিয়েছ, পরানে দিয়েছ আশা–
আমার জীবনতরণী হইবে তোমার চরণে মগন ॥
কে বসিলে আজি হৃদয়াসনে ভুবনেশ্বর প্রভু
কে বসিলে আজি হৃদয়াসনে ভুবনেশ্বর প্রভু,–
জাগাইলে অনুপম সুন্দর শোভা হে হৃদয়েশ্বর ॥
সহসা ফুটিল ফুলমঞ্জরী শুকানো তরুতে,
পাষাণে বহে সুধাহারা ॥
কে যায় অমৃতধামযাত্রী
কে যায় অমৃতধামযাত্রী।
আজি এ গহন তিমিররাত্রি,
কাঁপে নভ জয়গানে ॥
আনন্দরব শ্রবণে লাগে, সুপ্ত হৃদয় চমকি জাগে,
চাহি দেখে পথপানে॥
ওগো রহো রহো, মোরে ডাকি লহো, কহো আশ্বাসবাণী।
যাব অহরহ সাথে সাথে
সুখে দুখে শোকে দিবসে রাতে
অপরাজিত প্রাণে ॥
কে রে ওই ডাকিছে
কে রে ওই ডাকিছে,
স্নেহের রব উঠিছে জগতে জগতে–
তোরা আয় আয় আয় আয় ॥
তাই আনন্দে বিহঙ্গ গান গায়,
প্রভাতে সে সুধাস্বর প্রচারে ॥
বিষাদ তবে কেন, অশ্রু বহে চোখে,
শোককাতর আকুল কেন আজি!
কেন নিরানন্দ, চলো সবে যাই–
পূর্ণ হবে আশা ॥
কেন জাগে না, জাগে না অবশ পরান
কেন জাগে না, জাগে না অবশ পরান–
নিশিদিন অচেতন ধূলিশয়ান?।
জাগিছে তারা নিশীথ-আকাশে,
জাগিছে শত অনিমেষ নয়ান ॥
বিহগ গাহে বনে ফুটে ফুলরাশি,
চন্দ্রমা হাসে সুধাময় হাসি–
তব মাধুরী কেন জাগে না প্রাণে?
কেন হেরি না তব প্রেমবয়ান?।
পাই জননীর অযাচিত স্নেহ,
ভাই ভগিনী মিলি মধুময় গেহ
কত ভাবে সদা তুমি আছ হে কাছে,
কেন করি তোমা হতে দূরে প্রয়াণ?।